ছলনাময়ী-৩
মাঝরাতে ঢাকার শহরের সৌন্দর্য ফুটে ওঠে। ব্যস্ত এই নগরীতে নীরবতা দেখার মাঝেও আনন্দ আছে। একেবারে যে জনশূন্য, সেটা বলা যাবে না। এখনো একটা–দুইটা যানবাহনের যাতায়াত চোখে পড়ে। আর মানুষের চলাচল তো আছেই। ব্যস্ত এই নগরীতে সর্বক্ষণ মানুষ ব্যস্ত থাকে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে তিনজন–চারজন পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে। এরা প্রশাসনিক নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য রাত জেগে পাহারা দিচ্ছে। তবে চিন্তার বিষয় ওরা কি মানুষকে নিরাপত্তা দেয় নাকি অন্য কিছুও করে। কে জানে? মাঝেমধ্যে এই খবরও কানে আসে সাধারণ মানুষকে একা পেয়ে টাকাপয়সা হাতিয়ে নিল পুলিশ। এই কাজটা করতেও পুলিশের দ্বিধা হয় না! আবার পুলিশের সুনামও আছে। ভালো–মন্দ নিয়ে তো জীবন চলে। তবে পুলিশের ক্ষেত্রে মন্দ কাজটা করা পুরোটাই বেমানান। কারণ, পুলিশের কাজ শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা করা। সুতরাং রক্ষক যদি ভক্ষক হয়, তাহলে অশান্তির অন্ত থাকে না।
আজকের রাতটা শহরের পথ ধরে হেঁটে কাটিয়ে দিলে মন্দ হবে না। সেটা বোধ হয় আর হলো না। কেননা পকেটে মোবাইল বেজে ওঠে। অনেক দিন পর বন্ধু রুমেলের ফোন। বড়লোক বাবার একমাত্র সন্তান। আজ হঠাৎ তার ফোন। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে রুমেল বলে,
‘কী খবর মুরাদ? কেমন আছিস?’
‘ভালো আছি বন্ধু। তারপর এত রাতে ফোন?’
‘আরে শোন, তোর কথা খুব মনে পড়ল। তাই দেরি না করে ফোন দিলাম।’
‘ও আচ্ছা। আমার কথাও মনে পড়ে তাহলে।’
‘এই কথা প্যাঁচাবে না। আচ্ছা শোন, তুই এখন কোথায় আছিস? কী করছিস?’
‘আমি পুরানা পল্টন হাইওয়ে রাস্তা দিয়ে হাঁটছি।’
‘কী! এত রাতে তুই হাঁটছিস! তোকে বুঝা দায়। যা–ই হোক ভালোই হলো। আমি জিরো পয়েন্টে আছি। তুই এক কাজ কর, জিরো পয়েন্ট চলে আয়।’
‘আসব?’
‘কাম টু মি, প্লিজ...’
রুমেল ড্রাইভ করছে। পাশের সিটে বসে রুমেলের কথা শুনছি। চমৎকার ছেলে রুমেল। মামা স্বাস্থ্যমন্ত্রী। নাম সোহরাব খান। ভদ্রলোক খুব ঘাড়ত্যাড়া টাইপের। একদিন রুমেলের সঙ্গে যাওয়া হয় সোহরাব খানের কাছে। আমি সুযোগ বুঝে বলেছিলাম,
‘বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবার কোনো উন্নতি হচ্ছে বলে তো মনে হচ্ছে না আঙ্কেল।’
সোহরাব খান চোখ বড় বড় করে বলেছিল,
‘সেটা তোমার ভাবতে হবে না। কোথায় থেকে আসে এসব?’
সোহরাব খানের রিপ্লাই শুনে যেকোনো মানুষের রাগ বেড়ে দ্বিগুণ হবে। আমিও রেগেছি। তবে ভেতরে, বাহিরে সাদামাটা একজন প্রাণ।
‘সরি স্যার। আমি তো আপনার সঙ্গে কথা বলার কোনো যোগ্যতাই রাখি না। তারপর আবার সত্য কথা বলে ফেলা, এই জগতে সত্য বড় অসহায়, মিথ্যার জয়ধ্বনি।’
‘এই ছেলে কী বলছ এসব। সত্য অসহায় মিথ্যার জয়ধ্বনি! মানে কী?’
ওনার সঙ্গে কথা বলতে একদমই মন চাইছে না। এড়িয়ে যাওয়ার জন্য একগাল হেসে উঠি আমি। সোহরাব খান আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বলে,
‘আচ্ছা তোমার নামটা যেন কী?’
‘মুরাদ।’
‘আচ্ছা মুরাদ তুমি তো আমাকে আঙ্কেল ডাকতে, হঠাৎ স্যার বলে ডাকছ, কারণটা কী জানতে পারি?’
কারণ বলার আগেই রুমেল চলে আসে। সোহরাব খানের হাতে একটা কাগজের ফাইল দিয়ে দুজন একসঙ্গে বেরিয়ে পড়ি।
রুমেল এখন চুপচাপ ড্রাইভ করছে। রুমেলের মধ্যে কোনো চেঞ্জ নেই। বাবা কোটিপতি, মামা মন্ত্রী। দেশ–বিদেশে ঘুরেফিরে সময় কাটায়। তারপরও মানুষের প্রতি তার আলাদা একটা দরদ কাজ করে। মানুষের বিপদে মানুষের পাশে থাকতে পছন্দ করে। বড়লোকদের এমন মানবিকতা আমাদের দেশে নেই বললেই চলে। কে রাখে কার খবর। তবে আজকে রুমেলকে একটু অন্য রকম লাগছে। মনে হয় সে আমাকে কিছু বলতে চায়।
‘মুরাদ তোর সঙ্গে একটা বিশেষ কথা শেয়ার করতে চাই। জানি না কথাটা শোনার পর তুই কীভাবে নিবি।’
রুমেলের কথা শোনে থমকে গেলাম। একটু আগে হাসিঠাট্টার অন্ত ছিল না। হঠাৎ এতটা নীরব হয়ে গাম্ভীর্যের সঙ্গে কথা বলছে কেন। নিশ্চয় প্রেম বিষয় কোনো কথা বলতে চায় সে। কিন্তু প্রেম সে তো আনন্দের বার্তা। এমনটা হলে তো সে হাসতে হাসতেই বলতে পারে! রুমেল বলে ওঠে,
‘কী ব্যাপার, তুই চুপচাপ। কিছু ভাবছিস নিশ্চয়?’
‘আচ্ছা বল কী কথা?’
‘আমি একটা মেয়েকে ভালোবাসি।’
‘আরে সে তো ভালো কথা। তোর জীবনে তাহলে প্রেম এল। আসবেই তো। প্রেম ছাড়া মানবজাতি বাঁচতে পারে না। প্রেমে সৃষ্টি এই ইহকাল। কিন্তু এই কথাটা বলতে তোর মধ্যে একটা দ্বিধা কাজ করছে। সেটা আমি বুঝতে পারছি।’
‘মুরাদ তুই ঠিক ধরেছিস। কারণ আমি যে মেয়েকে ভালোবাসি সে সাধারণ মেয়ে নয়।’
‘তুই তো সাধারণ না। কোটিপতি বাবার একমাত্র ছেলে।’
‘মেয়েটা একটা কলগার্ল। কিন্তু আমি তাকেই ভালোবেসে ফেলেছি।’
কলগার্ল শব্দটা শুনে আলো নামের মেয়েটির কথা মনে পড়ে গেল। একটা চমৎকার মেয়ে। যার চোখের দিকে তাকিয়ে শত বছর কাটিয়ে দেওয়া যায়। এত সুন্দর একটা মেয়ে, যার কথা শুনে আমার ভেতরে অনুরাগ উঁকি দিয়েছিল, যার হাসিতে যেন মুক্ত ঝরে। সেই মেয়েটি কি না কলগার্ল। প্রকৃতির নিয়ম বোঝা বড় দায়।
‘কী ব্যাপার মুরাদ, কী ভাবছিস?’
‘ভাবছি তোর নজর হঠাৎ কলগার্লের দিকে গেল কেন?’
‘সে অনেক কথা। একদিন সময় করে বলব।’
‘মেয়েটির নাম কী?’
‘ওর নাম শিখা।’
‘আসল নাম কী?’
‘মুরাদ কী বলছিস তুই। মেয়েটির নামই শিখা। একটা মেয়ের কয়টা নাম থাকতে পারে?’
‘অনেকগুলো।’
‘মানে?’
‘শোন রুমেল এসব মেয়ের একাধিক নাম থাকে। তারা কখনো আসল নাম কাউকে বলে না। এই জন্য বললাম মেয়েটির আসল নাম কী?’
‘মুরাদ তোর কথা হয়তো সঠিক। কিন্তু আমার শিখা ও রকম মেয়ে না। যাহোক আমি শিখাকে ভালোবাসি, শিখাকে চাই। এই বিষয়ের তোর হেল্প লাগবে।’
‘হেল্প?’
‘হুম। শিখা আমাকে ভালোবাসে না। আমি তাকে অনেক বুঝিয়েছি। সে বুঝতে চায় না। তুই একটু ওকে বুঝিয়ে বললে শিখা আমাকে ভালোবাসতে বাধ্য হবে।’
‘রুমেল কী বলছিস তুই। এমন একটা মেয়েকে পছন্দ করলি, ভালোও বাসলি, অথচ মেয়েটি তোকে পছন্দ করে না!’
‘প্লিজ বন্ধু তোকে এই মেয়ের নম্বর দিচ্ছি। আমি ফোন করে তোকে সময়টা বলে দেব তুই ওর সঙ্গে দেখা করে নিবি।’
‘ওকে, ঠিক আছে ফোনে কথা হবে। আমাকে সামনে নামিয়ে দে।’
পড়ন্ত বিকেল। হাঁটতে বেশ ভালো লাগছে। আকাশটা ধবধবে সাদা। একটুও নীলের আবাস নেই। তবু গুণীজনেরা স্বীকৃতি দিয়েছে আকাশ নীল। গত কয়েক দিন আলোর সঙ্গে কথা হয় না। সে বোধ হয় খুব বেশি ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। হবেই তো ওর মতো রূপবতী মেয়ে এই শহরে আর কয়টা আছে। রূপযৌবনের ব্যবসায় সে এক নম্বরে থাকার কথা। আসলে কি সে একে আছে? একবার আলোকে ফোন করে জিজ্ঞেস করব, যে আলো তুমি যে দেহ ব্যবসা করো, এই শহরে তোমার মতো তো আরও অনেকে আছে। এদের মধ্যে নিশ্চয় তুমি নম্বর একে আছ। আচ্ছা, এই প্রশ্নের জবাবে আলো কী বলবে? নাহ একবার ফোন করে দেখি কী বলে। একবার না দুইবার ফোন করেছি। আলো ফোন রিসিভ করেনি। মেয়েটা বড্ড ব্যস্ত থাকে। এক কাপ চা খেলে ভালো লাগবে।
নবাবপুর রোডে ছোট্ট একটা চায়ের দোকানের সামনে এলাম। একটা ছোট্ট ছেলে বানিয়ে দিচ্ছে আর মানুষজন দাঁড়িয়ে চা পান করছে। ছোট্ট একটা বসার টুলও আছে। যেটাতে দুজনের বেশি বসা যাবে না।
‘ভাইজান, আপনি মুরাদ ভাইজান না।’
চায়ের দোকানের ছোট্ট ছেলেটির কথা শুনে আমি অবাক৷ এই ছেলের সঙ্গে আগে কখনো দেখা হয়নি। এই দোকানের একজন মুরুব্বির সঙ্গে মাঝেমধ্যে আমার কথা হতো।
‘ভাইজান আপনি আমারে চিনবেন না। আব্বা আপনার কথা অনেক কয়। বহেন, এক কাপ চা খান।’
‘তুমি আমাকে চিনলে কী করে?’
‘আব্বা আপনার কথা খুব কয়। আপনি আব্বারে একবার বিশ হাজার টাকা দিছিলেন। যার জন্য দোকানটা আজও আছে।’
আসলে মিন্টুর বাবাকে বিশ হাজার টাকা আমি দিইনি। টাকাটা দিয়েছিল রুমেল। আমার হাতে দেওয়ায় মিন্টুর বাবার কাছে আমি অনেক কিছু। চা খেলাম। মিন্টুর সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বললাম। কত ভালো ছেলে মিন্টু। ক্লাস সেভেনে পড়ছে, পাশাপাশি বাবার ব্যবসায় সময় দিচ্ছে। আসলে আমাদের দেশের প্রতিটি ছেলেমেয়ের উচিত পড়াশোনার পাশাপাশি বাবা–মায়ের কাজে হাত লাগানো। কিন্তু সেটা হচ্ছে না। অবসরে নেটের জগতে সময় কাটাচ্ছে। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখি আলো সাতবার কল করেছে। কল দিলাম।
‘হ্যালো মুরাদ, কতবার কল করছি, তুমি রিসিভ করছ না কেন?’
‘সরি ডার্লিং...।’
আমার মুখে ডার্লিং শব্দটা শুনে আলো বোধ হয় রীতিমতো অবাক হয়েছে। কেননা আলো আমাকে খুব বেশি পছন্দ করে। ভালোবাসে কি না সেটা জানি না। কারণ ওর সঙ্গে ফোনে পরিচয়। ফোনে তো কত মানুষের সঙ্গে কথা হয়। কিন্তু আমার বিষয়টা নাকি আলাদা। ও বলে আমার কথার মধ্যে নাকি আলাদা একটা মায়া আছে। যা ভুলে থাকা দায়। তবে আজ আলো খুব বেশি খুশি, ডার্লিং ডেকেছি বলে। সেই আনন্দে হয়তো চোখের কোণে খানিকটা অশ্রুপাত হবে।
‘কী হলো, কথা বলো।’
‘কী বলব?’
‘কেন ফোন করেছ, সেটা বলো।’
‘কেন ফোন করেছি?’
‘বাহ মনে হচ্ছে আজ তোমার মনটা খুব খুশি।’
‘হ্যাঁ অনেক খুশি। কিন্তু কেন খুশি, সেটা বলা যাবে না। সো আমাকে প্রশ্ন করো না, আমি খুশি কিংবা আনন্দিত কেন?’
আমি একগাল হেসে বলি, ‘তুমি কোথায় আছ?’
‘আমি মগবাজারে আছি।’
আলো মগবাজারে আছে। ভাবছি এখন কী জিজ্ঞেস করব, যে এই শহরে দেহ ব্যবসায়ীদের মধ্যে আলো তুমি কত নম্বর। অবশ্যই উত্তরটা আমার জানা, তারপরও তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই। না থাক এমন কথা বলাটা বোধ হয় সুন্দর হবে না। তা ছাড়া উত্তরটা তো আমার জানাই আছে। এক নম্বর।
ফোনটা বেজে উঠল, আলোর ফোন।
‘হ্যালো মুরাদ তুমি কী বলো তো। কতবার হ্যালো হ্যালো বলে যাচ্ছি, তুমি কিছু বলছ না।’
‘আসলে ফোনটা হাতে নিয়ে তোমার কথা ভাবছিলাম।’
আলো খুশিমনে বলে, ‘কী! আমার কথা ভাবছিলে।’
‘হ্যাঁ, তোমার কথায় ভাবছিলাম। তুমি কত সুন্দর। তোমার রূপের কাছে এই ভুবনের সকল সৌন্দর্য হার মানবে। তুমি হলে এই শহরের নাম্বার ওয়ান।’
‘ছাড়ো এসব কথা। মিথ্যে বলে আমাকে খুশি করাতে হবে না। তুমি আসো না একবার আমি তোমাকে দেখতে চাই।’
‘আমি তো আসতে চাই। কিন্তু আমি জানি তুমি থাকবে না। কারণ তুমি তো তুমি না। তুমি হলে ছলনাময়ী।’
‘তুমি আসো। আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করছি।’
‘আচ্ছা আমি আসব। শোনো আমার কাছে ভাড়া নেই। অটোরিকশা নিয়ে আসছি। তুমি টাকা রেডি রেখো।’
আমারও খুব ইচ্ছে হচ্ছিল আলোকে দেখতে। আজ ইচ্ছের জয় করার জন্য ছুটে চলছি। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। রাত হলেও সমস্যা নেই। অনেকটা পথ পেরিয়ে মগবাজারে চলে এলাম। অটোর ড্রাইভার ভাড়া চাইছে। আমি ড্রাইভারকে বললাম,
‘আমার কাছে কোনো টাকা নেই।’
ড্রাইভার ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘কী কন ভাই!’
‘তয় চিন্তা করো না, আমি দেখছি। এখনই ভাড়া পেয়ে যাবে।’
অনেক ভিড়। মানুষের অনেক সমাগম। এর মধ্যে এদিক–ওদিক তাকাচ্ছি। আলোকে দেখতে পাচ্ছি না। একটু সামনে এগোতে চাইলেই ড্রাইভার উচ্চকণ্ঠে বলে,
‘ভাইজান...?’
‘এই বেটা রাখ, ঘটনা অন্য রকম হইয়া গেছে। আমি যারে খুঁজতাছি, সে তো নাই!’
ড্রাইভার চোখ বড় বড় করে বলে, ‘দেখেন ভাইজান, আমি কিন্তু অহন মানুষ জড়ো করমু। তহন বুঝবেন ঠেলা কারে কয়।’
‘আরে গাধার বাচ্চা গাধা, মানুষ দিয়ে মাইর দিলে কি তোর টাকা পাবি। পাবি না। একটু অপেক্ষা কর, দেখি কী করা যায়।’
ফোনেও পাচ্ছি না। একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ি, আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে। সেটাও পারছি না। সঙ্গে থাকা অটোরিকশা ড্রাইভার যন্ত্রণা করছে। করবেই তো, বেচারা ভাড়া তো আর দিতে পারছি না। হায় রে ছলনাময়ী।
রাত বাজে নয়টা। অটো ড্রাইভার ও আমি একসঙ্গে বসে আছে টিএসসিতে। পাঁচ ঘণ্টা ধরে ড্রাইভার হালিম আমার সঙ্গে আছে। সব মিলিয়ে ২০০ টাকা দিলেই হয় হালিমকে। কিন্তু হালিম বলছে, ১০০ দিলেই হবে। বেচারা আমার কাছ থেকে ছুটতে পারলেই বাঁচে।
‘হালিম সাহেব চলেন ফুচকা খাই।’
হালিম ভুরু কুঁচকে বলে, ‘আপনার কাছে কোনো টাকা নাই ফুচকা খাবেন কী দিয়া।’
‘আমার কাছে নেই বলে কী হইছে আপনার কাছে তো আছে! দুইজন মানুষ অনেকক্ষণ ধরে একসঙ্গে আছি, একটু মায়া মহব্বত তো হওয়ার কথা। বলেন দুই প্লেট ফুচকা দেওয়ার জন্য।’
‘ভাইজান দেহেন, অনেকক্ষণ ধরে আমি আপনার সাথে আছি। আমি বুঝতে পারছি আপনি অনেক বড় একটা ধান্ধাবাজ। আমার ভাড়া তো দেনই না। আবার আমার পকেট খালি করতে চান।’
‘শুনেন, রাগ করবেন না। আমারও খিদে লাগছে, আপনারও খিদে আছে। আগে খেয়ে নিই, তারপর হিসাব–নিকাশ করা যাবে। দেন দেন ফুচকার অর্ডার দেন।’
‘ভাইজান আমার কোনো টাকাপয়সা লাগত না। আমি এখন চলে যাই।’
‘এই শোনেন আপনি কোথাও যাবেন না। ভাড়া নিয়ে যাবেন।’
‘আমার ভাড়া লাগত না।’
বলেই যেতে চাইল। আমি হাতের মধ্যে চট করে ধরে ফেলি। হালিম চিৎকার দেয়। কয়েকজন ছুটে আসে হালিমের কাছে। হালিম বলে,
‘এই লোকটা আমার ভাড়া দেয় নাই। এখন যেতেও দিচ্ছে না।’
একজন বলে ওঠে, ‘এই মিয়া সত্যি নাকি?’
আমি বলি, ‘হ্যাঁ সত্যি। তার আগে আমার কয়েকটা কথা শোনেন, তারপর দেখবেন কোনো ঝামেলা থাকবে না। ও আমার মামাতো ভাই। নাম হালিম। গ্রামের বাড়িতে ওরে একবার একটা থাপ্পড় দিছিলাম, সেই থেকে ও আমার ওপর রাগ করে আছে।’
হালিম উচ্চকণ্ঠে বলে ওঠে, ‘মিথ্যা কথা, ঢাহা মিথ্যা কথা। ওই লোক আমার কেউ না।’
‘দেখুন একটু আগেও ও আমাকে বলছে, সবাইকে বলবে যে আমি ওর কেউ না। অথচ, দেখুন ওর হাতে ১০০ টাকার একটা নোট দিয়ে বললাম, ফুচকার অর্ডার কর। সে টাকা পকেটে রেখে চলে যাচ্ছে। এখন আমি কী করি বলেন তো?’
হালিম চিৎকার করে বলে, ‘ও ভাই গো ওরে আমি চিনি না গো, আমারে ওই লোকের হাত থেকে তোমরা বাঁচাও।’
একজন মুরুব্বি বলে, ‘আচ্ছা শোনো বাবা আসল কথায় আসি, এই অটো ড্রাইভার যে তোমার মামাতো ভাই, এর প্রমাণ কী?’
‘দেখুন চাচা মিয়া, এ মুহূর্তে আমি যদি পরিবারের নাম–ঠিকানা বলি, এই সবকিছু হালিম অস্বীকার করবে। তা ছাড়া আপনারা ওকে চিনবেন না। তার চেয়ে বরং তাৎক্ষণিকভাবে কিছু প্রমাণ দিই, সেটা হলো ওকে আমি ফুচকার জন্য ১০০ টাকার একটা নোট দিই, যে নোটটা সে পকেটে রাখে। ওর গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জ। ও গত পাঁচ ঘণ্টা ধরে আমার সাথে আছে।’
এই কথার পর, একজন ড্রাইভারকে বলে, ‘তোমার নাম কী?’
হালিম বলে, ‘আমার নাম হালিম সত্য, কিন্তু হে আমার কেউ না।’
আরেকজন বলে, ‘তুমি উনার সাথে কতক্ষণ আছ?’
হলিম বলে, ‘চার–পাঁচ ঘণ্টা। কিন্তু হে আমার...।’
কেউ হালিমের কথা শুনতে চায় না। হালিমের পকেটে হাত দিয়ে দেখে ১০০ টাকার একটা নোট ঠিকই আছে। নোটটা মুরাদ নিয়ে নেয়। গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জ, সেটাও ঠিক আছে। অবশেষে সবাই দুজনকে এক করে চলে যায়।
‘মানুষজন সবাই চলে গেছে। চুপচাপ বসে থাকো। আবার চলে যেতে চাইলে খবর আছে। দেখলে তো তোমার পকেটের টাকা কত সহজে আমার হাতে চলে এল। এবার যাও ফুচকা নিয়ে আসো।’
দুজনে ফুচকা খাচ্ছি। হালিমের মনে প্রচণ্ড ভয়। না জানি কী হয়। এরই মধ্যে মেসেজের রিংটোন বেজে ওঠে। বিকাশে দুই হাজার টাকা আসে। আমাকে টাকা পাঠানোর মতো অনেকে আছে। কিন্তু কেউ পাঠাবে না। একমাত্র আলো ছাড়া।
‘হায় রে ছলনাময়ী।’
ছলনাময়ী শব্দটা শুনে হালিম আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। ভেতরের ভয়টা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারছে না হালিম।
‘কিরে ভয় পাচ্ছিস? ভয় পাবি না। আমি অতি সামান্য সাধারণ মানুষ। আমাকে ভয় পাওয়ার কিছুই নেই। আচ্ছা এবার বল তো, আমার সাথে আছিস কতক্ষণ ধরে?’
হালিম কিছু বলছে না। আবারও বললাম। এবার ধমক দিয়ে বললাম। হালিম কেঁদে বলে, ‘৫–৬ ঘণ্টা হবে। ভাইজান আমার কোনো টাকাপয়সা লাগত না। আমারে ছাইড়া দেন।’
‘৬ ঘণ্টা সময়ে কতকটা ইনকাম করতে।’
‘এইতো তিন শ হতো আবার চার শ...’
হালিমের অটো দিয়ে একটা বিকাশ এজেন্ট দোকানের সামনে চলে আসি। অটোরিকশার চাবিটা হাতে নিয়ে বিকাশের দোকানে প্রবেশ করি। হালিম অটোতে বসে আছে। খানিকক্ষণ পরে হালিমের হাতে দেড় হাজার টাকা দিয়ে বললাম,
‘চলে যা। মানুষকে এতে ভয় পাবি না।’
হালিম দেড় হাজার টাকা হাতে নিয়ে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ভেতরে এক সমুদ্র ভয় নিমেষে বিলীন হয়ে গেছে। তার বলতে ইচ্ছে হচ্ছে ভাই আমার বড় ভুল হয়ে গেছে। আমাকে ক্ষমা করে দেন। কিন্তু কিছুই বলতে পারল না হালিম। শুধু বিস্মিত হয়ে আমাকে দেখছে। সৃষ্টিকুলে মানুষ কত বিচিত্র হয়। হয়তো হালিম সেটাই ভাবছে। বেশ কয়েক ঘণ্টা যুবক ছেলেটি আমার সঙ্গী ছিল। এখন সে তার নিজ গন্তব্যে চলে যাবে।
‘কী হলো, চলে যা। বাসা গিয়ে গোসল করে খেয়েদেয়ে লম্বা একটা ঘুম দে। আমি এখন আর তোর সঙ্গে থাকতে পারব না। এখন আমি একদম একা হয়ে যাব। আকাশের দিকে দৃষ্টি দেব। শূন্যে হারিয়ে যাব। আর ভাবব একজনকে। কেন সে আমাকে ফাঁকি দেয়। কেন সে ছলনাময়ী হয়ে বাঁচে।’
হালিমের অটো স্টার্ট হলো। চলল অটো। আমিও চললাম। দুজন দুদিকে। একজন ইঞ্জিলচালিত যানবাহনে, আমি পায়ের ওপর ভর করে। একজন মনে প্রশান্তি আর আমি মনে অশান্তি–প্রশান্তি দুটোকে বহন করে হাঁটছি। আচ্ছা, দেখি আলোকে ফোনে পাওয়া যায় কি না। নাহ ফোনটার সুইচ অফ।
‘যে বুঝে না তার রূপের মর্ম, সে করে তাকে উলঙ্গ,
যে বুঝে তার রূপের মর্ম, সে ছুঁতে পারে না অঙ্গ...’
* লেখক: এম হৃদয়, গল্পকার, বুকিত পাঞ্জাং, সিঙ্গাপুর