সুসং দুর্গাপুর: প্রকৃতির স্বর্গকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিচ্ছে লোভের হাত

শুধু পাহাড় নয়, ধ্বংস হচ্ছে সোমেশ্বরী নদীওছবি: লেখক

নেত্রকোনার সুসং দুর্গাপুর—বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব সীমান্তঘেঁষা অঞ্চলটি দেশের অন্যতম একটি সুন্দর স্থান বলে আমি মনে করি। পাহাড়, নদী, সবুজ গ্রাম, আর সীমান্তের ওপারে মেঘালয়ের নীলাভ আভা—সব মিলিয়ে এখানে যেন প্রকৃতি নিজ হাতে আঁকা এক অপূর্ব দৃশ্যপট সাজিয়ে দিয়েছে। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ‘চিনামাটির পাহাড়’, যা সাদা রঙের মাটির অনন্য সৌন্দর্যের জন্য পর্যটক ও আলোকচিত্রীদের প্রিয় গন্তব্যে পরিণত হয়েছিল।

কিন্তু দুঃখজনক বাস্তব হলো, এই পাহাড় আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। বছরের পর বছর ধরে অবৈধভাবে পাহাড় কেটে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে চিনামাটি, যেন এটি কোনো প্রাকৃতিক সম্পদ নয়, বরং খনির মালামাল। এই ধ্বংসযজ্ঞের পরিণতি কেবল পাহাড়ের হারিয়ে যাওয়া নয়, এর সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে একটি এলাকার প্রাণপ্রকৃতি, জীববৈচিত্র্য, আর একটি প্রজন্মের স্বপ্ন।

ভোলাগঞ্জের সাদাপাথরের কথা মনে পড়ছে—যে পাথর একসময় ছিল সিলেটের গর্ব, এখন প্রায় পুরোপুরি শেষ হয়ে গেছে অযত্ন, অবহেলা ও অবৈধ বাণিজ্যের কারণে। আজ সেই একই পরিণতির পথে হাঁটছে সুসং দুর্গাপুরের চিনামাটির পাহাড়।

শুধু পাহাড় নয়, ধ্বংস হচ্ছে সোমেশ্বরী নদীও। বছরের পর বছর ধরে অনিয়ন্ত্রিত বালু উত্তোলনে এই নদীর তলদেশ গভীর হয়ে যাচ্ছে, ভাঙন তীব্র হচ্ছে, মাছ ও জলজ প্রাণীর আবাস নষ্ট হচ্ছে। একসময় যেটি ছিল দুর্গাপুরের প্রাণ, সেই নদী আজ বালু ব্যবসায়ীদের হাতে মৃত্যুর মুখে।

সবচেয়ে বেদনাদায়ক বিষয় হলো—এসব অপরাধকারী প্রায় সব সময় আইনের বাইরে থেকে যায়। প্রকৃতি ধ্বংস, নদী হত্যা, পাহাড় কেটে ফেলা—সবকিছু চোখের সামনে ঘটলেও বিচার হয় না, শাস্তি হয় না। যেন দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য কারও সম্পত্তি, যা ইচ্ছেমতো লুট করে নেওয়া যায়।

ভোলাগঞ্জের সাদাপাথরের কথা মনে পড়ছে—যে পাথর একসময় ছিল সিলেটের গর্ব, এখন প্রায় পুরোপুরি শেষ হয়ে গেছে অযত্ন, অবহেলা ও অবৈধ বাণিজ্যের কারণে। সেই একই পরিণতির পথে হাঁটছে সুসং দুর্গাপুরের চিনামাটির পাহাড়
ছবি: লেখক

ভাগ্যিস, আমি আগেই এসব জায়গায় গিয়েছিলাম—দুর্গাপুরের সেই সাদাপাহাড়ে হেঁটেছি, সোমেশ্বরীর স্বচ্ছ জলে পা ডুবিয়েছি, গ্রামের নিস্তব্ধতায় সময় কাটিয়েছি। আজ ভাবি, হয়তো আগামী প্রজন্ম আর কখনো এই সৌন্দর্য দেখতে পাবে না। তারা শুধু বইয়ের পাতায় বা পুরোনো ছবিতে দেখবে একসময়ের ‘বাংলাদেশের সাদা স্বর্গ’, যা আমরা রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছি।

পর্যটন শুধু অর্থনৈতিক সম্ভাবনা নয়, এটি একটি দেশের আত্মপরিচয়ের অংশ। কিন্তু যদি পাহাড়, নদী, বন সব লুট হয়ে যায়, তবে ভবিষ্যতে আমরা কী নিয়ে গর্ব করব? সুসং দুর্গাপুরের মতো জায়গাগুলো রক্ষা করা এখনই জরুরি। আইন প্রয়োগ, স্থানীয় লোকজনের সম্পৃক্ততা, আর সর্বোপরি প্রকৃতিকে ভালোবাসার শিক্ষা—এই তিনটিই হতে পারে শেষ আশ্রয়।

আমরা যদি এখনই না জাগি, তবে হয়তো শিগগিরই আর কোনো সুসং দুর্গাপুর থাকবে না, থাকবে শুধু স্মৃতি আর আফসোস।

লেখক: নুসরাত রুষা, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ‍্যালয়

নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]