থমকে যাওয়া জীবন, মৃত্যুর আলিঙ্গনে–১৭

বোনের সঙ্গে লেখক
ছবি: সংগৃহীত

ভীষণ রকম অস্থিরতার আমাদের সময় যায়। মাঝেমধ্যে মনে হয়, দম বন্ধ হয়ে মরে যাব। যদি কখনো বাড়ির পেছনের কাঠের ডেকটাতে একটু বসি, তখনই যেন একটু বেঁচে থাকার মতো অক্সিজেন নিতে পারি। নীল বেনারসির মতো বিশাল নীল আকাশের নিচে কাঠের চারকোনা ডেকে বসলে প্রকৃতিকে ভীষণ রকমভাবে অনুভব করা যায়। এক কাপ চা নিয়ে যখন রংচটা গদিটায় বসে যখন গ্রিন টিতে চুমুক দিচ্ছিলাম, তখনই এজাজ এল।

সে এসে বসল আমার ঠিক পাশের চেয়ারটায়। বৃদ্ধ মানুষের দায়িত্ব নিয়ে, তাদের দেখাশোনা করে সে নিজেও বিপর্যস্ত কিছুটা।

‘কবে যে এ অবস্থার শেষ হবে, কে জানে?’ সে বিড়বিড় করে। আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। লোকটা যেন হঠাৎ করেই বুড়ো হয়ে গেছে। কপালে ভাঁজ পড়েছে। মাথার চুল পাতলা হয়ে যাচ্ছে। কী এক প্রবল মায়ায় আমি তার হাতটি ছুঁয়ে দিলাম। সে আমার দিকে তাকাল। মুখে মৃদু হাসি, সে হাসি কী ভীষণ ক্লান্তিকর আর ম্লান।
আমি তার হাতে আলতো চাপ দিলাম। সে বলল, ‘চলো, কোথায়ও যাই। একটু ঘুরে আসি।’

‘এই করোনায়?’
‘হোটেলে তো থাকা যাবে না। চলো, একটু জঙ্গল থেকে ঘুরে আসি।’
‘চলো যাই,’ বলে আমি চেয়ে থাকি দূরের টিলার দিকে। সবে সন্ধ্যা নেমেছে। রাস্তার নিয়ন বাতিটা খুব নীরবেই জ্বলে উঠল। এ নিমগ্ন সন্ধ্যায় আমি ডুবে গেলাম অসীম ভাবনায়। বন, গাছগাছালি, বন্য প্রাণী ধ্বংস করে এই যে মানুষ ভয়ংকর ভাইরাসের জন্ম দিল, তার কাছ থেকে মুক্তি পেতে কিংবা শ্বাস নিতে আবার অরণ্যেই ফিরে যাওয়া যায়। এখন শুধু বনবাদাড়েই করোনা নেই। মানুষের তৈরি লোকালয়ে করোনা হাঁ করে বসে আছে, মানুষের হার্ট, লিভার আর মগজ ছিদ্র করার জন্য।

এই করোনা মহামারিতে এ রকম ক্যাম্পেইনে যাওয়া কতটা যুক্তিযুক্ত, সে নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। আসলে জীবনে এমন সময়ও আসে, যখন মানুষ যুক্তিতর্কের বাইরে চলে যায়। এখন সেই সময়। ঘরে সবাই দম বন্ধ হয়ে অস্থির সময় পার করছেন। একটু প্রকৃতির আলো, হাওয়ায় শ্বাস নিতে যেন প্রাণ ছুটে যায়। সে রকমই শুধু একটু শ্বাস নেওয়ার জন্য আমরা বেরিয়ে পড়লাম গ্রিন ওয়াটার প্রভিনশিয়াল পার্কে। এখানে সংরক্ষিত বন এলাকাকে বলে প্রভিনশিয়াল পার্ক। এসব পার্কে ঢুকতে হয় টিকিট কেটে। আবার ক্যাম্প গ্রাউন্ডের জন্যও আলাদা বুকিং দিতে হয়।

নীল আকাশে উড়ে বেড়ায় মেঘবালিকারা। নিচে ঘন সবুজ বন। বনের ভেতর হরিণ–ভালুক ঘুরে বেড়ায় মনের আনন্দে। এ বনেই বসতি গড়লাম দুই দিনের জন্য। এ দেশে বলে ক্যাম্পেইন। তাঁবু খাটিয়ে, কাঁথা–বালিশ নিয়ে জঙ্গলে ঘুমানো। এ এক অন্য রকম জীবন। ঠিক যেন ফিরে যাওয়া সেই ইতিহাসের পাতায়, মানবজাতির গুহাবাসের সময়।
দুই দিন থেকেই আয়োজন চলছিল ক্যাম্পেইনে যাওয়ার। হাঁড়ি-পাতিল, নুন, তেল সবকিছু বোঁচকা বেঁধে যেতে হয়। ওখানে থাকার জন্য শুধু একচিলতে মাটি দেওয়া হবে। সেই মাটিতে তাঁবু খাটিয়ে তিন দিন থাকা। বিদ্যুতের লাইন আছে কিন্তু আগুন জ্বালিয়ে রান্নাবান্না করে হাঁড়ি–পাতিল ধুয়ে পরের বেলার জন্য তৈরি হতে হবে। এখানে ফ্রিজ নেই, গ্যাস বার্নার নেই, এসি নেই, আরামদায়ক বিছানা নেই। এমনকি টাইলস দেওয়া আধুনিক বাথরুমও নেই।

ক্যাম্পেইন। তাঁবু খাটিয়ে, কাঁথা–বালিশ নিয়ে জঙ্গলে ঘুমানো
ছবি: লেখক

দূরে জঙ্গলে অবশ্য চমৎকার একটা বাথরুম আছে। টর্চলাইট জ্বালিয়ে সেখানে যেতে হয় ইট বিছানো রাস্তা ধরে। আধুনিক নাগরিকের জন্য মন্দের ভালো এই বাথরুম।
পার্কে পৌঁছাতে পৌঁছাতে দুপুর, সবুজ বনের পাতার ফাঁকে তপ্ত আলো উঁকিঝুঁকি মারছে। প্রথমেই খাটাতে হলো তাঁবু। মাটিতে গড়া হলো নিচ্ছিদ্র থাকার ঘর। সেই ঘরে পাম্প দিয়ে ফুলানো হলো রাবারের বিছানা। সঙ্গে আনা চাদর-বালিশ দিয়ে সাজানো হলো বিছানা। তাঁবুর আবার দরজা–জানালা আছে, যা আবার মশারির কাপড় দিয়ে তৈরি। জিপার খুললেই দরজা দিয়ে ঢোকা যায় ভেতরে। এরপর আবার জিপার বন্ধ করে দিলেই একটি কাপড়ের গুহার ভেতর শুয়েবসে বন্য বাতাসের লিলুয়া সংগীত শুনতে শুনতে ফিরে যাওয়া যায় অচিন স্বপ্নে।

বাঙালি খাওয়াদাওয়া ছাড়া কিছু বোঝে না। জঙ্গলে গিয়েও তাই দুপুরে পোলাও রান্না করে খাওয়া হলো। লাকড়ির চুলায় রান্না করা সেই খাবার ছিল অমৃতসম। লেকের পাড়েই ক্যাম্প গ্রাউন্ড। ঠিক হলো এরপর স্পিডবোট ভাড়া করে লেকটা ঘুরে দেখা হবে। লেকের নীল পানিতে দুই ঘণ্টার আনন্দ ভ্রমণ যেন প্রকৃতির আরও কাছাকাছি চলে যাওয়া। বিশাল আকাশ আর নীল লেকের টলটলে পানিতে মাছ মারারও চেষ্টা করা হলো। বাচ্চাদের সঙ্গে বড়রাও ছিল আনন্দে আপ্লুত। শুধু কি আনন্দই ছিল, আত্মোপলব্ধিও।

রাতের আলো-আঁধারিতে ছিল বারবিকিউ। টুকরা কাঠে আগুন জ্বালিয়ে গোল করে চেয়ার পেতে বসে পোড়া মাংসের সুঘ্রাণ নিতে নিতে আবারও যেন ইতিহাসের পাতা ওলটাই। সেই যে আদিম মানুষ জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াত দল বদ্ধ হয়ে। রাতে কোনো গুহায় আগুন জ্বালিয়ে শিকার পুড়িয়ে আহার সারত। তারপর সেখানে ঘুম। দলবদ্ধ হয়ে থাকার সুবিধা তখন মানুষের জন্য বিশাল আশীর্বাদ ছিল। সবাই মিলে সবকিছু শেয়ার করার উপলব্ধিই ছিল তখন মূলমন্ত্র। নিশ্চয় সেই মানুষেরা অনেক বেশি আনন্দময় সরল জীবন যাপন করত। অল্প সম্পদেই সবাই সুখী, সবার সুখে-দুঃখে জড়িয়ে আছে সবাই। অনেক সুন্দর ও সরল সম্পর্ক।

লেখক
ছবি: সংগৃহীত

তারপর একসময় মানুষ বীজ বুনে চাষাবাদ শুরু করল, তারপরই শুরু হলো স্বার্থপরতা। মানুষের আমিত্ব, সম্পদের লোভ, স্বার্থপরতার এই পৃথিবীর তখন থেকেই শুরু। সেই শুরু থেকে আজ শেষে এই ভয়াবহ করোনাকাল। যখন থেকে স্বার্থপর মানুষের স্বার্থপরতার শুরু, তখন থেকেই প্রকৃতিরও ধ্বংস শুরু। মানুষ যত স্বার্থপর আর লোভী হচ্ছিল, প্রকৃতিও এরপর তার প্রতিশোধ নিল নির্বিচার। কে ধনী আর কে গরিব, সে হিসাব না করে নিজের মতো করেই সে তুলে নিয়ে গেল তার কাছে অবাঞ্ছিত কিছু মানুষকে। আর এখনো সে তার ভয়াবহ থাবা গুটিয়ে নেয়নি।

আমরা সবাই দলবদ্ধ হয়ে খেয়েদেয়ে খাবার গুছিয়ে ঘুমুতে গেলাম। ফোলানো বিছানায় শুয়ে এজাজ ১০ মিনিটেই ঘুমে কাত। কিন্তু সেই ছোট্ট কাপড়ের ঘরে আমার ঘুম এল না। আমি বই খুলে ব্যাটারিচালিত আলোয় বই পড়ার চেষ্টা করলাম। তখনই শুরু হলো সেই অদ্ভুত শিহরণ জাগানো শব্দ। শোঁ শোঁ শব্দে নড়তে থাকল আমাদের পলকা ঘর। ওপরে গাছের পাতাগুলো ভীষণ সুরে কী এক ভয়ংকর সংগীতে মগ্ন। আমার ওপর কেমন এক ভয়জাগানিয়া ভালো লাগা ভর করল। আমি ঠেলেঠুলে ঘুম থেকে জাগালাম এজাজকে। সে আধো ঘুম, আধো জাগরণে বলল, ‘কি, ভয় পাচ্ছ?’
‘না...হ্যাঁ, একটু পাচ্ছি। শোনো মনোযোগ দিয়ে।’ সে চুপ করে থাকল কিছুক্ষণ।

পাতার শব্দ। ঝড় হচ্ছে। অনেক বছর পর পাতার শব্দ শুনতে পাচ্ছি। দারুণ লাগছে।
‘হ্যাঁ, আমারও ভীষণ ভালো লাগছে। কেমন অদ্ভুত এই শব্দ।’

আমরা দুজন মধ্যবয়সী নরনারী গভীর রাত পর্যন্ত ছোট্ট একটা তাঁবুর ভেতর সেই পাতার শব্দ, বিদ্যুৎ চমকানোর ঝিলিক আর বৃষ্টির ঝরঝর মুখরতার মধ্যে অনেক রাত পর্যন্ত জেগে রইলাম। আমরা প্রবাসে থেকে বারবার শৈশবে ফিরে যাই, আজও সুযোগ হলো সেই সময়ে ফেরার।

সকালে বৃষ্টি কিছু কমে এলে হাঁটতে বেরিয়েছিলাম। বনের ভেতর দিয়ে ট্রেইল, হাঁটার রাস্তা। বুনো ফুলের ছড়াছড়িতে সবুজ বন যেন ফুলের মেলায় সেজেছে। সকালের শিশির পড়ে ঘাসের গোড়ায় টলটলে মুক্তার বিন্দু। বেশ ঠান্ডা লাগছিল। বনের রাস্তা ধরে হেঁটে হেঁটে অনেকক্ষণ শিশিরে সিক্ত হলাম। এ সিক্ত ভোরে মনের সব কালিমা–বিদ্বেষ ধুলায় লুটিয়ে ভীষণ পবিত্রতায় আচ্ছন্ন করে মন।

বৃষ্টিভেজা দুপুরে খিচুড়ি, ডিমভাজা ছিল সবচেয়ে মজার। ছাতা ধরে রান্না, কাটাকাটি একসঙ্গে সময় কাটানো—সবকিছুই ছিল ভীষণ আনন্দময়। বিকেলে লেকের পানিতে লুটোপুটি, সাঁতার কাটা, নৌকা ভ্রমণ—সবকিছু মিলিয়ে এক অন্য জগতে সময় কাটিয়ে ফিরে আসা আবার বাস্তব পৃথিবীতে। যেখানে করোনা কেড়ে নিচ্ছে আমাদের কাছের মানুষকে, টিকা নিয়ে রাজনীতি, বুভুক্ষু মানুষের কান্না। আবার ফিরে এলাম এই যন্ত্র, ধোঁয়া, ইটপাথরের স্বপ্নভাঙা পৃথিবীতে। এই ইটপাথরে গড়া শহরে কি আবার ফিরে পাব প্রকৃতির শান্ত মৌনতা? নিস্তব্ধতা ভেঙে পাখির কিচিরমিচিরে ঘুম ভেঙে গাছের ফোকর গলে দেখা ছিটকে পড়া সূর্যের সোনালি বিচ্ছুরণ? সেই সোনালি আলোয় পৃথিবী আবার ঝলমলে আনন্দে ভাসতে পারত। ভাসবে কি? চলবে...