ছলনাময়ী
বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছি। হঠাৎ টুং টুং শব্দ। মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখি, ৫০ টাকার রিচার্জের একটা মেসেজ এসেছে। একজন বলল, ‘কিসের মেসেজ, বন্ধু।’
‘আমিও বুঝতে পারছি না। কেউ আমাকে ৫০ টাকা লোড দেওয়ার কথা না। কেউ মনে হয় ভুলে আমার নম্বরে টাকাটা পাঠিয়েছে।’
আরেকজন হাসিমুখে বলে, ‘বাহ, কী ভাগ্য তোর।’
বিকেলের আড্ডা শেষে বাসায় ফিরলাম। রাত দশটা বাজে। জহির রায়হানের ‘শেষ বিকেলের মেয়ে’ উপন্যাসটা হাতে নিলাম। উপন্যাসের পাতা ওল্টাচ্ছি। টুং টুং...। মোবাইলের মেসেজে লেখা, ‘ভুলে বিকেল পাঁচটার দিকে আপনার নম্বরে ৫০ টাকা চলে গেছে। দয়া করে টাকাটা এই নম্বরে রিচার্জ করে দেবেন, প্লিজ... ।’ আমার নম্বরের শেষে শূন্য, ওনার নম্বরের শেষে আট। তার মানে শূন্য আট মোবাইল সেটের কাছাকাছি সংখ্যা। আমি একটা রিপ্লে দিলাম। ‘আমার কাছে পঞ্চাশ টাকা নেই।’ আর কোনো মেসেজ এল না।
বেশ কিছুদিন পর। ওই নম্বরে কল করি। ওপাশ থেকে একটা মেয়ে কণ্ঠ, ‘কে বলছিলেন।’
আমি খানিকটা হকচকিয়ে বলি, ‘ভুলে গেছেন বোধ হয়। আমার মোবাইল নম্বরে আপনি ৫০ টাকা পাঠিয়ে ছিলেন।’
মেয়েটি বলল, ‘ও আচ্ছা, চিনতে পেরেছি। টাকাটা কী আপনি আমাকে দিতে চান?’
জি।
আপনি চাইলে পরেও দিতে পারেন। না দিলেও সমস্যা নেই।
আপনি কী আমার ওপর রাগ করছেন?
রাগ করব কেন?
সেদিন মেসেজে টাকাটা চেয়েছিলেন। আমি দিতে পারিনি। আমার কাছে পঞ্চাশ টাকা ছিল না।
বুঝতে পেরেছি। সমস্যা নেই। আপনি আপনার সুবিধামতো টাকাটা রিচার্জ করে দিয়েন। এখন রাখি।
মেয়েটি ফোনটা রেখে দিল। কথা শুনে বোঝা যাচ্ছে মেয়েটি যথেষ্ট রূপবতী। সুন্দরী তো বটেই। পরের দিন বিকেলে পঞ্চাশ টাকা মেয়েটির মোবাইলে দিয়ে দিলাম।
রাতে মেয়েটির নম্বর থেকে কল আসে। মেয়েটি একটা হাসি দিয়ে বলে, ‘আপনাকে ধন্যবাদ।’
আমি বললাম, ‘স্বাগত হে...।’
‘মানে কী। আমি কী আপনার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছি।’
‘আসলে আমি আপনার কথার রিপ্লাই দিলাম। ইংরেজিতে কেউ যদি একজনকে বলে, থ্যাংক ইউ, পাশের জন রিপ্লে দেয়, ওয়েলকাম। ওয়েলকাম মানেই তো স্বাগত। তাই আপনাকে স্বাগত বলা।
মেয়েটি হেসে বলে, ‘বাহ তাই...।’
আচ্ছা, আপনি কথা বলছেন আর আপনার চুলে হাত বোলাচ্ছেন, তাই না।
মেয়েটি চুপ। কোনো কথা বলছে না। আমি বললাম, ‘কথা বলছেন না যে।’
মেয়েটি একটু অবাক হয়ে, ‘আসলে আমি ভাবছি, আপনি কী আমাকে দেখছেন। কেননা আমি সত্যি সত্যিই চুলে হাত ভোলাচ্ছি। আচ্ছা এটা কীভাবে বললেন?’
না এলে সুন্দরী মেয়েরা কথা বলার সময় প্রায়ই তারা তাদের চুলে হাত বোলায়।
বুঝতে পারছি আপনি মেয়েদের সঙ্গে খুব বেশি কথা বলেন এবং তাদের সঙ্গে সুন্দর করে করে কথা বলে তাদের মন চুরি করেন।
এমনটা কেন মনে হলো আপনার?
আপনি খুব সুন্দর করে কথা বলাতে।
একজন মানুষের সুন্দর কথার এই রেজাল্ট দিলেন আপনি।
মেয়েটি হেসে দিলেন। বললেন, এই মি., টাকা তো ফেরত দিলেন। এখন বুঝি আমাকে পটাতে চান।
মেয়েটার এই কথা আমার ভালো লাগেনি। ধন্যবাদ শব্দটা বলে ফোনটা রেখে দিলাম।
আবার ফোন। রিসিভ করতে ইচ্ছে হচ্ছে না। এরপরও রিসিভ করলাম। ওপাশ থেকে, ‘স্যরি...। আমি আসলে একটু মজা করছিলাম।’
আমি চুপ। মেয়েটি বলে, ‘প্লিজ, আমাকে ক্ষমা করবেন। সত্যি বলতে আমার জীবনটা আঁধারে গড়া তো। আনন্দ, হাসি, মজা করা—এসব বিষয় আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। অনেক দিন পর আপনার সঙ্গে কথা বলে খুব ভালো লাগছিল।’
আমি বললাম, ‘আঁধার জীবন বলতে...।’
কিছু মনে করবেন না। আমি আর কথা লম্বা করতে পারছি না। অন্য সময় কথা বলব।
আমি অবাক। মেয়েটির কথা শুনে। আমার মনে হচ্ছে মেয়েটি এই মুহূর্তে কাঁদছে। প্রকৃতির নিয়ম বোঝা বড় দায়। মানবজীবন, এই হাসি এই কান্না।
ইদানীং আমার মেয়েটির সঙ্গে খুব কথা হয়। আপনি থেকে তুমিতে চলে এসেছি। নামটাও জানা হয়েছে—আলো। আমার নামটা যদি চাঁদ হতো, তাহলে তো নামে নামে সন্ধি হতো, চাঁদের আলো। আলোর সঙ্গে দেখা করার তারিখ ফিক্সড হয়েছে। আগামী মাসের শেষ শুক্রবার বিকেল পাঁচটায় টিএসসিতে। সবকিছু ঠিকঠাক আছে। আমি আকাশি রঙের পাঞ্জাবি পরে আসব। আলো কলাপাতা রঙের শাড়ি পরবে। আমার চোখে কালো ফ্রেমের চশমা থাকবে। আলোর শ্যাম্পু করা চুলগুলো থাকবে ছড়ানো। হালকা বাতাসে যেন চুলগুলো ওড়ে। একবুক আশা নিয়ে মাসের শেষ শুক্রবার চলে এল।
ছুটির দিনে টিএসসিতে তরুণ–তরণীদের ভিড় একটু বেশি থাকে। আমি চলে এলাম। আলোকে দেখতে পাচ্ছি না। অপেক্ষা করছি প্রিয়ার মুখ দর্শন করব বলে। বিকেল পেরিয়ে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। কিন্তু আলো এখনো আসছে। আগে ঠিক করা দুজনের মোবাইল বন্ধ থাকবে। তাই ফোন করার প্রশ্নই ওঠে না। ছয়টা বাজতে চলল। বিষণ্ন মনে দাঁড়িয়ে আছি। মোবাইলটা ওপেন করে আলোকে কল করি। আলোর ফোন বন্ধ। একটা কালো পাজেরো গাড়ি এসে আমার সামনে থামল। গাড়ির ভেতর থেকে একটি মেয়ে আমাকে ডাকছে। আমি বললাম, ‘আমাকে ডাকছেন?’
মেয়েটি গ্লাসের ওপর হাত রেখে বলল, ‘জি, আপনাকে ডাকছি। আপনার নাম কি চাঁদ।’
আমি অবাক হই। এটা আমার নাম নয়। তবুও মজা করে আলোর সঙ্গে এই নামে পরিচিত হই। তবে আলো ছাড়া এই নামটা কেউ জানে না।
মেয়েটি বলল, ‘আসুন, গাড়িতে ওঠে বসুন।’
আমি উঠছি না। দাঁড়িয়ে আছি। মেয়েটি আবার বলল,
‘কী হলো, উঠুন। আমি আলোর বান্ধবী। আমার নাম ডায়না। আলো একটা বিপদে পড়েছে।’
বসে আছি বাংলা একাডেমির ভেতরে। পাশে ডায়না কথা বলে যাচ্ছে। ‘আলোকে কীভাবে চিনি। আলো কী করে, সেটা কি আপনি জানেন? আলো অসম্ভব ভালো এবং সুন্দরী একটা মেয়ে।’
আমি বলে উঠি, ‘সুন্দরী বটে, তবে সে একজন ছলনাময়ী, মিথ্যাবাদীও বটে।’
ডায়না ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে গলা নামিয়ে বলে, ‘কী বলছেন, ওরে তো আপনি দেখেননি, না দেখে একটা মেয়েকে ছলনাময়ী ও মিথ্যাবাদী বলা কি ঠিক হলো?’
‘কে বলল দেখিনি, সে তো আমার সামনেই আছে।’
ডায়না মুখটা নিমেষেই কালো হয়ে যায়। এদিক–সেদিক তাকিয়ে বলে, ‘কই আমি তো কাউকে দেখতে পাচ্ছি না।’
‘নিজেকে দেখতে পাচ্ছ না। যদিও অতি চালাক মানুষগুলো কখনো বোকাদের একজনও হয়।’
ডায়না চুপ করে বসে আছে। কিছু বলছে না। নিজের সঙ্গে আর পেরে উঠছে না। ডায়না বলল, ‘প্লিজ, কিছু মনে করবেন না। একটু বসুন আমি আলোকে নিয়ে আসছি।’ ডায়না চলে গেল। আমি ভাবছি, আলো কী করে? সেটা বোধ হয় এখন বুঝতে পারছি। বিশ্বাস করতে চাইছি না। আমার বিশ্বাস–অবিশ্বাসে তার কিছু যায়–আসে না। মানুষ তার নিজের কাজ করবেই। কিন্তু এটা তো মানুষের কাজ হতে পারে না। ভুল বললাম, এটাও মানুষের কাজ। এই শহরের কত মানুষ আছে, আশা আছে, স্বপ্ন আছে, কামনা আছে। সে হয়তো কারও কারও কামনার সোয়ারি হচ্ছে। মানুষকে আনন্দ দিচ্ছে।
কলাপাতা রঙের শাড়ি পরে ডায়না এল। চুলগুলো হালকা বাতাসে উড়ছে। আমি দেখছি তার সৌন্দর্যকে। আমি দাঁড়িয়ে বললাম, ‘ডায়না তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে।’
ডায়না হাসিমুখে বলল, ‘আমি ডায়না না চাঁদ। আমি আলো, তোমার চাঁদের আলো।’
‘হ্যাঁ, তুমিই আলো, তুমি ডায়না, তুমি মিতু, শিখা, কামনা। এই শহরের আঁধারের যাত্রী।’
আলো অবাক, সে বলল, আমি জানতাম চাঁদ, আমাকে তুমি ঠিকই চিনতে পারবে। মনে মনে নিশ্চয় তুমি আমাকে ঘৃণা করছ।
না তোমাকে কেন ঘৃণা করব। শেষ ভদ্রলোকটা বোধ হয় পশু ছিল। তোমার গলার লাল দাগটা তাই প্রমাণ করছে।
আলো ভাবছে, মানুষটা অবলীলায় সব বলে দিচ্ছে। হ্যাঁ, আজ বিকেলে যে পশুর সঙ্গে ছিলাম, সে আমাকে ছিঃ ছিঃ...।
আচ্ছা, আলো শোনো, আমার কাছে কোনো টাকা নেই, পঞ্চাশটা টাকা দাও। এখান থেকে রিকশা দিয়ে পুরান টাউনে যাব।
আমাকে নেবে না সঙ্গে?
তুমি তো আমার নও। তুমি তো বহুজনের। তুমি মহান। কই টাকাটা দাও।
পাপের টাকা তুমি নেবে?
পাপ! কিসের পাপ? এই পৃথিবীতে পাপ বলতে কিছু নেই। সবই প্রকৃতির খেলা।
আলোর কাছ থেকে পঞ্চাশ টাকা নিয়ে চলে যাচ্ছি। আলো দাঁড়িয়ে দেখছে আমায়। শহরের নিয়ন আলোয় আলোকে খুব বেশি রূপবতী লাগছে। যে রূপটা আমার জন্য নয়। অন্যজনের, অন্যদের...। আমি জানি, আলো এখন খুব কাঁদবে। আর কান্নার মধ্যে কল আসবে। অশ্রু মুছে আবারও সে পথে পা বাড়াবে।