চীনা খাবারের হরেক রকমের আয়োজন-১

ছবি: লেখক

বিশ্বের পাশাপাশি আমাদের দেশের চাইনিজ রেস্তোরাঁগুলোতেও চীনা খাবারের স্বাদ নেওয়ার জন্য বাঙালিদের বেশ ভিড় লক্ষ করা যায়। বিশেষ করে চাইনিজ ফ্রাইড রাইস, চাইনিজ সবজি, সঙ্গে চিকেন ফ্রাই এবং চিংড়ির মেন্যুগুলো সবার কাছে নিঃসন্দেহে অনেক মুখরোচক। তবে এ রকম মুখরোচক খাবার যে চীনে এসেও খেতে পারবেন, সেটা ভাবলে কিন্তু বড় ভুল হবে। দেশীয় খাবারের স্বাদের সঙ্গে মিল রেখে চাইনিজ রেস্তোরাঁগুলোতে সুস্বাদু খাবারের ব্যবস্থা থাকলেও, চীনাদের খাবার সম্পূর্ণ ভিন্ন। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগতে পারে, কেমন হতে পারে চীনাদের খাবার? আজকের পর্বে চীনাদের খাবারের ভিন্ন ভিন্ন মেন্যু নিয়েই আয়োজন।

যদি প্রশ্ন করা হয় চীনারা কী খায়? এ প্রশ্নের উত্তর বেশ দীর্ঘ হবে। তাই চীনারা কী খায় না, সেটা সহজে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। চীনাদের মধ্যে এমন রীতির প্রচলন আছে, যেসব প্রাণী নড়াচড়া করতে পারে, তাদের সেগুলো খেতে কোনো বাধা নেই। সেটা পোকামাকড় থেকে শুরু করে যেকোনো কিছু হতে পারে। তবে ঢালাওভাবে সবকিছু খাওয়ার রীতি সব চীনার মধ্যে লক্ষ করা যায় না। এলাকা এবং প্রদেশভিত্তিক খাবারের বেশ বৈচিত্র্য আছে।

ছবি: লেখক

অনেকের ধারণা, চীনা ব্যক্তি মানেই তাদের খাবারে প্রাধান্য পায় সবকিছু। কিন্তু এটাও নির্ভর করে কে কোন এলাকার বাসিন্দা, তার ওপর; অর্থাৎ শীতপ্রধান থেকে গ্রীষ্মপ্রধান এলাকার দিকে খাবারের বেশ ভিন্নতা লক্ষ করা যায়। তবে চীনারা সব খাবারের টাটকা, সতেজ বা ফ্রেশ স্বাদ নিতে অভ্যস্ত। সে কারণে যেকোনো খাবার তারা খুবই অল্প সেদ্ধ করে খেয়ে থাকে। শুনেছি, কোথাও কোথাও নাকি কাঁচা খাওয়ারও রেওয়াজ আছে। ভিনদেশিদের প্রথমে চীনে এসে চীনা খাবার খেতে গেলে খাবারে খুবই গন্ধ লাগে। এ গন্ধের তীব্রতা এতই বেশি যে প্রথম প্রথম নিজের নাক নিজের সঙ্গে বিদ্রোহ করবে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই গন্ধের তীব্রতা কিছুদিনের মধ্যে নিজেদের কাছে মানিয়ে যায়। আমাদের মতো চীনারাও খাবারে টক, মিষ্টি, ঝাল, নোনতা, তিতা সবই খায়; কিন্তু সেই টক, ঝাল বা মিষ্টির স্বাদ আমাদের স্বাদের ধারেকাছেও নেই। ঐতিহ্যবাহী চীনা ভেষজ ওষুধের সঙ্গে তাল রেখে চীনাদের খাবারের স্বাদ এবং গন্ধের হেরফের হয়ে থাকে।

সিচুয়ান প্রদেশ চীনের ‘ফুড হ্যাভেন’ নামে পরিচিত। সিচুয়ান প্রদেশের রাজধানী ছেংডু শহরে দুই মাস থাকার অভিজ্ঞতা দিয়েই প্রথমে বুঝেছিলাম চীনের মানুষ বাসায় রান্না করে খাওয়ার থেকে বাইরেই বেশি খেতে পছন্দ করে। পুরো চীনের মধ্যে সিচুয়ান প্রদেশের মানুষ সবচেয়ে বেশি মসলাযুক্ত খাবার খায়। এসব মসলাযুক্ত খাবারের মধ্যে হটপট, ছুয়ানছুয়ান, বব চিকেন উল্লেখযোগ্য। হটপট সিচুয়ান প্রদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খাবার। ডাইনিং টেবিলের মাঝখানে বিভিন্ন মসলাযুক্ত টগবগ করে ফুটতে থাকা বিশেষ ব্যবস্থায় বড় কড়াইয়ে রাখা এই হটপট খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। সবাই টেবিলের চারপাশে গোল হয়ে বসে কাবাব বানানোর কায়দায় মসলা ছাড়া কাঠিতে গাঁথা বিভিন্ন প্রকারের কাঁচা মাংস, সবজি কিছুক্ষণের জন্য ওই টগবগে ফুটতে থাকা কড়াইয়ে চুবিয়ে খুবই মজার সঙ্গে খেয়ে ফেলে। কেউ কেউ চপস্টিক (খাবারের জন্য ব্যবহৃত দুটি কাঠি) দিয়ে কাঁচা সবজি, মাংস ধরেও ওই মসলাযুক্ত কড়াইয়ে চুবিয়ে খেয়ে নেয়। খাবারকে খুবই স্পাইসি করার জন্য হটপটে তারা গোলমরিচের মতো একধরনের মসলা ব্যবহার করে, যেটাকে সমগ্র চীনে সিচুয়ান পিপার নামে পরিচিত। এ সিচুয়ান পিপার সত্যিই অনেক স্পাইসি, তাই চীনারা স্পাইসি খাবার বলতেই শুকনা মরিচের সঙ্গে সিচুয়ান পিপার মিশিয়ে খাবার রান্না করে। সিচুয়ান প্রদেশের সঙ্গে মিল রেখে চীনের প্রায় সব প্রদেশেই এই হটপট খাওয়ার ব্যবস্থা আছে।

ছবি: লেখক

চীনারা প্রচুর সবুজ সতেজ সবজি খায়। হতে পারে সেগুলো হালকা ভাপে সেদ্ধ বা স্যুপ হিসেবে। সবজি এক দিনের বাসি হলেই সেগুলো কেউ কিনতে চায় না। সব সময় ফ্রেশ এবং টাটকা সবজি খাওয়ার রীতির প্রচলন আছে চীনাদের মধ্য। সাধারণত দুপুরে বাগান থেকে তুলে বিকেলে খোলা বাজারে বা সুপার শপে সবজি বিক্রি হতে দেখা যায়। অঙ্কুরিত বীজ; অর্থাৎ উপযুক্ত পরিবেশে বীজ থেকে চারাগাছের পত্রমুকুল এবং মূল বের হওয়ার মুহূর্তে সেগুলোকে সবজি হিসেবে খেয়ে থাকে। অধিক নাইট্রোজেনসমৃদ্ধ এসব ভ্রূণ মুকুল শরীরের জন্য অধিক পুষ্টিকর বলে তাদের বিশ্বাস। হরেক রকমের মাশরুম খাওয়ারও অধিক প্রচলন আছে। বিভিন্ন ধরনের বীজ ভাজা, যেমন সূর্যমুখী ফুলের বীজ, মিষ্টিকুমড়া-চালকুমড়ার বীজ, তরমুজের বীজসহ আরও অন্যান্য বীজ ভেজে বাজারে বিক্রি হয়। বিভিন্ন ধরনের বাদামেরও আধিক্য দেখা যায় এদের এখানে। অবসরে বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটাতে এসব বাদাম এবং বিভিন্ন বীজ খেয়ে তারা খোশগল্প করতে থাকে।

ছবি: লেখক

সামুদ্রিক কিছু মাছ ছাড়া (এগুলো জীবিত রাখা কষ্টসাধ্য হওয়ার কারণে) প্রায় সব ক্ষেত্রে চীনারা জীবিত মাছ খায়। তাই খোলা বাজার থেকে শুরু করে শপিং মলে অ্যাকুয়ারিয়ামে সব মাছ রাখা থাকে। সেটা তেলাপিয়া, সরপুঁটি, সিলভার কার্প, রুই থেকে শুরু করে চিংড়ি, কাঁকড়া, ব্যাঙ, কচ্ছপ পর্যন্ত। যখন যে যেমনটা চাচ্ছে, সেখান থেকে সে তেমনটা তুলে নিচ্ছে। অ্যাকুয়ারিয়ামে রাখা এসব প্রাণী মারা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেটাকে উঠিয়ে আলাদা করে অর্ধেকের কম দামে বিক্রি হতে দেখা যায়। খোলা বাজারে বড় বড় মাছ কেটে বিক্রি করতে দেখা যায় এবং মাছের একেক অংশের দাম একেক রকম। যেমন বড় মাছের ডিম আলাদা করে সব থেকে কম দামে বিক্রি হয়, এ ছাড়া মাছের মুড়া আস্ত মাছের অর্ধেক দামে বিক্রি হয়। বাজারগুলোতে ফিশ বল এবং মিট বলের আধিক্য দেখা যায়। ময়দার মধ্যে রান্না করা বিভিন্ন ধরনের মাছ অথবা মাংসের পুর ভরে তৈরি করা হয় এসব ফিশ বল ও মিট বল।

সি ফুড বলতে আমরা সাধারণত সামুদ্রিক বিভিন্ন মাছ, চিংড়ি, লবস্টার, কাঁকড়া এগুলো বুঝি। কিন্তু এদের কাছে সি ফুড বলতে সবচেয়ে জনপ্রিয় শামুক, ঝিনুক, শৈবাল, অক্টোপাস এগুলো। যত রকমের শামুক বা ঝিনুক আছে, সবই চীনাদের খুবই জনপ্রিয় খাবার। শামুক-ঝিনুকের স্যুপ, লবণে সেদ্ধ, কুকিং সসে সেদ্ধ করে—এমনকি বারবিকিউ করেও এসব শামুক-ঝিনুক খেতে দেখা যায়। সুপারশপগুলোতে ২০-২৫ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক জীবিত অবস্থায় বিক্রি হয়। সামুদ্রিক বিভিন্ন শৈবাল খাওয়ারও বেশ প্রচলন আছে এখানে। তাই এসব শৈবালেরও বেশ কদর আছে বাজারগুলোতে। ব্যাঙও এদের খুবই জনপ্রিয় খাবার। বিশেষ করে ব্যাঙের মাংসের পিৎজার বেশ সুনাম আছে চীনে। বাড়তি স্বাদের জন্য কিছু কিছু বেকারি, যেমন কেক, কিছু বিস্কুট, পিৎজা, বার্গার এগুলোর ওপরে শূকরের মাংসের খুবই মিহি করা অংশ ছিটানো থাকে। চলবে..
লেখক: অজয় কান্তি মণ্ডল, গবেষক, ফুজিয়ান অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড ফরেস্ট্রি ইউনিভার্সিটি, ফুজিয়ান, চীন।