চীনা খাবারের হরেক রকমের আয়োজন-২
ডিমের ক্ষেত্রেও তারা একটু ব্যতিক্রম, কারণ, সব রকমের ডিম এখানে ওজনে বিক্রি হয়। বাজারে হরেক রকমের ডিমের আধিক্য দেখা যায়। হাঁস, মুরগি, কবুতর, কোয়েলের ডিমের দামও খুব সাশ্রয়ী। কিছু মোডিফিকেশন ডিম অর্থাৎ হাঁস বা মুরগিকে বিশেষ খাবার খাওয়ানো বা জেনেটিক্যালি মোডিফিকেশনের (ওমেগা ৩ ফ্যাটি এসিডসহ অন্যান্য উপকারী রাসায়নিক পদার্থের আধিক্য থাকে) পরে যেসব ডিম পাওয়া যায় সেগুলো স্বাভাবিক ডিমের চেয়ে দ্বিগুণ বা তিন গুণ দামে বিক্রি হয়।
মাছসহ বিভিন্ন প্রাণীর চামড়া খাওয়ার প্রচলনও এখানে বেশ লক্ষ করা যায়। বিভিন্ন রেস্তোরাঁয় খাবারের মেনুর ভেতর মাছের চামড়ার মেনু পাওয়া যায় বিশেষ করে, কোল্ড ফিস চামড়া তারা বেশি খায়। বেশ কিছু প্রদেশে সাপের বার-বি-কিউ এবং স্যুপ খুবই জনপ্রিয়। তবে বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারির কারণে চীনাদের সাপ, কুকুরসহ বেশ কিছু প্রাণী খাওয়ার ব্যাপারে বর্তমানে নিষেধাজ্ঞা বহাল রয়েছে। বাজারে যেসব প্রাণীর মাংস সচরাচার পাওয়া যায়, তার ভেতর গরু, শুকর, ভেড়া, হাঁস, মুরগি, খরগোশ, কবুতরের মাংস উল্লেখযোগ্য। মাংসের ব্যাপারও এখানে একটু অন্যরকম। যেকোনো ধরনের মাংস যদি মুরগির কথা বলি তবে দেখা যায় মুরগির সব পার্ট পার্ট আলাদা বিক্রি হয় এবং দামও সব অংশের আলাদা আলাদা। বাকি মাংসের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। তবে আস্ত হাঁস-মুরগিরও যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। প্রদেশভেদে কিছু কিছু প্রাণীর মাংস বেশ জনপ্রিয়। যেমন সিচুয়ান প্রদেশে খরগোশ খুবই জনপ্রিয়।
মাংসের পাশাপাশি উক্ত প্রাণীর রক্তও চীনাদের কাছে লোভনীয় একটি খাবার। তাই সুপারশপগুলোতে ফ্রোজেন রক্তের বেশ চাহিদা রয়েছে। আমরা খোলা বাজারে হাঁস-মুরগি কিনতে গেলে তারা সেগুলোকে খাঁচা থেকে ধরে কেটে প্রসেস করে একেবারে খাওয়ার উপযোগী করে দেয়। হাঁস-মুরগি কাটার পর যে রক্ত বের হয় সেটা আমাদের লাগবে কি না শুনলে আমরা না বললে তারা খুবই খুশি হয়। পরে তারা বিশেষ ব্যবস্থার মাধ্যমে সেই রক্তকে সংগ্রহ করে নিজেদের খাওয়ার জন্য।
চীনাদের খাবারের জন্য চপস্টিক বহুল ব্যবহৃত। বাচ্চা থেকে শুরু করে সবাই খাবারে হাতের স্পর্শ এবং চামচের সাহায্য ছাড়াই সব রকমের খাবার এ দুই কাঠির সাহায্যে দক্ষতার সঙ্গে খেয়ে থাকে। সব রকমের খাবার যাতে চপস্টিক দিয়ে ধরা যায়, সেভাবেই প্রসেস করে রান্না করা হয়। চীনাদের খাবারের প্লেট ও বাটিগুলো আকারে খুবই ছোট হয়। তাদের খাবারে ভাতের পরিমাণ খুবই কম থাকে, কম মানে বলা যায় সব মিলিয়ে ৫০ গ্রাম চাল ফুটালে যতটুকু ভাত হয়। কেউ কেউ একেবারেই ভাত খায় না। চালগুলো খুবই খাটো ও গোলাকৃতি হতে দেখা যায় এবং সেগুলো রান্নার পর ভাত খুবই আঠালো হয়। চপস্টিক দিয়ে খাওয়ার সুবিধার্থে আঠালো ভাতের জন্য জেনেটিক্যালি মোডিফিকেশন করে সেভাবেই ধান চাষ করা হয়। আঠালো ভাতের পরিবর্তে আমাদের দেশের মতো লম্বা এবং সুগন্ধি কিছু চালও পাওয়া যায়।
কোনোরকম চিনিগুঁড়া বা পোলাওয়ের চাল এখানে দেখিনি কখনো। বরাবরি আতপ চাল খায় তারা। সেদ্ধ চাল কখনো বাজারে বিক্রি হতে দেখিনি। বিভিন্ন রকম নুডুলসের আধিক্য দেখা যায় এবং প্রায় সব রকম নুডুলস কোনো প্রকার মসলা ছাড়া অনেক জলের ভেতর সবজি, ডিম বা মাংসসহ সেদ্ধ করে হাপুসহুপুস করে খেতে দেখা যায়। ভাতের পরিবর্তে অনেকে নুডুলস খায় কিন্তু সেটাও পরিমাণে খুব অল্প।
প্রতিবার খাবার গ্রহণের সময় তারা পানীয় জলের পরিবর্তে স্যুপ খায়। তবে স্যুপ এবং জলের ভেতর খুব একটা বেশি পার্থক্য খুঁজে বের করা যায় না। যেকোনো সবজি বিশেষ করে, লেটুস পাতা, মিষ্টিকুমড়া, ডিম ইত্যাদি গরম জলে দিয়ে শুধু হালকা লবণ মিশিয়ে স্যুপ করে সেগুলো খায়। খাবারের সময় পানীয় হিসেবে কমলার জুস, নারকেলের জুস, বাদামের জুস বেশি দেখা যায়। এ ছাড়া স্প্রাইট, কোকা–কোলাও খেয়ে থাকে তবে এগুলোর প্রচলন কম।
চীনারা ভাজাপোড়া খুবই কম খায়। যেহেতু ভাজাপোড়া মুখরোচক সেহেতু তারা পছন্দ করে কিন্তু সেটা সকালের নাস্তার সঙ্গে কিছু কিছু মানুষ খায়। স্টিমে ভাপানো ব্রেড (স্টিম বান) খুবই পছন্দের খাবার তাদের। শুধু ময়দার খামি দিয়ে বাষ্পে ভাপিয়ে স্টিম বান তৈরি করা হয়। যেটাতে লবণ বা অন্য কোনো উপাদান না মিশিয়ে সকালের নাস্তায় খেতে দেখা যায়। সকালের নাস্তায় চীনাদের আরও একটা জনপ্রিয় খাবার হচ্ছে ডামপ্লিং বা মম। তবে এ ক্ষেত্রে ময়দার খামির ভেতর আগে থেকে রান্না করা সবজি বা মাংসের পুর ভরে তবেই বাষ্পে ভাপানো হয়। খুব ভোরে এসব স্টিম বান, ডামপ্লিং, নুডুলস খেয়ে তাদের প্রতিদিনের সকাল শুরু হয়।
গ্রিন টি তাদের খুবই জনপ্রিয় পানীয়। তাই ছোট থেকে শুরু করে বয়স্ক মানুষ সবার কাছে গ্রিন টি এর বেশ বড় বড় পট থাকে। সেটাতে বিভিন্ন ধরনের গ্রিন টি, ফ্লাওয়ার টি (বিভিন্ন ফুল শুকানো) ভরে সারা দিন একটু একটু করে গলা ভেজাতে থাকে। গ্রিন টি বলতে সবুজ চা–এর পাতাকে রৌদ্রে শুকিয়ে প্যাকেটজাত করা হয়, যেগুলো গরম জলে দেওয়ার কিছুক্ষণ পর একেবারে সবুজ পাতার রূপ ধারণ করে। চা–এর জন্মস্থান চীন হওয়ায় তাদের চা তৈরি, পরিবেশন এবং পান করার ভেতরে যে কত রকমের সৃজনশীল পর্ব আছে, সেটা নিজ চোখে অবলোকন ব্যতীত উপলদ্ধি করা যায় না। সুপারশপগুলোতে হাজারো রকমের চা বিক্রি হয়। সেগুলোর দামও অনেক চড়া। আমি শুনেছি যে চীনের নামীদামি ব্যক্তিরা বিদেশ সফরে গেলে নিমন্ত্রণ কর্তাদের জন্য উপহার হিসেবে দেশের বিখ্যাত চা নিয়ে যান। স্বাভাবিক তাপমাত্রার জল তারা খুব কম পান করে, সব ট্যাবে প্রায় ৪০ ডিগ্রি এবং ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি তাপমাত্রার পানীয় জলের ব্যবস্থা থাকে। স্বাভাবিকভাবেই শরীরের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রার সঙ্গে দ্রুত খাপ খাওয়ানোর জন্য ৪০ ডিগ্রির কাছাকাছি তাপমাত্রার পানি সবচেয়ে উপযোগী এই ভাবনা থেকেই তারা উষ্ণ গরম পানি পান করে। চলবে..
লেখক: অজয় কান্তি মণ্ডল, গবেষক, ফুজিয়ান অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড ফরেস্ট্রি ইউনিভার্সিটি, ফুজিয়ান, চীন।