থমকে যাওয়া জীবন, মৃত্যুর আলিঙ্গনে-১৮

লেখক

এত করোনা নিয়ে লেখালেখি, করোনা নিয়ে এত গবেষণা করলাম, সে যদি একটু আমার সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাৎ না করে, তাহলে হয়? করোনার ব্রেন না থাকলে কী হবে, সে হচ্ছে বোবা এক চতুর ভাইরাস, যার কোনো মমত্ব নেই, ভালোবাসা নেই, এমনকি কোনো অনুশোচনাও নেই। যার শরীরটা যত দুর্বল, তার শরীরটাই তার পছন্দ। সে হিসেবে আমি মোটামুটি দুর্বলের পর্যায়েই পড়ি। অনেক ধরনের অসুখের অল্পস্বল্প ভার্সন আমার শরীরে মোটামুটি ঘোরাঘুরি করে। এ যখন অবস্থা, তখন করোনা এমন সুযোগ্য রোগীকে ধরবে না, এত বোকা তো সে নয়। তাই শেষ সময়ে এজাজের হাত ধরে সে আমার বাড়ি এল।

তবে আমি সব সময় কোভিডসংক্রান্ত হেলথ অথরিটির সব ধরনের নিয়মনীতি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছি। অপ্রয়োজন বাসার বাইরে যাই না, দোকানপাটে যাই না। আমাকে ধরা কোভিড বেচারার জন্য কষ্টই। আর বাসায়ও মোটামুটি পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতা অভিযান কম করি না। কিন্তু তারপরও ঘরে সে ঢুকেই পড়ল।

শুরুটা হয়েছিল কাশি দিয়ে। আমার ঘরের মানুষ এজাজই প্রথম নিয়ে এল এই মহাপ্রলয়ংকারী মেহমানটিকে, কোভিড–১৯। সে এসেই এজাজকে কাবু করে ফেলল। অল্প কাশি দিয়েই শুরু। কাশি আর অল্প জ্বর নিয়ে এজাজ রোদেলার রুমে নির্বাসন নিল।

করোনা ভাইরাস
ছবি: রয়টার্স

শহরের শেষ প্রান্তে একটা টিলার মতো ঢালের পাশে কোনার বাড়িটা আমাদের। এসব দেশে বাড়িগুলোর সামনে–পেছনে অনেকখানি খালি জায়গা থাকে। যেখান দিয়ে প্রচুর আলো-বাতাস আসতে পারে। বাড়িগুলো চারকোনা বক্সের মতো। প্রতিটি বাড়িতেই ওপর-নিচ মিলিয়ে চার-পাঁচটা রুম থাকে। এ বাড়ির ওপর তলায় তিনটা বেডরুম পাশাপাশি। একটাতে আমরা থাকি, অন্যটা আমার কন্যা রোদেলার রুম। সে অটোয়ায় থাকে। তার রুম তার পছন্দমতোই সাজানো। যখন সে আসে, তখন তার সাজানো–গোছানো রুমেই সে থাকে। আমরা সেটি ব্যবহার করি না। পাশের রুমটি এজাজের অফিস রুম। এজাজ সেই দুই রুমেই বসতি গাড়ল। সারা দিন পড়ার রুমে শোফায় শুয়ে থাকে, রাতে ঘুমায় রোদেলার রুমে। দুজন মানুষই আমরা, কিন্তু আলাদা রুম, আলাদা বাথরুম; মুখ দেখাদেখি নেই। প্রয়োজন হলে আমরা ফোনে কথা বলি। কখনো দরজা ফাঁক করে উকি দিলেই চেঁচিয়ে ওঠে সে, ‘কত ছোঁয়াচে রোগ জানো? একবার হলে কী যে হবে তোমার, একদম ঢুকবে না রুমে।’

আমার প্রতি ওর দায়িত্ববোধ থেকেই সে হয়তো এমন করে, তবু আমি মন খারাপ করি। ঘরের দরজার সামনে খাবারের ট্রে রাখলে সে ভেতরে নিয়ে খায়। রান্নাঘরের দায়িত্ব আমার। এটা একদিক দিয়ে ভালো, রান্নাঘর নিপাট পরিষ্কার। আমার শুধু একার রান্নাঘর এই প্রথম পেলাম। কানাডার মতো দেশে গৃহকর্মী রাখা ভীষণ ব্যয়সাধ্য। সে কারণে স্বামীদের ঘরের সাহায্যকারী বানাতে হয়। তারাই ঘরের কাজে, রান্নাবান্নায় সাহায্য করে। এজাজ এ বিষয়ে ভীষণ সচেতন ও দায়িত্ববান। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, ঝকঝকে রান্নাঘর চাইলে পুরুষদের রান্নাঘরে না ঢোকানোই উত্তম। তবে একা কাজ করতে গিয়ে আমার বিধ্বস্ত অবস্থা, তার খাবার সাপ্লায়ার হিসেবে। কিছুক্ষণ পরপর সে ফোন দেয়, ‘এই শোন, কিছু একটা দাও, খিদা লেগেছে।’ আমি অবাক হয়ে বলি, ‘ওমা, এইমাত্র না খেলে। এক ঘণ্টাও তো হয়নি।’ সে লজ্জিত হয়ে বলে, ‘ও তাই তো, একটু বিস্কুট দাও।’ আমি ভীষণ খারাপ বোধ করি।

ফাইল ছবি

অন্যের সেবা আশা করার লোক এজাজ নয়। এই প্রথম তার জন্য আমাকে এত অস্থির হতে হচ্ছে। আমি তাড়াতাড়ি বাতাবিলেবু কেটে তার রুমের দরজার সামনে রাখি। এখানে কোভিড টেস্টের রেজাল্ট আসবে ৪৮ ঘণ্টা পর। তখনো আমরা তার কোভিড টেস্টের রেজাল্ট পাইনি। দুই দিন নির্বাসনের মধ্যে সে যুদ্ধ করে যত রকম টোটকা আছে খেয়ে মোটামুটি সুস্থ হয়ে গেল। কোভিডের রেজাল্ট এখনো আসেনি, ৭২ ঘণ্টা পার হয়ে গেছে। দেরি হওয়া মানেই রেজাল্ট নেগেটিভ। অতএব স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। আমরা ফোনে কথোপকথন করি। আমি এপাশ থেকে বলি, ‘যাক বাবা, আর যা–ই হোক করোনা নয়।’ ‘হ্যাঁ তা–ই তো মনে হয়।’ এজাজের কণ্ঠে বেশ খুশি ছড়িয়ে পড়ে। আমি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলি। করোনা হয়নি, এর চেয়ে স্বস্তির আর কি কিছু আছে এই মুহূর্তে! বিধাতা মনে হয় তখন মুচকি হাসছিলেন। আমি তখনো বিছানায়, মাত্র ভোর হয়েছে। পর্দার ফাঁক দিয়ে সুয্যিমামা উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে।

স্বপরিবারে লেখক

এজাজের আওয়াজ পেলাম পাশের বাথরুম থেকে। এজাজ ফুরফুরে মনে তৈরি হচ্ছে। আমার রুমে তার কম্বল, বালিশ চলে এল। কোনার চেয়ারে বসে চা–ও পান করল। এমনি সময়ে ফোন করল রোদেলা, ‘বাবা, তোমার করোনা পজিটিভ রেজাল্ট এসেছে।’ ‘কী বললে?’ হঠাৎ যেন বিশাল এক ভূমিকম্পের মতো ধাক্কা লাগল বাসাজুড়ে। এজাজ চুপ মেরে থাকল কিছুক্ষণ, ‘কী বলো? পজিটিভ আসছে। আমি তো অফিসে যাচ্ছিলাম।’ ‘না বাবা বের হইয়ো না, তোমাকে বাসায় আইসোলেশনে থাকতে হবে ১৪ দিন।’ এজাজ বিষণ্ন মনে ওখানেই সোফায় বসে পড়ল। আমিও পাশের রুমে বিছানায় আধশোয়া অবস্থায় বাঁ পাশের বুকে ব্যথা অনুভব করতে থাকলাম, সঙ্গে যেন গা–টাও গরম একটু। করোনা হওয়ার আগেই আমি মানসিকভাবে ভেঙে পড়লাম। চারদিকে মৃত্যুর সারিতে হয়তো আরও কিছু নাম যুক্ত হবে। তারপর মনে হলো, যা থাকে কপালে, মরলে মরব। রকি পাহাড়ের পাথরের মতো শক্ত মন নিয়ে নিজের ঘরে বসে আছি। আসলে মৃত্যুদূত সামনে চলে এলে মানুষ বোধহীন হয়ে যায়। আমার তা–ই হলো, আমি অনুভূতিহীন হয়ে বসে থাকলাম। চলবে...

আরও পড়ুন