থমকে যাওয়া জীবন, মৃত্যুর আলিঙ্গনে-১৯
আমি যেহেতু করোনা রোগী না, সে কারণে বাসায় সব রুমেই স্বাচ্ছন্দ্যে ঘুরছি। লিভিংরুমে লম্বা একটা কাচের জানালা। লিভিংরুমের কোনায় বসলেই বড় জানালাটা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখা যায়। জানালা দিয়ে বাইরে থেকে চোখ মেলতেই দেখি সাদা বরফের আস্তরণ শক্ত হয়ে গেঁথে গেছে বাড়ির সামনের ফুটপাতে। কোথাও কোথাও পিচ্ছিল রাস্তা ভয়ংকর রূপ নিয়েছে। বেশ কদিন ধরে ঝরছে শুভ্র বরফ। কিন্তু এজাজ চার দিন বরফ পরিষ্কার করেনি। এখানে বরফে থই থই করলেও ঝকঝকে রোদে সব আলোময়। এমন হলে বরফ গলে পানি হয়, আর রাতের ঠান্ডায় সেগুলো কাচের বয়ামের মতো স্বচ্ছ আর পিচ্ছিল হয়ে যায়। কেউ যদি আমার বাড়ির সামনে পড়ে ব্যথা পায়, তবে তক্ষুনি আমার নামে বড় পরিমাণ টাকা জরিমানা করা হবে। এ কারণে এখানে নিজ নিজ বাড়ির ফুটপাতের বরফ পরিষ্কার করতেই হয়। কিন্তু এখন কাচের টুকরার মতো বরফ পরিষ্কার করা যাবে না। আমি কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে ভাবছিলাম, কাউকে দিয়ে লবণ কিনিয়ে রাস্তায় ছিটালে কেমন হয়? বরফ শক্ত হয়ে গেলে, মোটা লবণ দানা ফেললে বরফ নরম হয়। ভাবছি শাহীনকে বলব লবণ কিনে আনতে। এমন সময় ফোনটা বেজে উঠল। ভারি বিচ্ছিরি সে শব্দ। আমি দৌড়ে গেলাম রান্নাঘরে, সেখানেই ফেলে এসেছিলাম ফোনটা।
একজন নার্স মিষ্টি করে বলল, ‘কেমন আছ তোমরা?’
‘আমি ত ভালো আছি।’
‘তোমাদের কি বাজার করার লোক আছে?’
বললাম, ‘আছে, আমার বোন থাকে কাছেই।’
‘তোমাদের কিছু সাহায্য লাগলে জানিয়ো।’ ভীষণ কিন্নরী সে গলা।
‘আচ্ছা জানাব।’
কিন্নরী কণ্ঠ প্রশ্ন করল, জানো তো, চৌদ্দ দিন বাসার বাইরে যেতে পারবে না।
জানি, আমি বিরক্ত হলেও হেসেই বললাম।
‘ভালো থাকো, সাবধানে থাকো।’ কিন্নরী কণ্ঠ ফোন রেখে দিল। আমিও হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম।
এজাজের করোনা পজিটিভ হওয়ার পর আমারও আইসোলেশনে চলে যেতে হয়েছে। আমরা বাসা থেকে বের হতে পারব না ডিসেম্বরের ৭ তারিখ পর্যন্ত।
বিষয়টা আমাকে তেমন পীড়া না দিলেও এজাজের জন্য ভীষণ পীড়াদায়ক। কারণ, সে বাইরে ঘোরাঘুরি করতে খুবই পছন্দ করে। বাসা থেকে বের না হওয়া তার জন্য শাস্তিস্বরূপ। দুই রুমে গৃহবন্দী থাকা তার জন্য জেলখানার মতোই কঠিন হয়ে গেল। তার ওপর মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা, কিছুক্ষণ পরপর ফোন আসছে হেলথ থেকে।
সেখান থেকে ফোন করে তাকে জেরা করা হচ্ছে। সে এখানে একটি বৃদ্ধাশ্রম চালায়। তাদের নিরাপত্তা, এজাজের নিরাপত্তা, বাইরের মানুষের নিরাপত্তা। এত সবার নিরাপত্তা নিয়ে হেলথ অথোরিটি ভীষণ চিন্তিত। করোনাভাইরাস নিয়ে এজাজ কতজনের সঙ্গে দেখা করেছে, কোথাও গিয়েছে কি না ইত্যাদি প্রশ্ন তাকে বিপর্যস্ত বানানো হলো। রিমান্ডে নিলেও এত জেরা হয় কি না, কে জানে।
যে বৃদ্ধাশ্রমে সে কাজ করে, সেখানে সবাইকে এখন কোভিড টেস্ট করতে হবে। কারণ, বৃদ্ধ লোকের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা সবচেয়ে কম। বিভিন্ন দেশে বৃদ্ধাশ্রমগুলোতেই মানুষ মারা যাচ্ছে সবচেয়ে বেশি। অতএব সে অফিসে কোথায় বসে ছিল, অফিস রুমের বাইরে কোথাও গিয়েছিল কি না ইত্যাদি তথ্য তারা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে নিল।
অনেক তথ্য আদান-প্রদানের পর বের হলো, যেদিন তার শরীর খারাপ লেগেছিল, সেদিনই তার পজিটিভ ধরা হয়েছিল। তাই আমিই প্রথম কন্টাক্ট এবং একমাত্র কন্টাক্ট।
তারা যখন জেরা করে একমাত্র আমাকেই ভুক্তভোগী পেল, তখন চলল আমার ওপরও জেরা।
তোমার প্রথম কন্টাক্ট কে?
আমার কন্ট্রাক্ট পারসন নেই।
কারও সঙ্গে দেখা হয়নি? অবিশ্বাসের সুরে।
বললাম তো আমার স্বামী ছাড়া কারও সঙ্গেই দেখা–সাক্ষাৎ হয়নি।
তবু যেন বিশ্বাস হয়নি তাদের। ভীষণ অবিশ্বাস্য কণ্ঠে বলল, তুমি বাইরে যাওনি?
না, আমার পেটে ব্যথা ছিল, তাই বাসায় ঘুমিয়ে ছিলাম।
পেটে ব্যথা? ডায়রিয়া হয়েছিল? উদ্বিগ্ন কণ্ঠ ওপাশের নার্সের।
‘না।’ আমি তারে পাত্তা দিলাম না।
অফিসে যাও নাই?
না, বিরক্তি নিয়েই বললাম।
তোমার জ্বর, মাথাব্যথা, শরীরব্যথা, কিছু নেই?
না, আমি একদম সুস্থ। একটু বিরক্তই হচ্ছিলাম আমি মনে মনে।
ওরা মনে হলো নিশ্চিত হলো এবার।
খুব ভালো। বলে আরও কিছু কথা বলে ফোন রাখল।
এই হলো কানাডিয়ান স্বাস্থ্যব্যবস্থা। একজন কোভিড রোগী যেন অন্যদের ভাইরাসটি না দিতে পারে তা নিয়ে তারা যথেষ্ট সচেতন। করোনা পজিটিভ রোগীর কারও সঙ্গে সংস্পর্শে আসলে সঙ্গে সঙ্গে তাকে আইসোলেশনে যেতে হয়। মানে ১৪ দিনের ফের। বাসায় বন্দিত্ব। যদি কেউ না মানে তাহলে তাকে বিশাল টাকা জরিমানা দিতে হয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জরিমানা করার জন্য গোপন টহল পুলিশ থাকে। ঠাস করে ধরে ফেলবে কোনো দিন। টাকার মায়া বড় মায়া। জরিমানা দেওয়ার ভয়ে কেউ আইন ভঙ্গ করে না।
এভাবেই করোনা রোগটাকে কমিউনিটিতে সংক্রমিত না করার ব্যবস্থা করেছে কানাডা স্বাস্থ্যব্যবস্থা। আমরা দুজন এ ভেবে খুশি হলাম, অন্তত আমরা দুজন এই ভয়ংকর ভাইরাসকে অন্য কারও শরীরে ছড়াইনি। আমাদের হয়তো কেউ না বুঝেই দিয়েছে বা কোনোভাবে পেয়েছি। এ ক্ষেত্রে অসহায় আমরা। শুধু আল্লাহকে ডাকা ছাড়া কোনো গতি নেই।
এদিকে স্বাস্থ্যকর্মীদের জেরা অন্যদিকে আত্মীয়স্বজনের ফোন ‘কেমন আছ?’ সবাই উদ্বিগ্ন জানি, কিন্তু আমরা দুজনেই ক্লান্ত করোনাযুদ্ধে। আমি রোগীর সেবা করার চেয়েও দুশ্চিন্তায় পরিশ্রান্ত হলাম বেশি।
তারপরও ফোনের পর ফোন বেজে চলত। সবাই উদ্গ্রীব এজাজকে নিয়ে, তার আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব এবং কাছের মানুষ। এজাজ ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়ল, কথা বলার শক্তি নেই। এদিকে বলতেও পারি না, ‘প্লিজ, ফোন দেবেন না।’
ফেসবুকে কোভিড হয়েছে, এই নিয়ে স্ট্যাটাস দেব না ঠিক করলাম। কেন জানি আমার প্রোফাইলে বিয়ের পরদিন তোলা পুরোনো একটা ছবি পোস্ট করলাম। প্রোফাইলের ছবি বদলাতে বদলাতে মনে হলো এমন তো হবে না, হয়তো এই ছবিটাই শেষ ছবি হয়ে রয়ে যাবে আমার ফেসবুকের প্রোফাইলের পাতায়। অসুখ-বিসুখ হলে মানুষের মনে প্রচুর নেগেটিভ চিন্তা আসে। আর কোভিড–১৯ হলো স্বয়ং মৃত্যুদেবতা।
আমিও ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন দেখে মাঝরাতে ঘুম ভেঙে চিৎকার করে উঠলাম। দৌড়ে ছুটে গেলাম পাশের রুমে। এজাজ সাদা চাদর গায়ে দিয়ে নিশ্চল শুয়ে আছে। আমি পাথরের মতো ভারী অবশ পায়ে এগিয়ে গিয়ে চাদরটা এক টানে সরিয়ে ফেললাম। মনে হলো এজাজ শ্বাস নিচ্ছে না। আমি মাথা ঘুরিয়ে ওখানেই কার্পেটের ওপর বসে পড়লাম। চলবে...