তাইপের চিঠি-৩
আমাদের ছোট বাংলাদেশি দলটি এই মুহূর্তে আছে তারোকো ন্যাশনাল পার্কের পথে। ঘুরে বেড়াচ্ছি সংকীর্ণ গিরিখাতের পাশ ধরে। যদিও আমাদের এ ভ্রমণ শুরু হওয়ার কথা ছিল বেলা ১১টায়। কিন্তু তা পারিনি। যখন লিয়ো নদীর পাশ দিয়ে যাত্রা আরম্ভ করেছি, তখন ঘড়ির কাঁটা একটা ছাড়িয়েছে। দেরি হওয়ার পেছনের একটি কারণ আমাদের ভুল রাস্তায় চলে যাওয়া। এ ছাড়া আরও একটি কারণ জড়িত। তারোকোর সবচেয়ে নিকটতম শহর হুয়ালিয়ান। দ্বীপটির পূর্ব উপকূলের হুয়ালিয়ান শহরের সঙ্গে পশ্চিম উপকূলের আড়াআড়িভাবে যোগাযোগের কোনো রাস্তা নেই। সে জন্য এখানে আসতে হয় একটু উত্তর অথবা দক্ষিণ পাশ ঘুরে, যা বেশ সময়সাপেক্ষ। কেউ যদি তারোকোতে বেড়াতে না আসে, তাহলে এটা বুঝতে পারবে না।
প্রকৃতপক্ষে তাইওয়ানের মূল পর্বতশ্রেণি দ্বীপের মাঝবরাবর উত্তর থেকে দক্ষিণে বিস্তৃত। এর ফলে বিশালাকার পর্বতমালা ডিঙিয়ে জনবসতিপূর্ণ পশ্চিম উপকূল থেকে এর পূর্ব উপকূলে সহজে প্রবেশাধিকার নেই। বর্তমানে যে মহাসড়ক আছে, তা এ মূল পর্বতশ্রেণি এড়িয়ে তৈরি করা হয়েছে। এর বেশির ভাগ অংশ গেছে সমুদ্রের পাশ ধরে। তা সত্ত্বেও কিছু দূর পরপর তৈরি করতে হয়েছে বিশাল সব পর্বতের ভেতর দিয়ে অসংখ্য টানেল। যদিও এসব কারণেই রাস্তাগুলো হয়েছে খুবই আকর্ষণীয়।
তারোকোতে প্রবেশের পর আমাদের গাড়ি যখন গিরিখাতের পাশ ধরে চলছে, সবার চোখ তখন প্রায় স্থির। প্রকৃতি যেন দুহাত ভরে তার রূপের পসরা সাজিয়ে বসেছে। কী নেই এখানে! মেঘ ফুঁড়ে বেরিয়ে যাওয়া বিশাল সব পাথুরে পর্বত, পর্বতের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া স্বচ্ছ জলের শান্ত নদী। আরও রয়েছে ভয়ংকর গিরিখাত। আমরা সচরাচর যেমন দেখি পাহাড় বা পর্বত একটু ঢালু হয়ে ধীরে ধীরে খাড়া হয়ে যায়, কিন্তু এখানে ব্যতিক্রম। সারিবদ্ধ অবস্থায় একের পর এক পর্বত। এগুলো দেখে মনে হবে খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কোনোরূপ ঢালু হওয়ার বালাই নেই এখানে। তাইওয়ান ভ্রমণবিষয়ক গল্পে একটা কথা বেশ প্রচলিত আছে। তা হলো, তারোকো ভ্রমণ না করলে তাইওয়ান ভ্রমণ পূর্ণ হয় না। প্রথমে ভেবেছিলাম, এটা হয়তো নিছক কথার কথা। কিন্তু এখানে আসার পর এই কথার মর্মার্থ খুব ভালো করে বুঝতে পারলাম। সত্যি বলতে কী, তারোকো প্রবেশের পর থেকে আমাদের চোখে যা দেখছি, তাকে এককথায় বলা যায় ভয়ংকর সুন্দর। চারপাশের অপরূপ সুন্দর প্রকৃতি। তার সঙ্গে একটা চাপা গুমোট ভাব। দেখে মনে হয়, চারপাশের আকাশছোঁয়া পাহাড়গুলো যেন দুঃসাহসিক অভিযানের জন্য সবাইকে ডাকছে।
একা কেউ এখানে ঘুরতে আসলে নির্ঘাত মনের ভেতর একটা আতঙ্ক চেপে বসবে। কিছুদিন আগে যখন এ বেড়ানো নিয়ে প্ল্যান করছিলাম, তখনকার একটা ঘটনা মনে করে একা একাই হেসে দিলাম। তাইওয়ানে মাত্র কয়েকটি বাংলাদেশি পরিবার রয়েছে। তাদের ভেতর বেশির ভাগের স্ত্রী হলো স্থানীয় তাইওয়ানিজ মেয়ে। শুধু মোস্তাফিজ হোসেন ভাই ব্যতিক্রম। সব বাংলাদেশি মিলে একসঙ্গে ঘুরতে যাচ্ছি। তাই বললাম, চৈতি ভাবিকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু তার এককথা—একাই যাবে। একপর্যায়ে বাধ্য হয়ে বলল, ‘আমার স্ত্রী পাহাড়ের ওই রাস্তা খুব ভয় পায়। একবার গিয়েছিল। তারপর আর কোনো দিন যেতে রাজি হয়নি।’
আসলেই আমরা এখন যেসব রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি, তা অত্যন্ত বিপজ্জনক। বিশাল সব খাড়া পর্বতের পাশ কেটে বানানো হয়েছে। অনেকটা টানেলের মতো করে। একে অবশ্য টানেল না বলে সুড়ঙ্গ বললেই যথার্থ হবে। বেশির ভাগ সময় তিন দিকে পাথর আর এক পাশ খোলা। এই খোলা পাশে ভয়ংকর গভীর গিরিখাত। যার নিচ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে লিয়ো নদীর স্বচ্ছ জলধারা। এভাবেই চলে গেছে মাইলের পর মাইল। এখান থেকে পাশের খাদের দিকে তাকালে খুব সাহসী মানুষের মনের ভেতরও ভয় ঢুকে যাবে। একবার সাহস করে তাকালাম। একটু এদিক–সেদিক হলেই গাড়ি চলে যাবে কয়েক শ ফুট নিচের লিয়ো নদীতে। একবার তাকানোর পর সারা শরীরের লোম দাঁড় করিয়ে অ্যাড্রেনালিন হরমোন তার অস্তিত্ব জানান দিয়ে গেল।
এ প্রসঙ্গে একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। ছয় থেকে সাত বছর আগের কথা। নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু থেকে যাচ্ছিলাম নাগরকোট। সেখান থেকে এভারেস্ট খুব ভালোভাবে দেখা যায়। জায়গাটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় সাত হাজার ফুট উচ্চতায়। আমাদের বহনকারী ছোট ট্যুরিস্ট বাসটি যখন পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে ওপরে উঠতে শুরু করল, তখন জানালার পাশে বসা এক স্বদেশি ভদ্রলোক বেঁকে বসলেন। তিনি কিছুতেই আর ওপরে যাবেন না। গোঁ ধরে বসে রইলেন। তাঁকে নিয়ে বাস ফেরত যেতে হবে। ঘুরতে যাওয়া বাকি যাত্রীরা তা মানবে কেন। এ নিয়ে তুমুল বাগ্বিতণ্ডা। একপর্যায়ে ভদ্রলোক হার মানলেন। তবে ওই হার মানা ছিল একটা শর্তের বিনিময়ে। শর্তটি ছিল, যে পাশে পাহাড়ের খাদ, ওই পাশের জানালার পর্দা আর খোলা যাবে না। বাধ্য হয়ে যাত্রার বাকিটা সময় তাঁর শিশুতোষ আবদার সবাইকে হজম করতে হয়েছিল। এবার অবশ্য আমাদের এ রকম কিছু হজম করতে হয়নি। তবে একটা পরিকল্পনায় রাশ টানতে হয়েছে। তারোকো ন্যাশনাল পার্ক মূলত খোলা বাইকে করে পাহাড়ি রাস্তায় ঘুরে বেড়ানোর জন্য বেশি জনপ্রিয়। বেশির ভাগ ভ্রমণপিপাসু এখানে আসার পর মোটরসাইকেল অথবা বাইসাইকেল নিয়ে চলে যান পাহাড়ের দিকে। অনেকটা গা ছমছম করা অভিযান। চারপাশের পাথরের গুহা দিয়ে যাওয়ার সময় অন্য রকম একটা অনুভূতি তৈরি হয়। এ জন্য ছোট আকারের মোটরসাইকেল ভাড়ায় পাওয়া যায়। কিন্তু আমাদের গ্রুপের এক সদস্য আগেই বেঁকে বসল। সে আগেও একবার এসেছিল। তার আগেরবারের অভিজ্ঞায় সে জানাল। এখানে প্রতিনিয়ত ওপর থেকে পাথর ধসে পড়ে। পাথর অনেক সময় ছোট আকারের হলেও তা বিপজ্জনক হয়ে যায়। অনিচ্ছা সত্ত্বেও মেনে নিলাম তার কথা। তবে মনের ভেতর অভিযানের একটু অপূর্ণতা রয়েই গেল।
সত্যি বলতে কী, গাড়িতে করে যাওয়ার কারণে বেশির ভাগ সৌন্দর্য আমাদের দেখা হলো না। তবে একদিক থেকে আমরা বেশ ভাগ্যবান। এই পার্বত্য রাস্তায় আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে হুলিয়ানের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণারত নাজমুল ইসলাম আর তাইওয়ানের বিখ্যাত সেমিকন্ডাক্টর তৈরিকারী প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ইঞ্জিনিয়ার সায়েম বিন কুতুব। তাদের দুজনের কাছেই তারোকো বেশ পরিচিত একটি জায়গা।
আমরা প্রথমেই গেলাম এটারনাল স্প্রিং শ্রাইন দেখতে। যাকে বাংলায় বলা যায় চিরন্তন ঝরনার মাজার। এ দর্শনীয় স্থানটি তারোকো ন্যাশনাল পার্কের ঠিক ৭০০ মিটার ভেতরে অবস্থিত। বিশাল একটি খাড়া পর্বতের কোল ঘেঁষে এর অবস্থান। দূর থেকে দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়। পাশাপাশি দুটি বুদ্ধা টেম্পল, যা একটি হালকা ধনুকের মতো বাঁকানো সেতু দিয়ে যুক্ত। নান্দনিক চায়নিজ কারুকাজ। তবে অন্য সব চায়নিজ টেম্পল থেকে এটি একটু আলাদা। আমি দেখেছি তাইওয়ানের প্রায় সব ধর্মীয় স্থাপনায় লাল রঙের সঙ্গে সোনালি রঙের কারুকাজকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। তবে এখানে লাল রঙের ব্যবহার তেমন করা হয়নি। তার চেয়ে বরং সাদার সঙ্গে সোনালি রং ব্যবহারকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। সাদা রঙের কারণে দূর থেকে দেখলে অন্য রকম অপার্থিব একটা আবেশ তৈরি হয়। এই স্থাপনার সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক ব্যাপার হলো সেতুর নিচ দিয়ে ঝরে পড়া স্বচ্ছ ঝরনার পানি। সম্ভবত বিরামহীনভাবে ঝরে পড়া ঝরনার পানি থেকেই এর নামের প্রথমে যোগ হয়েছে এটারনাল শব্দটি। তবে যে কারণেই হোক না কেন, এর নামকরণ একদম সার্থক হয়েছে। প্রথম দেখাতেই যে কারও চোখ আটকে যাবে কিছু মুহূর্তের জন্য। দূর থেকে দেখার পর এবার সবাই চললাম চিরন্তন ঝরনার দিকে। সেখানে যাওয়ার জন্য মূল রাস্তা থেকে পর্বতের সুড়ঙ্গ দিয়ে একটু ভেতরের দিকে যেতে হয়।
যাওয়ার পথটি চারপাশ থেকে চুইয়ে পড়া পানির জন্য একটু স্যাঁতসেঁতে। হিমশীতল সুড়ঙ্গের ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় চোখে পড়ল একটি বড় গুহা। সেখানে কয়েকটি বুদ্ধমূর্তি রাখা আছে। বৈদ্যুতিক বাতির আলোতে সোনালি রং যেন আরও ঝকমক করছে। আরেকটু সামনে যাওয়ার পর হঠাৎ গড়গড় শব্দে শুনে তাকালাম। দেখি সুড়ঙ্গের ভেতর একটি গর্ত থেকে কলকল শব্দে পানি বেরিয়ে আসছে। বুঝতে পারলাম পাথরের এই স্থান থেকে আরও একটি ঝরনার উৎপত্তি হয়েছে। এটারনাল স্প্রিং শ্রাইনের কাছেই আরেকটি একটি নান্দনিক স্থাপনা আছে। ঠিক এর মাথার ওপরেই, যা খাড়া পর্বতের গা কেটে বানানো হয়েছে। সেখানে যাওয়ার একমাত্র রাস্তা হলো পর্বতের সুড়ঙ্গের ভেতর দিয়ে বানানো সিঁড়ি। এসব সিঁড়ি বেয়ে অনেকটা ওপরে উঠতে হবে দেখে আমাদের গ্রুপের বেশির ভাগ সদস্যই যাওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ দেখাল না। তাই এটারনাল স্প্রিং শ্রাইনে কিছুটা সময় কাটিয়ে সবাই মিলে চললাম নতুন গন্তব্যে।
আমরা এবার যাচ্ছি ‘টানেল অব নাইন ট্রান’ দেখতে। যার প্রকৃত নাম জিইয়ো কুডোং।
চাইনিজ উচ্চারণে অনেকটা এ রকমই শোনা যায়। নামে নাইন হলেও চায়নিজ ভাষায় এর মানে হলো একের অধিক বা অনেক। এটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৯০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। পুরো টানেলটির দৈর্ঘ্য ৭০০ মিটার। এই জায়গা একটু বিপজ্জনক।
এলোমেলো পাথর কেটে বানানো টানেল। চোখে পড়ল বিপদ নির্দেশিকা। লেখা রয়েছে, ‘রক ফল থেকে সাবধান।’ দেখে ভয় পেয়ে গেলাম। জাপানি উপনিবেশকালে গোল্ড মাইনিংয়ের জন্য এ টানেলগুলো বানানো হয়েছিল। সেটিও প্রায় ৮০ বছর আগের কথা। মজার ব্যাপার হলো, জাপানিদের তৈরি করা এ সরু রাস্তাই ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত তাইওয়ানের পূর্বের সঙ্গে পশ্চিম উপকূল সংযোগের প্রধান সংযোগ সড়ক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। জায়গাটি দেখতে খুবই ভয়ংকর মনে হলো প্রথম দেখায়। এবড়োখেবড়ো পাথর কেটে বানানো। দেখে মনে হয় মাথার ওপর বিশালাকৃতির পাথর ঝুলছে। যেকোনো সময় ভূমিকম্পে সোজা মাথার ওপর সজোরে আছড়ে পড়বে।
ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা হওয়ায় এই ভয় সারাক্ষণ তাড়া করে ফিরছিল। আমার ভয়টা অমূলক ছিল না। ভূমিকম্পের কারণে পাথরধস এখানে খুব সাধারণ ঘটনা। ঠিক এ কারণেই ছয় বছর এই রাস্তা বন্ধ ছিল। বছরখানেক আগে তা আবার খুলে দেওয়া হয়েছে পর্যটকদের জন্য। এই টানেলগুলোর কিছু অংশ আবার বাইরের দিকে উন্মুক্ত। সেখান দিয়ে নিচের লিয়ো নদীর দিকে তাকালাম। সঙ্গে সঙ্গে ভয় আর ভালো লাগা একসঙ্গে ছুঁয়ে গেল। অনেক নিচে একদম স্বচ্ছ সবুজ পানির জলধারা কলকল শব্দে বয়ে যাচ্ছে। সত্যি বলতে, ওপর থেকে নিচের গিরিখাতের মাঝে লিয়ো নদীর পানিকে জাদুকরি কিছু মনে হয়। এই জায়গায় গিরিখাতটি পাশাপাশি দুটো খাড়া পর্বতের মাঝখানে অবস্থিত। পর্বত দুটো এতটাই খাড়া, প্রথম দেখায় যে কারও মনে পর্বত দুটি একসঙ্গেই সংযুক্ত ছিল বহুকাল। তারপর কেউ একজন সোজা মাঝবরাবর কেটে দুই ভাগ করে দিয়েছে।
এখান থেকে বেরিয়ে আসার পর একটা পানির বাঁধ চোখে পড়ল। নদীর পানি এখানে গাঢ় আকাশি রং ধারণ করেছে। শীতকালে সিলেটের লালাখালের সারী নদীর পানিতে এ রং দেখতে পাওয়া। ঠিক একই রকম। এখান থেকে বেরিয়ে পাহাড়ের আরও ওপরের দিকে চললাম। এবারের গন্তব্য হাক্কা ভিলেজে। চারদিকে পর্বতঘেরা। মাঝখানে সবুজ উদ্যানের মতো সমতল ভূমি। এখানে রয়েছে কিছু রেস্টুরেন্ট আর রাত্রিযাপনের জন্য ঘর। সন্ধ্যার ঘনিয়ে আসার আগপর্যন্ত সময়টা এখানেই কাটালাম। দেখতে দেখতে অন্ধকার হয়ে আসতে লাগল। এবার আমাদের পাহাড়ি অঞ্চল থেকে বের হয়ে যাওয়ার পালা। অনিচ্ছা সত্ত্বেও চার-পাঁচ ঘণ্টার তারোকোর অভিযানের এখানেই ইতি টেনে রওনা দিলাম হোটেলের দিকে। এর অবস্থান তারোকো ন্যাশনাল পার্কের ঠিক প্রবেশমুখে। মজার ব্যাপার হলো, আমাদের হোটেলের নামটিও লিয়ো নদীর নামানুসারে।
সপ্তাহখানেক আগের কথা। আমরা অনলাইনে হোটেল খুঁজছিলাম। এ জন্য সবাই বসলাম ভিডিও কনফারেন্সে। আমরা চাচ্ছিলাম তারোকোর আশপাশে থাকার জন্য। তারোকো ইয়ুথ সেন্টার নামের একটা হোটেল পেলাম। গভীর পাহাড়ি এলাকায়। এটা দেখার পর সবাই একবাক্যে জানিয়ে দিলাম এখানেই থাকব। কিন্তু কোনোভাবেই ফাঁকা রুম পাওয়া গেল না। এমনকি তারোকোর আশপাশের কোনো হোটেল এই মুহূর্তে ফাঁকা পেলাম না। বুঝতে পারলাম, তিন দিনের ছুটি হওয়ায় এই মুহূর্তে তারোকোতে হোটেল ফাঁকা পাওয়া মোটামুটি অসম্ভব। আমরা সবাই হাল ছেড়ে ঘুমিয়ে গেলাম। কিন্তু ইঞ্জিনিয়ার আহমদ শিবলি ভাই লেগেই রইল। যেকোনোভাবেই হোক তারোকোতে হোটেল পেতেই হবে। মাঝরাতে মুঠোফোনের ভাইব্রেশনের শব্দে ঘুম ভাঙলে তাকিয়ে দেখি শিবলি ভাই। সে খুশিতে আত্মহারা। তারোকোর ঠিক প্রবেশপথেই হোটেল ম্যানেজ হয়েছে। নাম তারোকো লিয়ো হোস্টেল। তারোকো ন্যাশনাল পার্ক থেকে বেরিয়ে আমরা যখন হোটেলের সামনে এসে থামলাম, তখন গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হয়েছে।
কিন্তু তখনো একটা সমস্যা রয়েই গেল। রাতের খাবারের আয়োজন করতে হবে। আমাদের হোটেল হুয়ালিয়েন শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে হওয়ায় আশপাশে কোনো হালাল খাবারের রেস্টুরেন্ট নেই। পরবর্তী সময়ে একটি ইন্দোনেশিয়ান রেস্টুরেন্টের খোঁজ পাওয়া গেল। তবে এটিও প্রায় ২২ কিলোমিটার দূরে। আমাদের গ্রুপের সদস্য ইসমাইল ভাই ইন্দোনেশিয়ান ভাষায় খুব ভালোভাবেই কথা বলতে পারে। পরে জানলাম, তার ইন্দোনেশিয়ান স্ত্রীর সুবাদে সে এটি শিখে ফেলেছে। তাই এবার চললাম ২২ কিলোমিটার দূরে খাবারের খোঁজে। ব্যস্ত দিনের শেষে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বুঝতে পারিনি। হঠাৎ একসময় মনে হলো বিছানা কেঁপে উঠেছে। ভয় পেয়ে গেলাম। ছোটখাটো একটা ভূমিকম্প হয়ে গেল নাকি! আসলে তা ছিল না। তবু বুকের ভেতর হৃৎপিণ্ড বিপ বিপ করেই যাচ্ছে। আবার ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু ঘুম আসছে না। বাইরে প্রশান্ত মহাসাগরের দমকা বাতাস বইছে। মাঝরাতের হিমশীতল বাতাস। অন্ধকারে ঘড়ির রেডিয়াম আলোয় সময় দেখে নিলাম। এখন গভীর রাত। এবার ঘুমোতেই হবে। আগামীকাল সবাই মিলে যাচ্ছি প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে। সেখানে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে পাথুরে সমুদ্রসৈকত আর দিগন্তছোঁয়া নীল জলরাশি। চলবে...
*লেখক: এ টি এম বদরুজ্জামান, পিএইচডি গবেষক, মলিকুলার মেডিসিন। ন্যাশন্যাল হেলথ রিসার্চ ইনস্টিটিউট, তাইওয়ান।