তাইপের চিঠি-২

এলিফ্যান্ট মাউন্টেনে ওঠার সময় চোখে পড়ে তাইপেই–১০১
ছবি: সংগৃহীত

তিন দিনের ছুটিতে ঘুরতে যাচ্ছি তারাকো ন্যাশনাল পার্কে। তাইওয়ানের পূর্ব উপকূলে প্রশান্ত মহাসাগরের পাশ ধরে এর অবস্থান। এটি খুবই জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র। মূলত আকাশছোঁয়া পাহাড়, সুরু গিরিখাত, গরম পানির ঝরনা আর নীল পানির পাথুরে সমুদ্রসৈকতের জন্য বিখ্যাত। এক পাশে দিগন্তবিস্তৃত নীল জলরাশি। অন্য পাশে মেঘে ছুঁয়ে বেরিয়ে যাওয়া বিশাল পর্বতমালা। বিরামহীনভাবে এসব পাহাড়ের গায়ে আছড়ে পড়ছে বিশাল সব নীল পানির ঢেউ। যাত্রাপথে মাইলের পর মাইল ধরে দেখতে পাওয়া যায় এ দৃশ্য। কিছুক্ষণের জন্য দুই চোখ অলস হয়ে যাওয়ার জন্য যা যথেষ্ট।

লিয়ো নদীর তীর ধরে চলে যাওয়া গিরিখাদের রাস্তা
ছবি: লেখক

তারাকো ন্যাশনাল পার্ক মূলত প্রাকৃতিক পরিবেশ, খনিজ সম্পদ, প্রাচীন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাসহ বিপন্নপ্রায় বন্য প্রাণী রক্ষার জন্য ১৯৮৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রায় ২ লাখ ২৭ হাজার ৩০০ একর জায়গাজুড়ে এর অবস্থান, যার গড় উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৬১৩ মিটার। এই বিশাল জায়গাজুড়ে রয়েছে ১৪০টির বেশি উঁচু পর্বত, অনেক গিরিখাত আর ঝরনা। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উঁচু পর্বতের নাম নানহুদাসুন, যার উচ্চতা ১২ হাজার ২৭৭ ফুট। এই বিশালাকৃতির পাহাড়গুলো ফিলিপাইন ও ইউরেশিয়ান টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থিত। দুটি সক্রিয় টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলের মাঝামাঝি হওয়ায় এটি পৃথিবীর অন্যতম ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা। দেখা যায়, প্রায় প্রতিদিন এক থেকে দুবার ভূকম্পন অনুভূত হয়। ইন্টারনেট ঘেঁটে মজার একটা তথ্য পেলাম। প্রতিনিয়ত ভূমিকম্পের ফলে এই তারাকো ন্যাশনাল পার্কের উচ্চতা প্রতিবছর কয়েক মিলিমিটার করে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে ভূমিকম্প খুব ভয় পাই। তাইওয়ানে যখন প্রথম আসি, তখনকার একটি ঘটনা—রাতের বেলায় বাসায় কথা বলছি। এমন সময় ভূমিকম্প। আমি কোনো চিন্তা করার অবকাশ নিইনি। প্রথম ঝাঁকি বোঝার সঙ্গে সঙ্গে দিলাম এক ভোঁ–দৌড়। আমি যখন দৌড়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন লক্ষ করলাম, স্থানীয় লোকজন নির্বিকার। এই ঘটনার পর লজ্জায় আর কোনো দিন এ ধরনের পরিস্থিতে দৌড়ে বেরিয়ে আসিনি, এটা সত্য। তবে এখনো ভূমিকম্পের সময় প্রচণ্ড আতঙ্ক অনুভব করি।

রাস্তার পাশ থেকে নীল জলরাশির প্রশান্ত মহাসাগর
ছবি: লেখক

আমরা নেইলি সিটি থেকে রওনা দিয়েছিলাম ভোর ছয়টায়। ইতিমধ্যে তাইপে শহরকে পাশ কাটিয়ে ঢুকে পড়েছি হুয়ালিয়েনের দিকের হাইওয়েতে। তবে এর ভেতর একটা ভুল হয়ে গেল। গুগল ম্যাপের ভুল ডিরেকশনে হাইওয়ে থেকে বেরিয়ে আমরা ঢুকে পড়েছি ছোট একটি রাস্তায়। এটি চলে গেছে পাহাড়ের ঠিক মাথা বরাবর কয়েক হাজার ফুট ওপর দিয়ে। কখনো কখনো উচ্চতা আরও বেশি। বেশ ভয়ংকর, আঁকাবাঁকা পাহাড়ি সরু রাস্তা। তবে পাহাড়ের চারপাশজুড়ে ছোট–বড় সবুজ গাছপালা। দেখে মনে হয়, খুবই পরিচিত একটি দৃশ্য। অনেকটা যেন আমাদের প্রিয় বাংলাদেশের মতো। এক টুকরো সবুজের সমাহার। উচ্চতার কারণে কানের ভেতর একটা চাপ অনুভব ছাড়া সবকিছু ভালোই লাগছিল। ইতিমধ্যে থেমে থেমে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। চারপাশের সবুজ পরিবেশ আর বৃষ্টির সঙ্গে মিলিয়ে বাংলা গান। অন্য রকম একটা নস্টালজিক সময় যাচ্ছিল। তবে আমাদের জন্য অন্য রকম একটা চমক তখনো বাকি ছিল। মোস্তাফিজ ভাই দক্ষ হাতে গাড়ি চালিয়েছেন। বাকিরা হইহুল্লোড়ের মধ্য আছি। গাড়ি মোড় নিয়ে যখন উত্তর থেকে সোজা দক্ষিণ দিকে ছুটে চলেছে, তখন একটা মজার জিনিস দেখা গেল। দেখতে পেলাম, আমাদের গাড়ি চলছে মেঘের উচ্চতা ছাড়িয়ে। কখনো কখনো মেঘের অবস্থান আমাদের হাত–ছোঁয়া দূরত্বে। আবার কখনো মেঘ এসে কুয়াশার মতো করে রাস্তা ঢেকে দিচ্ছে। সবাই গাড়ির জানালা খুলে দিলাম। যেন ভেতরে মেঘ প্রবেশ করতে পারে। নিচ থেকে যখন আমরা আকাশে মেঘ দেখেছি, তখন এটাকে সাদা তুলার মতো মনে হতো। কিন্তু কাছ থেকে দেখে এটাকে হিমশীতল কুয়াশা ছাড়া কিছুই মনে হলো না। একপর্যায়ে গাড়ি থেকে নেমে মেঘের ভেতর থেকে সেলফি তোলার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কোনোভাবেই কাছ থেকে মেঘ ক্যামেরাবন্দী করা গেল না।

তারাকো ন্যাশনাল পার্কের প্রবেশমুখ
ছবি: লেখক

প্রায় দুই ঘণ্টার বেশি সময় পাহাড়ি রাস্তায় চলার পর আবার হাইওয়াতে নেমে এলাম। জীবনের অন্যতম সেরা একটি অভিজ্ঞতা হয়ে গেল ততক্ষণে। মেঘ নিয়ে আমার ভাবনায় ছেদ পড়ল ইঞ্জিনিয়ার আহমেদ শিবলি ভাইয়ের ডাকে। জানাল, আমরা এখন ইলান কাউন্টিতে প্রবেশ করেছি। এখান থেকে থেকে হুয়ালিয়েন সোজা পূর্ব দিকের পথ। রাস্তার বেশির ভাগ অংশ গিয়েছে সাগরের পাদদেশ ধরে আবার কখনো লম্বা সব পাহাড় কেটে তৈরি করা টানেলের ভেতর দিয়ে। কখনো একেকটি টানেল পার হতে বেশ সময় লেগে যাচ্ছিল। এরই ভেতর নায়েম ভাই একটা তথ্য দিল। এসব টানেলের ভেতর সবচেয়ে লম্বাটির দৈর্ঘ্য ১৩ কিলোমিটার। অবশ্য এই রাস্তায় এত বেশি টানেল তৈরি হয়েছে যে আলাদা করে কিছু বুঝতে পারিনি।

মেঘকে ক্যামেরাবন্দী করার নিষ্ফল চেষ্টা
ছবি: লেখক

এবার আমরা ইলান ছাড়িয়ে দ্রুত ছুটে চলেছি তারাকো ন্যাশনাল পার্কের দিকে। ইতিমধ্যে অনবরত ফোন আসা শুরু হয়েছে। ইসমাইল ভাইয়ের গাড়িতে থাকা আমাদের গ্রুপের বাকি অংশ পৌঁছে গিয়েছে সেখানে। এখন তারা আমাদের জন্য অপেক্ষায়। গুগল ম্যাপে তখনো দেখাচ্ছে আরও ৬৪ কিলোমিটার রাস্তা বাকি। তার মানে ভুল পথে আসায় আমরা এখনো এক ঘণ্টার রাস্তা পিছিয়ে আছি। পৌঁছানোর পর দেখতে পেলাম হুয়ালিয়ানের তিচু ইউনিভার্সিটিতে অধ্যয়নরত বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা এসে যোগ দিয়েছে আমাদের সঙ্গে। এখন বেশ বড়সর ১৩-১৪ জনের গ্রুপ আমাদের।

তারাকো অবজারভেশন সেন্টারে এক টুকরো বাংলাদেশ
ছবি: লেখক

পরিকল্পনা অনুসারে তারাকো অবজারভেশন সেন্টারে দুপুরের খাবার খেয়ে আমরা সবাই বেরিয়ে পড়ব তারাকো ন্যাশনাল পার্কের দিকে। যাত্রার শুরুটা হবে লিয়ো নদীর গিরিখাদ ধরে। পাথর কেটে বানানো টানেলের মতো সুরু রাস্তা। দূর থেকে দেখলেই গা ছমছম করে উঠবে যে কারও। এ রাস্তা ধরেই আমরা চলে যাব ভেতরের দিকে। চলবে...

*লেখক: এ টি এম বদরুজ্জামান, পিএইচডি গবেষক, মলিকুলার মেডিসিন, ন্যাশন্যাল হেলথ রিসার্চ ইনস্টিটিউট, তাইওয়ান

আরও পড়ুন