তাইপের চিঠি-১

এলিফ্যান্ট মাউন্টেনে ওঠার সময় চোখে পড়ে তাইপেই–১০১
ছবি: সংগৃহীত

কয়েক মাস ধরে ল্যাবে গবেষণাকাজের ব্যস্ততা আর সেই সঙ্গে করোনারভাইরাসের আতঙ্ক—এই দুইয়ে মিলে রিসার্চ ইনস্টিটিউটের বাইরে যাওয়া হয়নি। একদম হাঁপিয়ে ওঠা জীবন। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য বেশ কিছুদিন ধরেই পরিকল্পনা করছিলাম সুযোগ পেলে বাইরে কোথাও ঘুরে আসার। তাইওয়ানে অনেক পর্যটকপ্রিয় জায়গা আছে। তবে মূল সমস্যা হলো, এসব স্থানে যাওয়া একটু সময়সাপেক্ষ। তাই সবাই মিলে ঠিক করলাম তাইপে শহরের পাশে অবস্থিত এলিফ্যান্ট মাউন্টেনে হাইকিংয়ে যাব। প্রথমে নাম শুনে মনের ভেতর একটু ভয় ঢুকে গিয়েছিল। কিন্তু পরে ইন্টারনেট ঘেঁটে আশ্বস্ত হলাম। এর নাম এলিফ্যান্ট মাউন্টেন হলেও নামের মতো উচ্চতা এত বেশি নয়। সব মিলিয়ে এটি ১৮৩ মিটার বা প্রায় ৬০০ ফুট।

আশার কথা হলো, এর পুরো হাইকিং ট্রেইলটিতে খুব চমৎকারভাবে পাথর কেটে সিঁড়ি বানানো আছে। আবার এর চূড়া থেকে তাইওয়ানের আইকনিক ভবন তাইপেই-১০১ সবচেয়ে ভালোভাবে দেখা যায়। অনেকটা এক ঢিলে দুই পাখি শিকারের মতো। আমাদের কপাল বেশ ভালোই বলতে হবে। গত কয়েক সপ্তাহ যেখানে আকাশের মেজাজ-মর্জি বোঝা দায় ছিল, সেখানে আমাদের যাত্রার দিনটিতে আকাশজুড়ে ঝকমকে রোদ। প্রথমে ঠিক করলাম জুনান শহর থেকে ট্রেনে করে যাব নেইলি সিটিতে। সেখান আরও দুজন তাইওয়ানপ্রবাসী বাংলাদেশিসহ মোস্তাফিজুর রহমান ভাই গাড়ি নিয়ে অপেক্ষায় থাকবেন। জুনান থেকে একা ট্রেনযাত্রা আমার কখনো খারাপ লাগে না। কারণ, রেললাইনটি চলে গেছে তাইওয়ানের পশ্চিম উপকূল ধরে। এর একপাশ ধরে ছোট-বড় সব পাহাড়ের সারি। অন্যপাশে বিখ্যাত ফরমোজা প্রণালি। যে প্রণালি তাইওয়ানকে চীনের মূল ভূখণ্ড থেকে আলাদা করেছে। সেখানে দিগন্তবিস্তৃত সাগরের নীল জল আর তার সঙ্গে শত শত বায়ুকল অলসভাবে ঘুরছে অনবরত। ছবির মতো চোখজুড়ানো দৃশ্য। দেখতে দেখতেই দেড় ঘণ্টার ট্রেনভ্রমণ শেষে নেইলি সিটিতে পৌঁছালাম। সেখান থেকে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী সবাই একসঙ্গে তাইপের দিকে রওনা হলাম। আমাদের গাড়ি যখন সুবিশাল হাইওয়ের লেন ধরে ১২০ থেকে ১২৫ কিমি বেগে ছুটে চলছিল, তখন মিউজিক সিস্টেমে উচ্চে স্বরে বেজে যাচ্ছিল জেমসের পুরোনো দিনের গান—  
‘আরও কিছুক্ষণ কি রবে বন্ধু
আরও কিছু কথা কি হবে...।’

বিদেশের মাটিতে আছি এ জন্যই কি না, ঠিক জানি না। তবে সবাই মিলে যখন কোথাও ঘুরতে গিয়েছি, তখন গাড়িতে বাংলা ছাড়া অন্য কোনো ভাষার গান বাজতে শুনিনি কখনো।

প্রথম ভিউ পয়েন্টে পৌঁছানোর পর সবাই একসঙ্গে
ছবি: সংগৃহীত

তাইপে আসার পর আমাদের প্রথম কাজ ছিল এলিফ্যান্ট মাউন্টেনের হাইকিংয়ের শুরুর রাস্তাটি খুঁজে বের করা। পরের কাজটি ছিল সবচেয়ে কঠিন, পাহাড় বেয়ে ওঠা। এ সময়টায় মনে একটু দুশ্চিন্তা কাজ করছিল। তখন মনে হচ্ছিল আসলেই এত উঁচুতে উঠতে পারব কি না। যখন পাহাড়ের কাছে এলাম, মনের ভয় একদম উড়ে গেল। সুন্দর করে পাথর কেটে সিঁড়ি বানানো আছে দৃষ্টিসীমার শেষ অবধি। তা ছাড়া একটু পরপর বিশ্রাম নেওয়ার জন্য বসানো আছে পর্যাপ্ত বেঞ্চ। আরও আশার কথা হলো, অনেক ছেলেমেয়ে, এমনকি অনেক বয়স্ক মানুষও এসেছেন হাইকিংয়ের জন্য। দেরি না করে আমরাও ওপরে ওঠা শুরু করলাম। যেমনটি ভেবেছিলাম, তা হয়নি। চারপাশের অপরূপ প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে দেখতে মাত্র ২৫ থেকে ৩০ মিনিটেই পৌঁছে গেলাম প্রথম ভিউ পয়েন্টে। অবশ্য ততক্ষণে সারা শরীর ঘেমে একাকার।

এখানে আসার আগেই আমরা জেনে নিয়েছিলাম এখানকার দুটি পর্যটকপ্রিয় জায়গার কথা। এর প্রথমটি থেকে পুরো তাইপে শহরের প্যানর‌্যামিক দৃশ্য দেখা যায় খুব ভালো করে। আর অন্যটি হলো বিশালাকৃতির কয়েকটি পাথর, যেখানে পর্যটকেরা তাইপেই-১০১–কে পেছনে রেখে বিভিন্ন ভঙ্গিমায় ছবি তোলেন। মজার ব্যাপার হলো, আমি এলিফ্যান্ট মাউন্টেনের যত ছবি পেয়েছি ইন্টারনেটে, তার বেশির ভাগই ছিল এই দৈত্যাকৃতির পাথরকেন্দ্রিক। আমরাও এই সুযোগ হারাতে চাইনি। তবে সমস্যা হয়েছিল পাথরে ওঠার জন্য স্থানীয় আর বিদেশি পর্যটকদের লম্বা সারি। সময় নষ্ট না করে আমরাও লাইন ধরে দাঁড়িয়ে গেলাম। অন্য সব বিষয়ের মতো এবার আমার ভাগ্য খুব বেশি সুপ্রসন্ন ছিল না। আমি যখন পাথরের ওপর ওঠার সুযোগ পেলাম, ততক্ষণে সূর্য অস্ত যায় যায় অবস্থা। তবু কাঁধ–ব্যাগ থেকে আমার সব সময়ের সঙ্গী পতাকাটি নিয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। অনেক ভিনদেশি মানুষের সামনে আমাদের লাল-সবুজের পতাকা।

অবশেষে দৈত্যাকৃতির পাথরের ওপর
ছবি: সংগৃহীত

ধীরে ধীরে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতে লাগল। দেখতে পেলাম সময় যত যাচ্ছে, ততই বাড়ছে মানুষের ভিড়। পরে জানলাম, এখানে এত পর্যটক এসেছেন মূলত রাতের তাইপে শহরকে দেখার জন্য। আমরাও অপেক্ষা করতে থাকলাম। সত্যি বলতে কি, এখানকার সন্ধ্যা কিংবা রাতের রূপ সহজে ভোলার মতো নয়। সূর্য অস্ত যেতে না যেতেই বিশাল সব তাইপে স্কাইস্ক্যাপারের হরেক রঙের বাতি জ্বলে উঠল চোখের সামনেই। অবাক হয়ে দেখছিলাম তখন। অন্ধকার যত গাঢ় হচ্ছিল, ততই যেন রাতের তাইপে শহর তার সৌন্দর্যের পেখম মেলে ধরছিল। আর পুরো শহরের মাঝখানে অবস্থিত তাইপেই–১০১–কে মনে হচ্ছিল কোনো এক বিশালাকৃতির ড্রাগন শহরের বুকে নেমে এসেছে, যার শরীর থেকে ঠিকরে আলো বের হয়ে যেন সারা শহরের আকাশকে আলোকিত করে দিচ্ছে।
আমার মনে আছে, ২০১৭ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার সবচেয়ে উঁচু ভবন লট্টে টাওয়ারকে রাতের বেলা সিউলের ইথেওয়ানের পাহাড় থেকে দেখেছিলাম। কিন্তু এতটা রাজকীয় মনে হয়নি। সে ক্ষেত্রে তাইপেই-১০১ যেন সদম্ভ নিজের শ্রেষ্ঠত্ব জানান দিচ্ছিল। এর মধ্যে পাশ থেকে একজন মনে করিয়ে দিল আমাদের এখন নামতে হবে। ঘড়ির কাঁটায় তাকিয়ে বুঝতে পারলাম সময় কত নিমেষেই চলে গিয়েছে। আমাদের আগেই পরিকল্পনা ছিল রাতের বেলাতেই ফিরে আসব। তাই দেরি না করে পাহাড় বেয়ে নিচে নেমে এলাম। ইতিমধ্যে একডেমিয়া সিনিকার বাংলাদেশি গবেষক নায়েম চৌধুরী আমাদের জন্য অ্যারাবিয়ান নাইটস নামের রেস্তোরাঁয় তৈরি করে রেখেছিলেন স্পেশাল বিরিয়ানি। রেস্তোরাঁটি দক্ষিণ এশীয় স্বাদের খাবারের জন্য বেশ জনপ্রিয়। রাতের খাওয়াদাওয়ার পর এবার তাইপে শহর থেকে বিদায়ের পালা। তবে চলে আসার আগে আইকনিক তাইপেই-১০১–এর নিচে দাঁড়িয়ে একটা সেলফি তুলতে ভুল করিনি।
ফিরে আসার সময় রাতের হাইওয়ের দুপাশের লাল-নীল বাতির আলোয় আলোকিত চার পাশকে দেখে মাথার ভেতর ঘুরঘুর করছিল, প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতার কয়েকটি লাইন—

বিদায়বেলায় তাইপেই–১০১–এর নিচ থেকে সেলফি তুলতে ভুলিনি
ছবি: সংগৃহীত

‘চোখ দুটো ঘুমে ভরে
ঝরা ফসলের গান বুকে নিয়ে আজ ফিরে যাই ঘরে!
ফুরায়ে গিয়েছে যা ছিল গোপন,—স্বপন কদিন রয়!
এসেছে গোধূলি গোলাপিবরণ,—এ তবু গোধূলি নয়!’
*লেখক: এ টি এম বদরুজ্জামান (পিএচডি শিক্ষার্থী), ন্যাশন্যাল হেলথ রিসার্চ ইনস্টিটিউট, তাইওয়ান।