লিখিত পরীক্ষা দিয়ে বিয়ে–২য় পর্ব
বাবা দুলাভাইয়ের কথার কোনো গুরুত্ব দিলেন না। কারণ, তিনি ভালো করেই জানেন, তাঁর মেয়ের জামাই একজন মাথামোটা মানুষ। বাবা শিওর আজ ভেজাল একটা লাগবেই।
এখনই আমার পরীক্ষার ফলাফল দেওয়া হবে। এরই মধ্যে সবাই ড্রয়িংরুমে চলে এসেছেন। খালা এতক্ষণ রান্নাঘরে খাবারের আয়োজন নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। ওনার হাতের সব কাজ শেষ করে রুমে এলেন। এসেই সোফায় আমার এক পাশে বসলেন। আমার অন্য পাশে বসেছেন দুলাভাই। টেনশনে আমার বুক দুরু দুরু কাঁপছে। তবে দুলাভাইকে দেখে যথেষ্ট কনফিডেন্ট মনে হলো। ওনার চেহারা দেখে মনে হবে উনি এইমাত্র বিশ্ব জয় করে এসেছেন।
দুলাভাইয়ের পাশের সোফাতে আমার মা–বাবা বসেছেন। মা–বাবা দুজনের চেহারাতে টেনশনের ছাপ স্পষ্ট। বাবার চেহারায় টেনশন দেখে দুলাভাই বাবার কানের কাছে মুখ এনে নিচু স্বরে বললেন, আব্বা, টেনশন করবেন না। আমি আপনাকে গ্যারান্টি দিলাম, ইমু এক শতে এক শ পাবে। আমি যে উত্তর বলে দিয়েছি, তা যদি ও ঠিকমতো লিখে থাকে, তাহলে ফেল করার প্রশ্নই আসে না। আপনি আমার ওপর বিশ্বাস রাখতে পারেন।
বাবা দুলাভাইয়ের কথার কোনো গুরুত্ব দিলেন না। কারণ, তিনি ভালো করেই জানেন, তাঁর মেয়ের জামাই একজন মাথামোটা মানুষ। বাবা শিওর আজ ভেজাল একটা লাগবেই।
দুই পরিবারের সবাই আগ্রহ নিয়ে লিমার দিকে তাকিয়ে আছেন। লিমার হাতে আমার পরীক্ষার উত্তরপত্র। লিমা কোনো কথা না বলে উত্তরপত্রটি তাঁর ছোট বোন রিমার হাতে দিলেন। রিমা এ বছর নিউইয়র্কে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। সে একটা বিচ্ছু টাইপের মেয়ে। মূলত আজকের এই পরীক্ষার আইডিয়াটা তার এবং প্রশ্নপত্রও সে তৈরি করেছে। রিমা তার বক্তব্য শুরু করল, ইমু ভাইয়াকে আমাদের পরিবারের সবাই পছন্দ করেছেন। বলতে পারেন, আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম ইমু ভাইয়ের সঙ্গেই আপুর বিয়ে হবে। তাহলে এ পরীক্ষার উদ্দেশ্য কী? বলতে পারেন, কিছুই না। আসলে আমরা দুই বোন শুধু একটু মজা করার জন্য এ পরীক্ষার আয়োজন করেছিলাম। প্রশ্নগুলো দেখলেই আপনারা তা বুঝতে পারবেন। আমি এখানে যে কয়টি প্রশ্ন করেছি, তার বেশির ভাগই উদ্ভট। তবে বিষয়টি ফান হিসেবে শুরু হলেও, তা এখন আর ফানের পর্যায়ে নেই। কারণ, ওনার উত্তরপত্র দেখে আমি আর আমার বোন খুবই হতাশ হয়েছি। আমি দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, উনি পরীক্ষায় ফেল করেছেন। উনি যদি একটা প্রশ্নের উত্তরও না দিতেন, তাহলেও বিয়েটা হতো। কিন্তু উনি প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে ওনার রুচির যে পরিচয় দিয়েছেন, তাতে সম্ভবত বিয়েটা আর হচ্ছে না।
এ কথা শোনামাত্রই দুলাভাইয়ের চেহারা থেকে সব ভাব উধাও হয়ে গেল। বাবা ভুরু কুঁচকে দুলাভাইয়ের দিকে তাকালেন। বাবার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই দুলাভাই ভয়ে ঢোঁক গিললেন। আর ঢোঁক গিলতে গিয়ে উনি টের পেলেন, ওনার গলা শুকিয়ে গেছে। উনি দ্রুত সামনের টি টেবিলে রাখা পানির গ্লাস নিয়ে ঢক ঢক করে খেয়ে ফেললেন। দুলাভাইয়ের দেখাদেখি আমিও আমার সামনে রাখা গ্লাসের পানি খেয়ে ফেললাম। কারণ, ভয়ে–আতঙ্কে আমারও গলা শুকিয়ে গেছে। দুলাভাই পানি খেয়েই বললেন, আমাকে কি আর এক গ্লাস পানি দেওয়া যায়?
আমার খালাতো বোন পানি আনার জন্য রওনা দিতেই আমার বাবা পেছন থেকে ডেকে বললেন, মা, গ্লাসে করে পানি এনে কোনো লাভ হবে না। কারণ, এ দুইটার এখন অনেক পানি লাগবে। তুমি বরং জগ ভরে পানি নিয়ে আসো।
আমার খালাতো বোন এক জগ পানি এনে টেবিলে রাখল। দুলাভাই গ্লাসে পানি ঢেলে আরেক গ্লাস পানি পান করলেন। তারপর রিমাকে বললেন, আপনি কি শিওর ও ফেল করেছে? আমি তো ভেবেছিলাম ও এক শ পাবে।
রিমা দুলাভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, দুলাভাই, পাস–ফেল তো পরের কথা। উনি যে উত্তর দিয়েছেন, তা যদি আপনারা শোনেন, তাহলে আমি শিওর, আপনারা ওনাকে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করবেন। আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না, একজন সুস্থ মানুষ এভাবে লিখতে পারে!
এবার রুমের সবাই আমার দিকে এমনভাবে তাকালেন, মনে হলো আমি একজন ধর্ষণকারী। খালা মায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, বকুল, তোর পোলা যে এত খারাপ, সেটা তো তুই কখনো আমাদের বলিসনি।
এ কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে দুলাভাই বাবার দিকে ভয়ে ভয়ে তাকালেন। দেখলেন, বাবা এখনো ওনার দিকে কেমন করে জানি তাকিয়ে আছেন। দুলাভাই ভয়ে চোখ সরিয়ে নিলেন।
রিমা এবার সবার উদ্দেশে বললেন, আপনারা কি চান আমি সবার সামনে ওনার উত্তরপত্র পড়ি?
দুলাভাই দ্রুত বলে উঠলেন, না না, পড়তে হবে না। কোনো সমস্যা নেই। আমরা পরীক্ষার রেজাল্ট মেনে নিয়েছি।
আমি মাথা ঝাঁকিয়ে দুলাভাইয়ের কথার সমর্থন করলাম। আমার মাথা ঝাঁকানো দেখে রিমার কী হলো জানি না। সে আমার দিকে সরাসরি তাকিয়ে ধীরস্থির কণ্ঠে বলল, আরে না, সবাইকে একটু পড়ে শোনাই। সবাই জানুক ছেলেটা কত খারাপ।
বুঝলাম, আজ আমার মানসম্মান-ইজ্জত সব নিলামে উঠবে। এই মোটাবুদ্ধির দুলাভাইয়ের কথামতো পরীক্ষার উত্তর দেওয়া আমার একদমই উচিত হয়নি। রিমা একটু বিরতি নিয়ে আবার বলা শুরু করল।
আমি এখন প্রতিটা প্রশ্ন এবং ওনার দেওয়া উত্তর পড়ছি। সব শুনে আপনারাই বিবেচনা করবেন উনি কেমন মানুষ।
রিমার কথা শেষ হতেই খালা আমার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে কটমট করে তাকালেন। তারপর কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললেন, হারামজাদা, আমি আমার বান্ধবীর কাছে বড়াই করে বলেছি তুই একটা ভালো ছেলে। আজ যদি তোর কারণে আমাকে ছোট হতে হয় তো তোর খবর আছে।
আমি কোনো উত্তর না দিয়ে ভয়ে মাথা নিচু করে বসে রইলাম। রিমা উত্তরপত্রের দিকে তাকিয়ে পড়া শুরু করল।
পরীক্ষার প্রথম প্রশ্ন ছিল, আপনার কাছে বিয়ে মানে কী? উনি উত্তর দিয়েছেন, বিয়ে মানে আনন্দ করা আর সন্তান উৎপাদন করা। একবার চিন্তা করুন, কথাটা কতটা অশ্লীল! একজন শিক্ষিত মানুষ এ ভাষায় কথা বলতে পারে, আমার ধারণা ছিল না।
রিমার কথা শেষ হতেই খেয়াল করলাম, বাবা দাঁত কিটমিট করে আমার দিকে তাকালেন। আমি ভয়ে চোখ সরিয়ে নিয়ে দুলাভাইয়ের দিকে তাকালাম। দুলাভাই আমাকে না দেখার ভান করে আবারও গ্লাসে পানি ঢেলে ঢক ঢক করে খেয়ে ফেললেন। এরপর আমার গ্লাসে পানি ঢেলে দিলেন। আমিও এক চুমুকে সেই পানি শেষ করলাম। পানি শেষ করে দেখলাম বাবা এখনো আমার দিকে তাকিয়ে দাঁত কিটমিট করছেন।
রিমা পরের প্রশ্ন পড়া শুরু করল, দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল, বাসর রাতে কোন গানটি আপনি আপনার স্ত্রীর কাছে শুনতে চাইবেন? ক. আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে। খ. হিপস ডোন্ট লাই। উনি উত্তর দিয়েছেন, হিপস ডোন্ট লাই। কী অদ্ভুত ওনার রুচি! আমি বলছি না যে গানটি খারাপ। কিন্তু তাই বলে বাসর রাতের মতো এমন একটা রোমান্টিক রাতে, কোনো স্বামী রবীন্দ্রসংগীত বাদ দিয়ে স্ত্রীকে হিপের গান গাইতে বলবেন, এটা অবিশ্বাস্য।
রিমা থামতেই মা–বাবা দুজনই ভুরু কুঁচকে দুলাভাইয়ের দিকে তাকালেন। আর খালা তাকালেন আমার দিকে। তারপর চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, হারামজাদা, তোর হিপের গান শোনার খুব শখ? দাঁড়া, আজ যদি আমি লাত্থি দিয়ে তোর হিপের সব হাড্ডি না ভাঙছি, তাহলে আমার নাম তুই বদলায়ে রাখিস।
আমি ভয়ে খালার থেকে চোখ সরিয়ে দুলাভাইয়ের দিকে তাকালাম। দেখলাম, দুলাভাই নিশ্চিন্তে গ্লাসে পানি ঢালছেন। আর পানি পান করছেন। মনে হচ্ছে, বাঁশ দিয়ে ব্যাটার মাথায় একটা বাড়ি দিই।
রিমা আবার বলতে শুরু করলেন, পরের প্রশ্ন ছিল, ছুটির দিনে আপনি বিনোদনের জন্য কী করবেন? ক. নাইট ক্লাবে গিয়ে স্ট্রিপ ড্যান্স দেখবেন। খ. বেইলি রোডে গিয়ে মঞ্চনাটক দেখবেন। জানেন উনি কী উত্তর দিয়েছেন? উনি বলেছেন, উনি নাইট ক্লাবে গিয়ে স্ট্রিপ ড্যান্স দেখবেন।
এবার রুমের সবাই আমার দিকে এমনভাবে তাকালেন, মনে হলো আমি একজন ধর্ষণকারী। খালা মায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, বকুল, তোর পোলা যে এত খারাপ, সেটা তো তুই কখনো আমাদের বলিসনি।
খালার কথায় মা কোনো উত্তর না দিয়ে আগুনচোখে দুলাভাইয়ের দিকে তাকালেন। অবশ্য দুলাভাই এখন আর কারও দিকে তাকাচ্ছেন না। উনি এখন শুধু পানি ঢালছেন আর পান করছেন। আমি বুঝলাম না, একটা মানুষ এত পানি খাচ্ছে কীভাবে? না, এ লোকের মাথায় আসলেই সমস্যা আছে।
রিমা এবার পরের প্রশ্ন পড়া শুরু করল, শেষ প্রশ্ন ছিল, দুটি পোশাকের মধ্যে মেয়েদের কোন পোশাকে সুন্দর লাগে? এবং কেন? ক. শাড়ি, খ. বিকিনি? উনি কী উত্তর দিয়েছেন, শুনবেন?
রিমার কথা শেষ হতেই খালা জোরের সঙ্গেই বললেন, অবশ্যই শুনব। আমি দেখতে চাই হারামজাদার রুচি আর কতটা নিচে নামতে পারে।
এ সময় দুলাভাই বললেন, আমাদের কি আরেক জগ পানি দেওয়া যায়?
আমার খালাতো বোন আরেক জগ পানি এনে টেবিলে রাখল। দুলাভাই জগ থেকে আমাদের দুজনের গ্লাসে পানি ঢাললেন। তারপর আমার কানের কাছে মুখ এনে নিচু স্বরে বললেন, ইমু, পানি খাও। পানি খুবই দরকারি জিনিস। পানি খেলে মনে জোর পাবা। ভয়কে জয় করতে হলে পানি লাগবে।
এ কথা বলেই দুলাভাই এক চুমুকে পুরো গ্লাসের পানি শেষ করে ফেললেন। আমিও দুলাভাইয়ের মতো আমার গ্লাসের পানি শেষ করলাম। তারপর দুলাভাই আর আমি দুজন মিলে একসঙ্গে করুণ চোখে রিমার দিকে তাকালাম। আমরা আমাদের চোখের ভাষায় রিমাকে বললাম, আপা দরকার হলে আপনার বোনরে বিয়ে দিয়েন না। প্লিজ, তবু আর সবার সামনে বেইজ্জত কইরেন না। আর কিছু বইলেন না। কিন্তু এ ফাজিল মেয়ে আমাদের চোখের করুণ ভাষার কোনো মূল্য দিল না।
সে আবার মুখ খুলল, উনি লিখেছেন, বিকিনিতে মেয়েদের বেশি সুন্দর লাগে। আর কেন–এর ব্যাখ্যায় উনি লিখেছেন, মেয়েরা ছোট পোশাকেই বেশি আকর্ষণীয়। আমার মনে হয়, উনি আসলে বলতে চেয়েছেন, মেয়েরা পোশাক ছাড়াই বেশি সুন্দর। চিন্তা করেন, একটা মানুষ কতটা বিকৃত মানসিকতার হলে এমন কথা বলতে পারে! মেয়ে জাতির প্রতি ওনার ন্যূনতম শ্রদ্ধাবোধ থাকলে উনি এমন করে ভাবতে পারতেন না।
মাই গড, এই মেয়ে তো ডেঞ্জারাস। নিজেই উল্টাপাল্টা প্রশ্ন করল। আবার নিজেই উত্তরটাকে নিজের মতো সাজিয়ে আমাকে নারী জাতির দুশমন বানিয়ে দিল? অবশ্য রিমার দোষ দিয়ে তো লাভ নেই। দোষ তো আসলে আমার। না হলে কি আমি ওই মাথামোটা লোকের কথামতো উত্তর দিই।
রিমা আমার দিকে তাকিয়ে একটি মুচকি হাসি দিল। এরপর অন্য সবার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনারা সবাই মেয়েদের পোশাকের ব্যাপারে ওনার উত্তর থেকে কী বুঝেছেন, আমি জানি না। তবে আমি যেটা বুঝলাম, সেটা হলো উনি চান মেয়েরা ওনার সামনে কাপড় ছাড়া হাঁটাহাঁটি করুক। আজব, মানসিক অসুস্থ একটা মানুষ।
রিমার কথা শেষ হতেই খালা দ্রুত আমার পাশ থেকে উঠে দূরে সরে গেলেন। তারপর মাথা এপাশ–ওপাশ করতে করতে বললেন, না, এই হারামজাদার পাশে বসাটা বিপজ্জনক।
এরপর খালা আমি যে সোফায় বসেছিলাম, সে সোফার পেছনে দাঁড়ানো ওনার মেয়ের উদ্দেশে বললেন, ওই, তুই এই হারামজাদার পাশ থেকে সরে দাঁড়া। আর শোন, খবরদার, ওদের বাসায় আর যাবি না। এই হারামজাদার চরিত্রে সমস্যা আছে।
খালা থামতেই রিমা সবার উদ্দেশে বলল, আপনারা সবই তো শুনলেন। এখন আপনারাই বলুন, এমন একজন বিকৃত রুচির ছেলেকে কি আমার বোনের বিয়ে করা উচিত?
সবাই চুপ করে থাকলেও খালা চিৎকার করে বললেন, অবশ্যই না। ওরে কোনো মেয়েরই বিয়ে করা উচিত না। কারণ, ওর কাছে ওর বউও নিরাপদ না। আমি আগেই বলেছিলাম, হারামজাদার চেহারার মধ্যে একটা ইভ টিজার ইভ টিজার ভাব আছে।
তারপর খালা আমাকে ধমক দিয়ে বললেন, চুপ করে আছিস কেন? বল তুই এত খারাপ কবে থেকে হইলি? মাই গড, আমি তো বিশ্বাসই করতে পারছি না, আমার বোনের ছেলে এতটা খারাপ!
আমি কী বলব, খুঁজে পেলাম না। শুধু ফ্যালফ্যাল করে দুলাভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইলাম। দুলাভাই আমাকে না দেখার ভান করে আবার গ্লাসে পানি ঢালতে লাগলেন। গ্লাসে পানি ঢালা শেষ হলে আমি আর দুলাভাই হাতে পানির গ্লাস নিলাম। পানি মুখের কাছে আনতেই খালা চিৎকার করে বললেন, ওই, তোরা এত পানি খাইতেছিস ক্যান? তোরা দুইটা কি মুইতা আমার ঘর ভাসানোর ধান্দায় আছিস? গ্লাস রাখ।
আমি আর দুলাভাই দুজনই ভয়ে গ্লাস নামিয়ে রাখলাম। গ্লাস নামিয়ে রাখতেই খালা আমার উদ্দেশে বললেন, ওই হারামজাদা, তুই এখনো এইখানে বইসা আছিস ক্যান? তুই বাইর হ আমার বাসা থেকে। আর শোন, তুই আর কখনো আমার বাসায় আসবি না। আমি তোর মুখ আর দেখতে চাই না।
খালা আমাকে এভাবে বকলেও খালার ওপর আমার একটুও রাগ হচ্ছে না। বরং ওনার জন্য আমার মায়া লাগছে। কারণ, বেচারি অনেক বড় মুখ করে বান্ধবীর মেয়ের সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিক করেছিলেন। অথচ এখন আমার জন্য উনি ওনার বান্ধবী ও বান্ধবীর পরিবারের কাছে ছোট হলেন।
বুঝলাম, এখানে বসে থাকার আর কোনো মানে হয় না। আমার এখনই এখান থেকে পালানো উচিত। উপস্থিত কারোর দিকে চোখ তুলে তাকানোর সাহস হলো না। শুধু লিমার দিকে একবার করুণ দৃষ্টিতে একটু তাকালাম। আসলে চোখের ভাষায় তাকে সরি বললাম। বুঝল কি না, জানি না।
খালার বাসা থেকে বের হওয়ার জন্য বসা থেকে উঠে দাঁড়ালাম। হেঁটে দরজার কাছে আসতেই পেছন থেকে দুলাভাই কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললেন, ইমু দাঁড়াও, আমিও তোমার সঙ্গে যাব। আমার জন্য এখানে থাকাটা এখন মোটেই নিরাপদ নয়।
দুলাভাইও আমার পিছু পিছু বের হয়ে এলেন। বেশ কিছুক্ষণ দুলাভাই আমার পিছু পিছু হাঁটলেন। সম্ভবত উনি আমার পাশে হাঁটার সাহস পাচ্ছেন না। অনেকক্ষণ পর সাহস করে আমার পাশে হাঁটা শুরু করলেন। তবে উনি কোনো কথা বলছেন না। আসলে উনি কোনো কথা বলার সাহস পাচ্ছেন না। আমি দুলাভাইকে সহজ করার জন্য বললাম, দুলাভাই, পরীক্ষায় ফেল করছি, সেটা সমস্যা না। কিন্তু কত মার্ক পাইছি, সেটা তো জানা হলো না। আমার তো জানার অধিকার আছে, তাই না?
আমার কথা শেষ হতেই উনি উৎসাহ নিয়ে বললেন, অবশ্যই সে অধিকার তোমার আছে। এটা তোমার গণতান্ত্রিক অধিকার। কেউ এটা কেড়ে নিতে পারবে না। দাঁড়াও, খালাকে ফোন দিই।
চরম উৎসাহ নিয়ে দুলাভাই খালাকে ফোন দিলেন। আমি দুলাভাইকে ফোনের স্পিকার অন করতে বললাম। দুলাভাই ফোনের স্পিকার অন করলেন। স্পিকারে খালার কণ্ঠ ভেসে এল। দুলাভাই বললেন, খালা, আসসালামু আলাইকুম। আপনি ভালো আছেন? খালা, ইমু জানতে চাচ্ছে ও পরীক্ষায় কত নম্বর পেয়েছে?
হা-রা-ম-জা-দারে আমি খুন করব। ওর কত বড় বুকের পাটা, ও আবার নম্বর জানতে চায়।
খালা রাগ করেন ক্যান? এটা তো ওর অধিকার। ফেল করছে বলে কি সে কত নম্বর পেয়েছে, তা জানতে পারবে না?
রাগ করব না তো কি আদর করব? ওর মতো বেয়াদবের কারণে আজ আমি ছোট হয়ে গেলাম।
জি খালা, এটা অবশ্য আপনি ঠিক বলেছেন। ইমু একটা চরম বেয়াদব ছেলে। পুরো পরিবারকে ও সবার সামনে ছোট করল? আমি বুঝি না, এত বাজে উত্তর সে লিখল কীভাবে? একটা শিক্ষিত ছেলে এমন হয়!
দুলাভাইয়ের কথা শেষ না হতেই খালা চিৎকার করে বললেন, ওই ব্যাটা বদমাশ। আমার সঙ্গে বেশি ভাব নিস না। আমি তোর শাশুড়ির কাছে সব শুনেছি। আজ তোর জন্যই বিয়েটা ভাঙছে। ব্যাটা ফাজিল।
বলেই খালা ফোনের লাইন কেটে দিলেন। দুলাভাই আমতা–আমতা করে বললেন, বিয়ে ভেঙে যাওয়ায় খালা কেন যে এত উত্তেজিত হচ্ছেন, বুঝতে পারছি না। বিয়ে ভেঙেছে তোমার, ওনার সমস্যা কী? ইমু শোনো, তোমাকে একটা কথা বলি, আল্লাহ যা করেন, তা ভালোর জন্যই করেন। মনে কষ্ট নিয়ো না। একটা জিনিস খেয়াল করছ? এখানে বিয়ে হলে বিয়ের পর তোমাকে আমেরিকা যেতে হতো। কিন্তু আমেরিকা গিয়া তুমি কী করবা? তুমি তো ইংরেজিতে অনেক দুর্বল। ঠিক না?
আমি কোনো উত্তর দিলাম না। দুলাভাই আবার বলা শুরু করলেন, শোনো, মেয়ে আমেরিকা থাকলেও আমার ধারণা, মেয়ে ততটা আধুনিক না। সে মনমানসিকতায় খুবই প্রাচীন। সে যদি আধুনিক হতো, তাহলে পরীক্ষায় দেওয়া আমার উত্তরগুলোর মূল্য বুঝত, গভীরতা বুঝত।
আমি এবারও কোনো কথা বললাম না। উনি একটুখানি চুপ থেকে আবার কথা বলা শুরু করলেন, আরে, তুই পরীক্ষা নিবি নে, সমস্যা নাই। তুই দরকারি প্রশ্ন কর। তুই প্রশ্ন করবি আমেরিকার রাজধানীর নাম কী? কয়টি স্টেট আছে? এক ডলারে কত টাকা? তা না, তুই প্রশ্ন করস, আপনি কোন গান শুনবেন? ক্যান, আমরা কি তোরে বলছি আমরা গান শুনব? ফাজিল মেয়ে। ইমু শোনো, তুমি চিন্তা করবে না। তোমাকে আমি অনেক ভালো মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দেব। কাল থেকে আমি তোমার নতুন ট্রেনিং শুরু করব। এই ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে তোমাকে আমি উপযুক্ত পাত্র হিসেবে গড়ে তুলব। এবার আমরা সফল হবই। তুমি আমার ওপর ভরসা রাখতে পারো।
দুলাভাইয়ের কথা শেষ হতেই আমি ঘাড় ঘুরিয়ে ভুরু কুঁচকে দুলাভাইয়ের দিকে তাকালাম। উনি আমার তাকানোর ধরন দেখে ভয় পেয়ে বললেন, না না, সামনে যদি কখনো আবার পরীক্ষা দিতে হয়, সেটার উত্তর তুমিই দেবে। আমি শুধু পরীক্ষার আগে তোমাকে প্রস্তুত করব।
আমি হাঁটা থামিয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। ঠিক করলাম লোকটাকে দুটো কড়া কথা বলব। কিন্তু ওনার দিকে তাকাতেই দেখলাম, উনি চোখমুখ খিঁচে রেখেছেন। আর উনি আশপাশে তাকিয়ে কিছু একটা খুঁজছেন।
আমি দুলাভাইকে জিজ্ঞাসা করলাম, সমস্যা কী? আপনি চোখমুখ এভাবে করেছেন কেন? আর এদিক-ওদিক কী খুঁজছেন? ইমু, ভাই, একটা বড় সমস্যা হয়ে গেছে। ভয়ে পানি বেশি খেয়ে ফেলেছি। এখন তো আটকে রাখতে পারছি না? মনে হয় না বাসা পর্যন্ত যেতে পারব। খুবই বিপদে আছি। অবশ্য একটা পলিথিনের ব্যাগ পাওয়া গেলে ভালো হতো। একপাশে দাঁড়িয়ে ব্যাগের মধ্যে হালকা হতাম।
আমি ওনার পলিথিনের ব্যাগে হালকা হওয়ার কথা শুনে বিস্ময়ে মানুষটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। ঠিক সেই সময় আমার মুঠোফোনটা বেজে উঠল। তাকিয়ে দেখলাম, অপরিচিত নম্বর। একবার ভাবলাম রিসিভ করব না। তারপর হঠাৎ কী মনে করে কলটা রিসিভ করলাম। হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে মিষ্টি এক নারীকণ্ঠ ভেসে এল। হ্যালো ইমু ভাইয়া, আমি রিমা…
আমি কোনো কথা না বলেই লাইন কেটে দিলাম। চলবে...