মা ডাকছে
১.
মনোয়ারের ডাক নাম মনু। এই নামেই এখানে সবাই তাকে চেনে। এই রেলওয়ে স্টেশনে ১০ বছর ধরে তার ঘর, তার বাড়ি, ঠিকানা।
দিন–তারিখ–সময় তার মনে নেই। তার সঙ্গে একজন লোক ছিল। এই স্টেশনে ট্রেন থেকে নেমে একটা ভাতের হোটেলে ওকে বসিয়ে লোকটা চলে যায়।
মনু জন্মান্ধ। বুঝতেই পারেনি। বিড়ালছানার মতো তাকেও ফেলে রেখে গিয়েছিল লোকটা। বাপ মরেছে আগেই। অন্ধ মনুকে নিয়ে আশ্রিত অসহায় ওর মা। মনুর মায়ের যখন বিয়ে ঠিক হলো, জন্মান্ধ মনুর দায়িত্ব কেউ নিতে চায়নি।
ছয় বছরের মনু বুঝতে পারেনি কিছু। কেঁদে কেঁদে কিছুদিন চলে গেল। ওই দিন থেকেই এই স্টেশনের সবকিছু মনুর ঘর, মনুর পরিচয়। শুরুর দিনগুলোতে এই স্টেশনের ভেতর কিংবা বাইরে ভিক্ষা করত। এরপর ধীরে ধীরে ট্রেনে ভিক্ষা শুরু করল।
এখন ট্রেনে আর স্টেশনে ভিক্ষা করে জীবন কাটে মনুর। প্রথম যখন ভিক্ষা করতে শুরু করল, তখন বাংলা নাটক–সিনেমার গান গেয়ে শোনাত। এখন ধর্মীয় গান ওর পছন্দ। মানুষ আল্লাহর নাম ভয় পায়। নবী–রসুলের গানে মন একটু নরম করে ওদের। ভালোই টাকা আসে।
‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
সোহাগ আর মিন্টু ওর সহচর। তার মতোই ছিন্নমূল। ঠিকানাবিহীন। নামের পরিচয় হয়তো আছে, কোনো পারিবারিক ঠিকুজি নেই। মনু যখন বুঝতে পারল ওকে ফেলে চলে গেছে, ওর মা কিছুই করতে পারেনি, এই কষ্ট ওর ছোট্ট বুকে জ্বালা করত। অভিমান হতো। রাগ হতো। সবকিছু চুরমার করে দিতে মন চাইত। সোহাগ আর মিন্টুর গল্পটাও একই রকম। অন্ধ মনুর চোখ নেই, বেঁচে তো আছে? অবহেলার কষ্ট এই তিন বালকের জীবনে একটু সুখ হয়ে এসেছিল নেশা। পলিথিনের ব্যাগে জুতার আঁঠা মাখিয়ে দম নিত ওরা। সস্তা নেশা। মুখে ফেনা উঠে, দম বন্ধ হয়ে সোহাগ মরে গেল।
মিন্টু আর মনু ওই পথে আর যায়নি। মিন্টু এখন একটা ভাতের হোটেলে রান্নার কাজ করে। ওখানেই খেতে যায় মনু। রাত হলে ওই হোটেলে ঘুমিয়ে যায়। মালিক লোকটা ভালো। মিন্টুর সঙ্গে মনুকেও থাকতে দিয়েছে।
মিন্টু একটা মোবাইল ফোন কিনে দিয়েছে ওকে। মনুর জীবনে মিন্টু ওর সবকিছু—ওর ভাই, ওর মা-বাবা। একমাত্র আপনজন। প্রতি ঈদের দিন ওরা দুজন সকালে গোসল করে। নতুন জামা পরে। তারপর ঢাকা শহর ঘুরে বেড়ায়।
প্রথমদিকে নামাজ পড়া হতো না। মিন্টু আজকাল ধর্মেকর্মে মন দিয়েছে। মনু মিন্টুর কথার বাইরে যায় না। এই ফোনে মাঝেমধ্যে ওয়াজ শুনে দুজনে। মনু ভিক্ষা করার সময় ওয়াজের মতো করে নবী–রসুলের গল্প বলা শুরু করেছে। এতে কামাই ভালোই হয়। দানখয়রাতের ফজিলত নিজের মতো করে বানিয়ে বলে দেয়।
টাকা–পয়সা আসছে, ভালোই।
২.
এই স্টেশন ওর মতো ছিন্নমূল অনেকের বাড়িঘর।
এক বুড়ি এসে জুটেছে কয়েক বছর হলো। অন্য যারা তার মতো ভিক্ষুক, তারা বুড়িকে তাদের পাশে বসতে দেয় না। মনুর কেন জানি এই বুড়ির জন্য অনেক মায়া, অনেক দরদ। দাদি বলে ডাকে। বুড়িও ওর পাশে থাকে যতটা সময় পারে।
বুড়িকে মনুর আজব লাগে। দিনের বেলা সারাক্ষণ তার ছেলে–মেয়েদের গালি দেবে, বদ দোয়া দেবে। বুড়ির ছেলে–মেয়েরা কেউ খোঁজ নেয় না। ওরাই বুড়িকে এই স্টেশনে ফেলে গেছে। অথচ রাতের গভীরে এই বুড়ি আল্লাহর কাছে হাত তুলে তার ছেলে-মেয়েদের জন্য দোয়া করবে, ওদের জন্য করুণা ভিক্ষা করবে। মনু খেয়াল করেছে, মাঝেমধ্যে বুড়ি কেঁদে কেঁদে আল্লাহকে বলছে ‘মাবুদ, আমার গোস্সা দেখিও না। ওগোরে ভালো রাইখো। ওগো সব মুসিবত, আমারে দিয়া দেও। আমার সাওয়ালগুলারে ভালো রাইখো আল্লাহ।’
মানুষের মন বড় অদ্ভুত। মনু বুঝতে পারে না। নিজের মায়ের প্রতি অভিমান হয় খুব। মাঝেমধ্যে ওর প্রচণ্ড রাগও হয় মায়ের প্রতি। তারপরও ওই মাকেই ও সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। তাই হয়তো এই বুড়ির সঙ্গে ওর লতায়–পাতায় মিলেমিশে গেছে। ঠিক মিন্টুর মতন।
ওর মায়ের কণ্ঠ একটু একটু মনে আছে। ওর মায়ের গন্ধ এখন আর মনে নেই। জন্মান্ধ মনুর কাছে মায়ের কোনো চেহারা নেই। তার গায়ের গন্ধ, তার গলার স্বর—এইগুলোই ছিল। এখন কেমন যেন ঝাপসা হয়ে গেছে।
চা-ওয়ালার মোবাইল ফোনে ওয়াজ হচ্ছে। সদকা দিলে আল্লাহ কেমনে মানুষের বিপদ–আপদ থেকে রক্ষা করেন, তার বর্ণনা। মনু মন দিয়ে শুনছে। এই কথাগুলোই ও ট্রেনে মানুষকে শোনাবে। তার রোজগার বাড়বে। মনু কথাগুলো মনের মধ্যে গেথে নেয়। একসময় নিজেই বিড়বিড় করে নিজেকে শোনায়। এইটা ওর অনুশীলন। কোন কথা, কোন শব্দ কখন কতটুকু জোর দিয়ে বলতে হবে, এইটাই আসল।
মাগরিবের সময় ট্রেনে মানুষ একটু হালকা মেজাজে থাকে। চা–নাশতা কিনে খায়। মনু তখন রাসুল আর সাহাবিদের গরিবি আর না খেয়ে থাকার গল্প শোনায়। এতে কাজ হয়। আরেকটা নতুন গল্প পেয়ে মনুর ভালো লাগছে। এইটা এখন পরীক্ষা করতে হবে।
বুড়ি কে বলল, ‘দাদি, চা খাইবা, লগে বাটার বান?’
বুড়ি চুকচুক করে চা খাচ্ছে। চায়ের সঙ্গে বাটার বান ওদের দুজনের খুব প্রিয়।
মিন্টু থাকলে ভালো হতো। তিনজন মজা করে খেত।
মনু বিড়বিড় করে ওর নতুন সাদকার গল্প মাথার মধ্যে সাজিয়ে নেয়। এই বুড়িকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরবে। একজন কানা, আর আরেকজন বুড়ো মানুষ। দুজনে কামাই ভাগ করে নেবে। বুড়ি ওর প্রস্তাব ফেলবে না। মনু জানে।
৩.
মাঝেমধ্যে মনু এই প্ল্যাটফর্ম ধরে হেঁটে হেঁটে ভিক্ষা করে। পুলিশ আর রাজনৈতিক দলের পান্ডাদের একটু ছাড় দিতে হয়। অনেক কথা কানে আসে ওর।
মনু জানে, এই রেলস্টেশন ধরে রোজ কোটি কোটি টাকার লেনদেন হয়। ফেন্সি, হিরু, গাঞ্জা, মদ, নারী, মেশিন মানে পিস্তল, গুলির নাম বিচি—কত কিছু কেনা–বেচা হয়।
মাঝেমধ্যে তাকেও লোকে ব্যবহার করে। আখাউড়া থেকে পাউডার নিয়ে আসে ঢাকায়। একবার ১ হাজার টাকা পেয়েছিল। মিন্টু খুবই রেগে গিয়েছিল। মিন্টু জানে, মনু অসহায়। মিন্টুই–বা কী করতে পারত! ওদের কথা না শুনলে ওরা মারবে, তারপর পুলিশে ধরিয়ে দেবে। ওদের আসল লোকজন ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। সব সময় জেল–হাজতে পচে মিন্টু আর মনুদের মতো অসহায় লোকজন। এই বাস্তবতা জন্মান্ধ মনু আর এতিম মিন্টু খুব ভালো বোঝে। সবকিছু জানে বলেই ভয় পায়।
আজকে মনু হাঁটছে একটা বিশেষ কারণে। পানির কলের পাশে যে পিলার আছে, তার পাশের বেঞ্চে একজন বসে আছেন। এক মহিলা। এক-দেড় বছর ধরে মাস দুই পরপর এই মহিলা আসেন।
জন্মান্ধ মনু এই স্টেশনের প্রতিটা ইঞ্চি চেনে। এই মহিলা একই জায়গায় এসে বসে থাকেন। চলে যাওয়ার আগে অন্য কারও হাতে কিছু খাবার ওকে দিয়ে যান। মিষ্টি কিংবা পিঠা। সেমাই কিংবা একটু পোলাও–গোশত।
মনুও আজকাল অপেক্ষা করে। এই জায়গার পাশ দিয়ে গেলেই মনুর কান আর নাক সজাগ হয়ে যায়। এক হালকা ফোপানো কান্না, একটু নাক ঝাড়ার শব্দ। মুখ চেপে নিজের কান্না লুকানোর চেষ্টা। মনু বুজতে পারে। চারপাশে হেঁটে ঘুরে বেড়ায় মনু। একটু দূরত্বে দাঁড়িয়ে ও বোঝার চেষ্টা করে, কেউ কি এসেছে?
আজ সেই বিশেষ দিন।
মনু হেঁটে হেঁটে গানের সুরে ওয়াজ করছে। আজ আর সদকা কিংবা রসুলের ক্ষুধার কষ্টের গল্প বলতে ইচ্ছা করছে না। মা আমিনার মৃত্যুর ঘটনা কিছুদিন আগেই ও শুনেছে। আজ মা আমিনার মৃত্যু পর রসুলের কষ্টের গল্প বলছে মনু।
নিজেই বানিয়ে বলছে।
এই কষ্ট রাসুলের না থেকে একসময় মনুর কষ্টের বর্ণনা হয়ে গেল। এই গল্প ওই বিশেষ মহিলাকে বলছে মনু। মনুর মনে কোনো রাগ নেই। মনু বুঝতে পারে, কত কষ্ট বুকে চেপে, কত অসহায় হলে তার মা তাকে ফেলে গিয়েছিল। মনুর গল্প অভিমানের, মনুর গল্প ভালোবাসার।
ট্রেন চলে গেছে। প্ল্যাটফর্ম প্রায় ফাঁকা। মনু পিলারের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। ভিক্ষার থালা থেকে হাত দিয়ে টাকাগুলো মুঠো করে পাঞ্জাবির পকেটে রাখল। খুচরো পয়সাগুলো চায়ের দোকানে দিয়ে টাকা নিয়ে নিল।
কান খাড়া করে মনু শোনার চেষ্টা করছে। হাতের চুড়ির শব্দ। একটু কান্না ভেসে এল কি? মনু সাহস করে বেঞ্চে এসে বসল। চুপ করে বসে আছে। মনুর অন্ধ চোখ বেয়ে পানি ঝরছে।
ওই বেঞ্চের আরেক পাশে বোরকা পরা একজন মায়ের চোখেও পানি। ফুলে ফুলে কাঁদছেন মা। মাঝেমধ্যে নাক ঝাড়ছেন। তার অসহায়ত্ত, তার বুকের কষ্ট কেউ বুজল না। এই খুঁজে পাওয়ার মধ্যে আনন্দের চেয়ে কষ্টটাই বেশি। তার বেঁচে থাকতে হয় কষ্ট চেপে। তার আদরের মনুকে কী করে এভাবে ফেলে চলে যেতে হলো তাকে? কীভাবে পারলেন? এই প্রশ্নগুলো প্রতিদিন তাকে কষ্ট দেয়।মনুকে এই স্টেশনে রেখে গিয়েছিল তার খালাতো ভাই। বিয়ের পর ওকে জানানো হয়েছিল। অনেক বছর অপেক্ষার পর সুযোগ পেলেন এই মা। প্রথম যেদিন মনুকে দেখে ছিলেন, বিশ্বাস করতে পারেননি। পিছু পিছু হেঁটেছেন। দূর থেকে দেখেছেন। মনকে অনেক কষ্টে বুঝিয়ে আবার ফিরে গেছেন।
মাস দুই পরপর এসে দেখে যান। এখন হাতে করে এটা–ওটা নিয়ে আসেন। মনু তার পাশেই বসে আছে। কাঁদছে তার মনু। বুকে জড়িয়ে ধরতে চাইলেও একটা অপরাধবোধ তাকে আটকে রেখেছে।
নিরন্তর কেঁদে চলেছে মা।
মনু মায়ের গন্ধ নিল। মায়ের গায়ের গন্ধ কত মিষ্টি! জর্দার সুবাস পেল, মা পান খেতে পছন্দ করে।
উঠে গিয়ে মায়ের জন্য পান কিনে আনবে কি না ভাবছে। আবার উঠতেও মন চাইছে না। একবার যদি মা ওর নাম ধরে ডাকত? মায়ের কণ্ঠে ওর নাম শোনার অপেক্ষায় বসে থাকে মনু। ডাকলে কী করবে মনু?
নিজের সমস্ত অস্তিত্ব নিয়ে অপেক্ষা করছে মনু। মা কখন ডাকবে?