চীনা খাবারের হরেক রকমের আয়োজন-৩
তরুণ প্রজন্মের ফাস্ট ফুডের প্রতি ঝোঁক আছে, তবে সেটা বিশেষ দিনগুলোয় (জন্মদিন, বিবাহবার্ষিকী)। এ ছাড়া মাঝেমধ্যে দোকানগুলোয় বড় ডিসকাউন্ট অফার করে, এ জন্য ম্যাকডোনাল্ড, কেএফসি, পিৎজা হাটসহ আরও কিছু নামকরা ফাস্ট ফুডের দোকানে উপচে পড়া ভিড় লক্ষ করা যায়। এসব দোকান দেখে মনে শান্তি লাগলেও এখানেও কিন্তু একই অবস্থা, অর্থাৎ সব খাবারে চায়নিজ স্বাদ একটু থাকবেই। সে জন্য মাঝেমধ্যে এসব দোকানে খাবার খেতে গিয়েও নিজেদের নাককে আয়ত্তে আনতে হয়। বিভিন্ন ব্রান্ডের ওয়াইন, বিয়ার খুব সাশ্রয়ী দামে পাওয়া যায়, সে জন্য এদের প্রচুর ড্রিংকস করতে দেখা যায়। সন্তানদের মা–বাবার সামনে এবং ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষকদের সঙ্গে ড্রিংক করতে কোনো বাধা নেই। কিন্তু নেশাগ্রস্ত অবস্থায় গাড়ি চালানো বা জনসমাগম স্থানে ঘোরাফেরা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
বিভিন্ন ধরনের ফলের আধিক্য দেখা যায় চীনে। এত রকমের ফল যে পৃথিবীতে আছে, সেটা এখানে না এলে হয়তো আমার জানা হতো না। সারা বছরে কিছু কমন ফল ছাড়াও বিভিন্ন ঋতুতে ফলের সমারোহ নিয়ে হাজির হয় প্রকৃতি। সব রকমের ফল এখানে অনেক সস্তা এবং সতেজ। বলা যেতে পারে, সবজি বা মাছ–মাংসের চেয়ে ফলের দাম কম। সে জন্য দিনমজুর থেকে শুরু করে সবারই ফল খাওয়ার সামর্থ্য আছে। আমার কাছে মনে হয়, চীনারা দুপুর বা রাতে যতটুকু খাবার খায়, তার চেয়ে প্রতিদিনের ফল খাওয়ার পরিমাণটাও কোনো অংশে কম নয়। তবে হ্যাঁ, ফল একটু বাসি হলে কেউ সেটা কেনে না; সতেজ ও তরতাজা পণ্যর প্রতি ঝোঁক বেশি তাদের।
মিষ্টি এরা পছন্দ করে না। এ জন্য কোথাও মিষ্টির দোকান আলাদা করে খুঁজে পাওয়া যাবে না; তবে খুবই হালকা মিষ্টি (আমাদের মতো চিনির সিরাতে চুবানো না) জাতীয় কিছু খাবার পাওয়া যায়। খাবারে রান্নার সময় হালকা পরিমাণে মধু মিশিয়ে খায়। এখানেও আমাদের দেশের মতো মসলা মাখিয়ে প্রসেস করে কিছু কিছু দোকানে আস্ত মুরগি বা হাঁস গ্রিলে ঘুরতে দেখা যায়। দেখলে বাঙালি যে কারও জিবে জল আসার কথা, কিন্তু বেশির ভাগ গ্রিল করা মাংসে হালকা মধু দেওয়া থাকে। সহজেই আঁচ করা যায় মসলা মাখানো মুরগি বা হাঁসের গ্রিলে মিষ্টি দিলে কেমন স্বাদ হওয়ার কথা। তবে মধুর অনেক ভেষজ গুণ থাকায় তারা চিনির পরিবর্তে খাবারে অল্প মধু ব্যবহারের চেষ্টা করে।
স্বামী-স্ত্রী উভয়েই যাঁরা চাকরিজীবী, বাসায় রান্না করা তাঁদের কাছে অতিরিক্ত ঝামেলার মনে হয়, এ কারণে বাইরেই বেশি খেতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন অনেকে। এর কিছু সুবিধা আছে বলে তাঁরা মনে করেন। যেমন: নেই বাজার করার চিন্তা, কী রান্না করবে, সেই চিন্তা এবং সর্বোপরি জীবনকে নির্ঝঞ্ঝাট রাখা। একই সঙ্গে এরা এটাও মনে করে, বাইরে খেলে খাবারের স্বাদের ভিন্নতা নিতে পারে। তবে মাঝেমধ্যে স্ত্রীর পাশাপাশি স্বামীরা ও সমানতালে রান্নাঘরে সময় দেন। সবকিছুই উচ্চ তাপে খুব অল্প সময়ের জন্য রান্না করা হয়, যেটার নাকি অনেক স্বাস্থ্য উপকারিতা আছে। আমাদের রান্নায় আমরা প্রচুর মসলা ব্যবহার করি, কিন্তু এরা মসলা খুব কম খায়। আমাদের যেখানে একটা আইটেম রান্না করতে ৩০ থেকে ৪০ মিনিট সময় লাগে, সেখানে এরা ৫টা আইটেম রান্না করে।
খাবার পরিবেশনের সময় রেস্তোরাঁগুলোয় বিভিন্ন ধরনের খাবার ট্রে বা বিভিন্ন পাত্রে বেশ সুসজ্জিত করে তবেই পরিবেশন করা হয়। রেস্তোরাঁগুলোর অ্যাকুয়ারিয়ামে রাখা জীবিত মাছ, চিংড়ি, কাঁকড়া—এগুলো অর্ডার করলে সঙ্গে সঙ্গেই প্রসেস করে রান্না করে দেয়। এখানে সব রকমের বড় বড় মাছ আইশ ফেলে, পেট পরিষ্কার করে ধুয়ে আস্ত রান্না করে টেবিলে দেওয়া হয়। রান্নার সময় সব খাবারে বিভিন্ন ধরনের কুকিং ওয়াইন, ভিনেগার এবং কুকিং সস (সয়া সস, ফিস সস, ভেজিটেবল সস, চিলি সস) ব্যবহার করে, যেগুলোর অনেক স্বাস্থ্য উপকারিতা আছে। এ ছাড়া অনেক খাবারে খোসা ছাড়ানো তিল ব্যবহার করতেও দেখা যায়। সবখানেই খাদ্য নিরাপত্তার নিয়ম মেনেই খাবার তৈরি, বিক্রি, এবং পরিবেশন করা হয়, সে জন্য খাবারে কেউ যে ভেজাল মেশাতে পারে, এরা কখনো সেটা মাথায় আনতে পারে না। এখানে একটা ব্যতিক্রম পদ্ধতি চালু আছে, সেটা হলো সবকিছুর দাম আমাদের মতো কেজিতে হিসাব না করে ৫০০ গ্রামে হিসাব করে। সমগ্র চীনে সব কেনাকাটায় ওজনের ক্ষেত্রে এ চিত্র দেখা যায়। সে ক্ষেত্রে আমাদের মতো কেজিতে হিসাব করতে গেলে দুই দিয়ে গুণ করে হিসাব করে নিতে হয়। যেকোনো দেশের বিভিন্ন অঞ্চল বা এলাকাভিত্তিক খাবারে বেশ ভিন্নতা আছে। চীনারাও এর ব্যতিক্রম নয়। চীনাদের ভেতর নিকৃষ্ট অনেক ধরনের প্রাণী খাওয়ার প্রচলন আছে শোনা গেলেও সেগুলো ঢালাওভাবে সব এলাকা বা সবার জন্য প্রযোজ্য নয়। খাবারের স্বাদ একটি আপেক্ষিক ব্যাপার, অর্থাৎ যার যার অভ্যাস, রুচি এবং স্থান–কালের ওপর নির্ভরশীল। চীনারা চেষ্টা করে রান্নার সময় খাবারের স্বাস্থ্যগত গুণাবলি ঠিক রেখে খেতে। হতে পারে সেগুলো আমাদের থেকে স্বাদে, ঘ্রাণে এবং রঙে আলাদা।
রেস্তোরাঁগুলোয় খাবার অর্ডার করার পরেই রান্না করে টেবিলে একের পর এক পরিবেশন করা হয়। আগে থেকেই সবকিছু প্রসেস করা থাকে, তাই অর্ডারের পর রান্নায় খুব বেশি সময় লাগে না। সময় বাঁচানোর জন্য অনেকেই রেস্তোরাঁয় পৌঁছানোর আগেই অনলাইনে খাবার অর্ডার করে রাখে, যাতে পৌঁছেই নির্দিষ্ট টেবিল নম্বরে খাবার পেতে পারে। চীনারা ঠান্ডা খাবার একেবারেই পছন্দ করে না, সে জন্য বেশির ভাগ খাবার ধোঁয়া ওঠা বা টগবগ করে ফুটেতে থাকে, সে অবস্থাতেই খেতে দেখা যায়। সব রেস্তোরাঁয় এই গরম ও টগবগে খাবার পরিবেশনের ব্যবস্থা আছে। খাবার অর্ধরান্না হয়ে যাওয়ার পরে সব উপাদান মিশিয়ে খাবারের ট্রের নিচে বিশেষ ব্যবস্থায় আগুনের ব্যবস্থা করে ডাইনিং টেবিলে দিয়ে দেওয়া হয়। বাকি অর্ধেক রান্না টেবিলেই সম্পন্ন হয় এবং সেই ধোঁয়া ওঠা খাবার চপস্টিক দিয়ে খেতে সবাইকে ব্যতিব্যস্ত দেখা যায়। বেশির ভাগ বড় বড় মাছের ক্ষেত্রে এ ব্যবস্থা সর্বক্ষণেই লক্ষণীয়। শেষ
লেখক: অজয় কান্তি মণ্ডল, গবেষক, ফুজিয়ান এগ্রিকালচার অ্যান্ড ফরেস্ট্রি ইউনিভার্সিটি, ফুজিয়ান, চীন।