ছলনাময়ী-৪
কত দিন নদী দেখা হয় না। নৌকাতে বসে নদীর ঢেউ দেখার মাঝে একটা মজা আছে। সেই ঢেউয়ের সঙ্গে মনটাও যে উথাল–পাথাল হয়। আজ বুড়িগঙ্গার তীরে গেলে কেমন হয়? মন্দ হয় না। কিন্তু শোয়া থেকে উঠতেই তো মন চায়ছে না। এদিকে বারোটা বাজতে চলল। মোবাইলের সুইস অফ, চার্জ নেই। চার্জারটা বেডের ডান পাশে ডিবি বক্সে লাগানো আছে। হাত বাড়ালেই মোবাইলটা চার্জে লাগানো যায়। কিন্তু হাত বাড়াতে মন চাইছে না। অলসতা আঁকড়ে ধরেছে। আজকের দিনটাকে অলসতার কাছে সঁপে দিলে কেমন হয়! না আজ আর নদী দেখতে যাব না। বরং অলসতার শক্তি কতটুকু, সেটা দেখব। তারপর কিছু একটা করা যাবে। কতক্ষণ অলস সময় পার করা যায় অদ্য দিবসে, সেটা পরীক্ষিত হোক আগে।
কটা বাজে। আন্দাজ করা যাচ্ছে না। পেট বাবাজির অত্যাচার বেড়েছে। ক্ষুধার জ্বালা। এতটা দুর্বল হয়েছে শরীর। উঠে দাঁড়াতে পারছি না। না এবার আর থেমে থাকলে চলবে না। উঠে দাঁড়ালাম। পুরো শরীরে কম্পন শুরু হয়েছে। বুঝি এখনই মাথা ঘুরে পড়ে যাব। টেবিলের ওপরে একটা বিরিয়ানির প্যাকেট রাখা আছে। ও মনে পড়েছে। এটা তো গত রাতের খাবার ছিল। তার মানে রাতে খাওয়া হয়নি। এখন কটা বাজে? ঘড়ি নেই। মোবাইলে চার্জ নেই। জানালা দিয়ে বাইরে দৃষ্টি মেলি। মনে হচ্ছে কেবল রাত পোহাল।
বিরিয়ানি নষ্ট হয়ে গেছে। তাই খাওয়া হলো না। রাস্তায় নেমে আসি। এত খিদে নিয়ে টিকে থাকা অসম্ভব। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আর আমি ভাবছি ভোর। মাথাটা গেছে। আগে কিছু খেতে হবে। তা না হলে এবার বডিটাও যাবে! সিদ্দিক বাজারের গলি ধরে হাঁটছি। রাজধানীর পুরান টাউনে এই এক মজা। আর কিছুটা পথ হাঁটলে ফুলবাড়িয়া। ফুলবাড়িয়া গুলিস্তানে খাবার হোটেলের কমতি নেই। সারি সারি হোটেল। সামনে সাজানো নানান রকমের ভর্তা ও তরকারি। গোল গোল করে পাখির ডিমের মতো করে রাখা আছে আলুভর্তা। আলুভর্তা, ডাল, ভাত খাওয়া যেতে পারে। আগে দামটা জিজ্ঞেস করে নিতে হবে। তা না হলে পরে ১০ টাকার খাবার ৩০ টাকা হয়ে যাবে। এই একটা দোষ ঢাকার শহরের কিছু কিছু হোটেলমালিকের আছে। তাই আগে থেকে দাম জেনে খেলে মন্দ হয় না।
হোটেলের ভেতর বসলাম। কিশোর বয়সের একটা ছেলে আমার কাছে এসে বলল,
‘ভাইজান কী খাবেন? ইলিশ মাছ, ভাইল্লা মাছ, টাকি মাছ, বোয়াল মাছ, রুই মাছ, কাতলা মাছ, চিংড়ি মাছ আছে। আপনাকে কোনটা দিব?’
খিদেয় মরে যাচ্ছি। তারপরও কিশোর ছেলেটির কথাগুলো শুনতে বেশ ভালো লাগছে। যদিও এসব হোটেলের ছেলেগুলো খুব চতুর হয়।
আমি বললাম, ‘বোয়াল মাছ, টাকি মাছ, চিংড়ি মাছ, মাছ, মাছ...। এভাবে প্রতিটি নামের সঙ্গে মাছ শব্দটা না লাগালে হয় না?’
ছেলেটা বলল, ‘মানে কী?’
‘রুই, কাতলা, বোয়াল, টাকি...এভাবে বলতে পারিস।’
ছেলেটা একটু হেসে দিয়ে বলে, ‘বুঝলাম, অহন কন কী খাইবেন?’
‘আর কী আছে?’
‘গরু, খাসি, মুরগি—কোনটা খাবেন?’
ছেলেটা যথেষ্ট বুদ্ধিমান। তা না হলে সে এখন বলত, গরুর মাংস, মুরগির মাংস, খাসির মাংস।
‘আর?’
‘অনেক জাতের ভর্তা আছে।’
‘আর কী আছে?’
‘ভাইজান ঝামেলা করবেন না তো! কী খাইবেন তাড়াতাড়ি কন? কাস্টমার আছে।’
‘আমি কি তোর কাস্টমার না?’
‘ধুর মিয়া। কী খাইবেন কন?’
‘আলুভর্তা কত?’
‘১০ টাকা।’
‘ডাল?’
‘১০।’
‘ভাত?’
‘এক প্লেট ১৫ টাকা।’
‘দুইটা আলু ভর্তা, একটা ডাল, একটা ভাত...’
বলতেই ছেলেটা চট করে চলে গেল। ম্যাজিকের মতো খাবার সামনে চলে এল। সঙ্গে কাঁচা মরিচ পেঁয়াজও আছে। পুরো দুই প্লেট ভাত খেলাম। ক্ষুধা নিবারণ হলো। একটু বসে থাকতে ইচ্ছা হচ্ছে। হোটেলের ছেলেটার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা হচ্ছে। হোটেলভর্তি মানুষ। ছেলেটাকে দেখা যাচ্ছে না। আমি অবশ্য এদিক–ওদিক তাকাচ্ছি। অবশেষে ছেলেটি আমার কাছে চলে এল।
এসেই বলে, ‘আপনার হইছে ৬০ টাকা।’
‘তোর নাম কী?’
‘আমার নাম সাগর।’
‘নদীর কী খবর?’
‘মানে?’
‘বুঝেও না বোঝার ভান করিস?’
‘দেহেন ভাইজান, এত কথা কইবেন না। আপনার বিল দিয়া চইলা যান।’
‘কিন্তু আমার তো আরও কিছুক্ষণ বসে থাকতে ইচ্ছা হচ্ছে।’
‘এমনিতে বসে থাকলে মালিকে রাগ করবে।’
‘তোর সঙ্গে আরও কিছুক্ষণ কথা বলতে ইচ্ছা হচ্ছে।’
‘এখন যান।’
‘নদীর কথা বলবি না।’
‘কিসের নদী?’
‘তোর প্রেমিকা নদী।’
সাগর ছেলেটার ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকায়।
‘বুঝলাম, তুই আমাকে কিছু বলবি না। আচ্ছা শোন, তোকে আর বিব্রত করতে চাই না। তোর প্রেমিকার নাম যেটাই হোক না কেন, তুই নিজে থেকে ওর নাম দিবি নদী। দেখবি তোর প্রেম জমে গেছে।’
সাগরের হাতে ১০০ টাকার একটা নোট দিয়ে বেরিয়ে আসি। সাগর আমার দিকে তাকিয়ে আছে। অপলক তাকিয়ে থাকা। পেছন থেকে সে হয়তো ডাক দিতে চেয়েছিল বাকি টাকাটা দেওয়ার জন্য। কিন্তু ডাক দিতে পারেনি। ৪০ টাকা বড় কিছু নয়। কিন্তু সাগরের মতো ছেলের কাছে সেটা কিছুটা হলেও বড়। সেটা তার জন্যই থাক।
আবার রুমে যেতে হলো। মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখি, অপরিচিত একটা নম্বরের মিসডকল। ইনবক্সে রেড কালার টু উঠে আছে। ইনবক্স ওপেন করতেই রুমেলের বার্তা। আজ ওর প্রিয়তমার সঙ্গে দেখা করতে হবে। হোটেল সোনারগাঁওয়ে। রাত ১০টায়। কক্ষ নম্বর বিস্তারিত সবই লেখা আছে। এখন বাজে সন্ধ্যা ৭টা। আরও ৩ ঘণ্টা সময় আছে। বড়লোক বাবার একমাত্র ছেলে রুমেল। তার প্রেমিকার সঙ্গে দেখা করতে যাব। সে কিনা একজন কলগার্ল। না জানি ভাগ্যে কী আছে আজ। কে জানে?
বহুদিন পর ডায়নার সঙ্গে দেখা হলো। মেয়েটি কলাপাতা রঙের শাড়ি পরেছে। খোলা চুলগুলো পিঠের ওপরে পড়ে আছে। আজ ডায়না চোখে কাজল পরেছে। যে এই মেয়ের চোখের দিকে তাকাবে, সে মরেছে। এই মেয়ের চোখের ভাষা যে কেউ পড়তে পারবে। ডায়না একজন কলগার্ল। জীবনের স্বাদ এদের কাছে কখনো ফাগুন, কখনো আগুন, কখনো ক্লেষ্ট আবার কখনো অতিষ্ঠ। এরা জীবনকে নিয়ে খেলে, খেলায়। এদের কান্না সব সময় হাসির আড়ালে লুকানো থাকে। শিক্ষাজীবনের শেষ প্রান্তে এসেও এরা আজ সামাজিক কার্যক্রম থেকে বঞ্চিত। এই সমাজ এদেরকে কলগার্ল হতে শিখিয়েছে।
‘মুরাদ ভাই কেমন আছেন?’
‘ভালো আছি।’
‘আপনার সঙ্গে বসে এক কাপ চা খাওয়া যাবে কি?’
‘অবশ্যই, চলো সামনে এগোনো যাক।’
কিছুটা পথ ডায়নার সঙ্গে হাঁটলাম। চমৎকার মেয়ে ডায়না। রূপে যার আগুন। এই পৃথিবীর বুকে প্রকৃতি কিছু মেয়েকে অতিরিক্ত সুন্দরী বানিয়ে পাঠিয়েছে। যাদের দিকে তাকিয়ে যুগের পর যুগ কাটিয়ে দেওয়া যায়। সেই মেয়েদের দলে ডায়নাও আছে। ছোট্ট একটা চায়ের স্টলে চা খাওয়ার কাজটা শেষ করি।
‘আচ্ছা মুরাদ ভাই, আপনি এখন যাবেন কোথায়?’
‘একজনের সঙ্গে দেখা করব। হোটেল সোনারগাঁওয়ে যাব। রাত ১০টায় দেখা করার কথা।’
‘কে সে?’
‘তোমার মতো একজন সুন্দরী হবে নিশ্চয়।’
‘মানে কী?’
‘মানে অতি সোজা। সে একজন কলগার্ল।’
‘ও আচ্ছা, আপনি তাহলে...’
‘ডায়না তুমি যা ভাবছ, আসলে বিষয়টা তা নয়।’
‘আসলে বিষয়টা কী, জানতে পারি?’
‘আমার বন্ধুর রিকোয়েস্টে যাচ্ছি। সে একজন কলগার্লকে ভালোবাসে। কিন্তু সেই মেয়েটি তাকে ভালোবাসে না।’
‘ও আচ্ছা, এখন আপনি যাচ্ছেন সেই মেয়েকে বোঝাতে, যেন আপনার বন্ধুকে ভালোবাসে। তা–ই তো?’
আমি চুপ করে ডায়নার মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। আর ডায়নার বাচনভঙ্গি দেখছি। যেন কোনো এক অপ্সরী আমার সামনে বসে আছে। ঠোঁটে লাল লিপস্টিক। কানে দোল। মায়াবী দুটি চোখে কাজলও পরেছে। এত মায়া নিয়ে কেন সে পথে নেমেছে। সবই জানা আছে। তারপরও ওর মুখ থেকে বড্ড জানতে ইচ্ছা হচ্ছে। না থাক, সবকিছু জানতে নেই। এটা প্রকৃতির নিয়ম।
‘কী হলো, আমার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা হচ্ছে না বুঝি?’
ডায়নার কথার উত্তর না দিয়ে আমি দাঁড়ালাম। ডায়না বলল, ‘ওই মেয়েটার নাম কী?’
‘জানি না। তবে ইতু, মিতু কিংবা আলোও হতে পারে!’
ডায়না বিস্মিত হয়ে বলল, ‘এটা আবার কেমন কথা?’
‘এটা হলো অতি বাস্তব কথা। এই সমাজে যে নারী হাতের পর হাত বদলায়! সে নারী তার নামও বদলায়।’
‘মুরাদ ভাই, আমি আপনার কথা বুঝতে পারি, তবে সব সময় পারি না। আপনি মানুষটা কেমন জানি।’ ‘দেখো ডায়না, আমি ভালো মানুষ কি না, সেটা নিয়ে আমি নিজে দ্বিধান্বিত।’ ‘এখন কোথায় যাবেন?’ ‘ওই মেয়েটার কাছে যাওয়ার কথা। কিন্তু যাব না। যদি তুমি আমাকে সময় দাও।’ ‘ঠিক বুঝলাম না।’ ‘আজকে রাতে যদি কিছুটা সময় তুমি আমার সঙ্গে থাকো।’ ‘মুরাদ ভাই, আমি আমার সবটা আপনাকে দিতে রাজি। কিন্তু আপনি?’ ‘এত প্রশ্ন করো না। এখন থেকে কি তুমি আমার সঙ্গে থাকতে পারবে?’ ‘অবশ্যই পারব।’ ডায়নার মুখে আনন্দের উচ্ছ্বাস। জানি না মেয়েটা আমাকে এত ভালো পায় কেন। কেন এতটা আপন মনে করে।
রাত ১০টা। বুড়িগঙ্গার তীরে দাঁড়িয়ে আছি। সঙ্গে আছে পৃথিবীর সেরা সুন্দরী মেয়েটি। ছোট একটা নৌকা ভাড়া করেছি। আকাশে তারার মেলা। ঝলমল আলোতে মুখর চারপাশ। নৌকায় শুধু ডায়না আর আমি। বেশি দূর যাওয়া হয়নি। তবে কিছুটা মাঝামাঝি নৌকা নিয়ে চলে আসি। বৈঠা রেখে দিলাম। চারপাশ সুনসান নীরব। ডায়না আমার কাছে এসে বসল। খুব কাছে। এতটা কাছে এসেছে যে ওর নিশ্বাসের শব্দটুকু কানে আসছে। আমি আস্তে করে বললাম, ডায়না...? ডায়না আমার হাতটা চট করে ধরে ফেলল। মুখটা আমার চোখের সামনে নিয়ে এসে বলল, ‘মুরাদ, আজ আর কোনো কথা নয়। আজ তোমার–আমার ভালোবাসার আলিঙ্গনে এই রাতকে স্মরণীয় করে রাখব।’ ‘প্রতিটি রাতই তো তোমাদের স্মরণীয়। তা–ই নয় কী?’ ডায়না আমার কথা শুনে চোখ কপালে তোলে। তারপর হয় খুব বেশি রাগান্বিত। আমি বুঝতে পারছি, ডায়নাকে দেখতে আরও বেশি সুন্দর লাগছে। ‘এই ছেলে মুরাইদ্দা শুন, তোরে আজকে আমি আমার রূপের জালে ফাঁসাবই।’ এই কথা বলেই ডায়না বুকের ওপর থেকে শাড়ির আঁচলটা সরিয়ে দিল। আমি হাসলাম। রাজ্যের সেরা সুন্দরী মেয়েটি আজ আমার সামনে অর্ধ–উলঙ্গ। আমি বৈঠা হাতে নিলাম। এমন সময় ডায়না বুড়িগঙ্গার বুকে ঝাঁপ দেয়। ‘ডায়না, ডায়না, ডায়না...!’ ডায়না পানিতে হাবুডুবু খাচ্ছে। আমি চিন্তিত। কী করব, কী করা যায়, এটা না ভেবে হঠাৎ থেমে যাই। মেয়েটা আমার সঙ্গে ছিল এতক্ষণ, তার মানে কী একটু পরে সে আমার সঙ্গে থাকবে না। এমনটা তো হতেই পারে। আমি দাঁড়িয়ে আছি মাঝনদীর বুকে। ডায়না নামের সুন্দরী মেয়েটা হাবুডুবু খাচ্ছে। আচ্ছা, সে কি সত্যিই মারা যাবে? জোছনার আলোতে সবকিছু ঝলমলে ছিল। এখন কেমন জানি হয়ে যাচ্ছে। আকাশের কালো মেঘে চাঁদটা ঢেকে গেল। ক্রমেই পৃথিবীজুড়ে আঁধার নেমে আসে। প্রকৃতি বুঝি মৃত্যুকে মেনে নিতে কিছুটা হলে নির্বোধ হয়। পানির শব্দটা নেই। ডায়না নামের মেয়েটি কি এই পৃথিবীর বুক ছেড়ে চিরতরে চলে গেল! বেশ কিছুটা সময় পেরিয়ে পৃথিবীটা আবার আলোকিত। কেউ একজন আমার আশপাশে আছে। তবে কি ডায়না চলে এসেছে? সত্যিই তো। নৌকার একপাশে ধরে আছে। আর হাসছে। ‘কি হলো, একটু হেল্প করো না। আমি উঠতে পারছি না তো।’ ডায়না মতলব অন্য কিছুও হতে পারে। কিংবা আমাকে টান দিয়ে পানিতে ফেলতে পারে। এত রাতে দুজন যুবক–যুবতী বুড়িগঙ্গাতে ঝাঁপাঝাঁপি করবে, এটা বোধগম্য নয়। সাতপাঁচ ভেবে বললাম, ‘যে মেয়ে নৌকা থেকে লাফ দিয়ে পানিতে ঝাঁপ দিতে পারে, সে নৌকাতে উঠতেও পারবে।’ ডায়না নিজে নিজে উঠে এল নৌকাতে। আমার সামনে এসে বলল, ‘আপনার মতো নির্দয় মনের মানুষ জীবনে প্রথম দেখলাম। একটা মানুষ চোখের সামনে পানিতে ডুবে মরে যাচ্ছে, তাকে বাঁচাতে বিন্দুমাত্র চেষ্টাটুকুও করলেন না।’ ‘কিন্তু তুমি তো মরছ না। অভিনয় করেছ।’ আমার কথাতে ডায়না খুব বেশি রেগে যায়। সে কী করবে বুঝতে পারছে না। হয়তো সে ভাবছে শরীরে বস্ত্র অবারিত করবে। কিন্তু সেটা সে করবে না। কেননা, এতটা নির্বোধ সে নয়। ভেজা শরীর নিয়ে ডায়না নৌকাতে দাঁড়িয়ে আছে। আমি বৈঠা হাতে নিলাম। ডায়না আমার হাত থেকে বৈঠা কেড়ে নেয়। এবং বলে, ‘আজ সারা রাত আপনার সঙ্গে এই নদীর মাঝে থাকব।’ আমি বললাম, ‘আমার যে থাকতে ইচ্ছা হচ্ছে না।’ জলের স্পর্শে ডায়না হয়ে উঠেছে একজন কামনাময়ী। জলের এই এক গুণ। যা সবাইকে অতি সুন্দর ও রূপবতী করে তোলে। ‘মুরাদ ভাই?’ কিছু না বলে নৌকা পাড়ে ভেড়াই। ডায়নার পুরো শরীর ভেজা। আমার উচিত অন্তত তাকে শুকনা জামার ব্যবস্থা করে দেওয়া। নৌকার মালিকের কাছে কাপড় চাইলাম। কিছু টাকার বিনিময়ে জামা পাওয়া গেল। একটা অটোরিকশা করে ডায়নাকে তার গন্তব্য স্থানে পাঠিয়ে দিলাম। যাওয়ার আগে ডায়না আমার কাছে দুইবার হাত ধরে ক্ষমা চেয়েছে। আমার বোধ হয় সোনারগাঁও হোটেলে যাওয়াটায় ঠিক ছিল। কিন্তু ডায়নার রূপের আলোতে নিজেকে ভুলিয়ে নিলাম। যে আলো নয়, আসলে আলেয়া। কিন্তু আমার মনে একটা নাম মাঝেমধ্যে উঁকি দেয়। তার নামটাও যে আলো! যাকে ঘিরে অতি অভিমানে আরেকটা শব্দ উচ্চারণ করতে বাধ্য হই। সেটা হলো ছলনাময়ী। কী অদ্ভুত দৃশ্য। এত সুন্দর জোছনা। এত সুন্দর পৃথিবী। প্রকৃতির এমন রূপ দেখে হাসতে হাসতে মৃত্যুর কোলে নিজেকে সঁপে দেওয়া যায়। ঠিক এমন সময়ে ডায়না তার রূপের ফাঁদে আমাকে জড়াতে চেয়েছিল। হে ঈশ্বর, হে ভুবনের অধিকারী, হে প্রকৃতি তুমি মোরে সুধাও, কেন তোমার রূপ দেখে সবাই মুগ্ধ হয় না? রুমেলের ফোন। কী বলব ওকে। মেয়েটির সঙ্গে তো দেখা হয়নি। ‘ওহে বন্ধু, আমি একটা কাজে আটকা পড়েছিলাম।’ ওপাশ থেকে রুমেল বলল, ‘ওকে নো প্রবলেম, আমি তোকে নম্বর টেক্সট করছি, দেখ।’ ‘ঠিক আছে দে।’ ‘ইউ কল নাউ। টক টু মি।’ কী আর করা। আমি নম্বরটিতে কল করি। ওপাশ থেকে রিসিভ করা হয়নি। আবার কল করি। রিসিভ করেনি। হায় রে ছলনাময়ী! ছলনাময়ীরা বুঝি এমনই হয়। এই জগৎ–সংসারে কত রঙের মানুষ বাস করে। আরও কত কী? ফোনটা বেজে ওঠে। রুমালের সেই মেয়েটি ফোন করেছে। আমি দুইবার কল করেছি। রিসিভ করেনি। এখন আমিও রিসিভ করব না। না করি। না করব না। অবশেষে প্রথম কলটার শেষ অংশে এসে রিসিভ করা হলো। ‘হ্যালো কে বলছেন?’ ভেতরটা মুচড়ে ওঠে। কণ্ঠটা খুব বেশি পরিচিত মনে হচ্ছে। কে সে? আলো নয় তো! ‘কী হলো, কথা বলছেন না যে।’ এতটা অবাক হওয়ার কিছুই নেই। আলোই সে। অবশেষে আলোকে ভালোবাসে রুমেল! এই হলো অবস্থা। ‘যদি কথা না–ই বলেন, তাহলে কল করেছেন কেন?’ ‘কেমন আছেন?’ ‘কে? মুরাদ বলছ না।’ ‘কীভাবে চিনলে?’ ‘তুমি আমার এই নম্বর পেলে কোথায়?’ ‘কেন নম্বরটি কি খুব বেশি পারসোনাল?’ আলো চুপ, কিছু বলছে না। ছলনাময়ী তুমি। তবু তোমাকেই ভাবা হয়। ‘কেমন আছো মুরাদ?’ ‘আমি ভালো আছি। আচ্ছা শোনো। তোমাকে একটা ছেলে খুব বেশি ভালোবাসে। তুমি কেন তাকে পছন্দ করো না। সেটা কি জানতে পারি?’ ‘কই আমি তো জানি না।’ ‘রুমেল নামের একটা ছেলে...’ ‘ও...। তুমি ওর হয়ে কথা বলতে চাও।’ ‘হুম সোনারগাঁও হোটেলে যাওয়ার কথা ছিল।’ ‘ও আচ্ছা, তাহলে তোমার আসার কথা ছিল। আমি অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছি। অবশেষে চলে এসেছি।’ ‘তুমি তো ছলনাময়ী, তাই তোমার সঙ্গে দেখা হোক প্রকৃতিও চায় না। অথচ তোমাকে দেখতে মন চায়।’ ‘এলে অনেক ভালো হতো, কত দিন তোমার সঙ্গে দেখা হয় না।’ ‘এলে কী হতো?’ ‘তোমাকে দেখতাম।’ ‘বুকের ওপর থেকে আঁচলটা সরাতে না বুঝি..!’ ওপাশ থেকে আলো চুপ। কোনো কথা বলছে না। আমার বোধ হয় কথাটা বলা ঠিক হয়নি। আমিও যে কী! মুখে যা আসে বলে ফেলি। অথচ এই জগতের কিছু নিয়ম আছে। কিছু কথা অতি সত্য হলেও বলতে নেই। ‘আচ্ছা আলো, তুমি কি রুমেলকে বিয়ে করবে?’ আলো হেসে দিল। আমি তারবিহীন যন্ত্রের মাধ্যমে আলোর চারপাশ অনুভব করছি। মেয়েটি নিশ্চয়ই এখন শুয়ে আছে। পাশের জানালা দিয়ে চাঁদের আলো উঁকি দিচ্ছে। কিন্তু সেই আলোটা এই অভাগী মেয়েটি দেখছে না। আমি বুঝি না, এত সুন্দর চাঁদ, চাঁদের আলো না দেখে মানুষ কী করে বাঁচে... আলোর মিষ্টি কথা বাতাসে ভেসে আসছে, ‘কী হলো, কথা বলো।’ আমি আবার রুমেলের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। আলো জানাল, সে আর রুমেলের বিষয়ে কোনো কথা বলতে চায় না। সে কিছুক্ষণ কথা না বলে থাকতে চায়। ফোনটাও রাখতে দেবে না। সে আজ তারবিহীন যন্ত্রের মাধ্যমে আমাকে বুঝবে। আমার শ্বাস–প্রশ্বাসের শব্দ অনুভব করবে। এইটুকু অনুরোধ সে করেছে। আলোর এ–জাতীয় কথা শুনে আমি হারিয়ে যাই এক অন্য ভুবনে। হে দয়াময়, তুমি আমাকে এ কোন মায়াজালে জড়ালে। এ কোন ছলনাতে আমাকে আবদ্ধ করলে। আলোর ফোনটা কেটে দিলাম। এত মায়া আমার সয় না। জানালা দিয়ে চাঁদটাকে দেখছি। চাঁদের আলোয় নিজেকে উজ্জীবিত করছি। কবি ভুল বলেনি, ‘ও কারিগর, দয়ার সাগর, ওগো দয়াময় চান্নি পসর রাইতে যেন আমার মরণ হয়...’ সত্যি, এমন রাতে মৃত্যুকে হাসি মুখে বরণ করতে আপত্তি নেই। *লেখক: এম হৃদয়, বুকিত পাঞ্জাং সিঙ্গাপুর।