গাড়ি চালনার যত কেচ্ছা: বাংলাদেশ পর্ব-২
প্রথম থেকেই আমাদের চালক গুরুজির মনে পর্বতসম গরিমা; তিনি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক গাড়িচালক বলে! তবে ঘটনা মোড় নিল, যখন তিনি এটা আবিষ্কার করলেন যে ড্রাইভিংয়ের ব্যাপারে আমি একটা আস্ত হাঁদা! অন্যদের সঙ্গে তুলনা টানলে ওটাই দাঁড়ায়। অন্যরা ড্রাইভিংয়ের চেয়ারে বসে প্রথমে একটু বিদ্যালয়ে উপস্থিত হওয়া নাবালকের মতো ভাব করেছিলেন বটে, তবে সেটা উবে যেতে ১৫ মিনিটের বেশি লাগেনি! পেছনে বসে তাঁদের গাড়ি চালানো দেখে মনে হচ্ছে, ‘বাহ্, এত ভালো ড্রাইভার বোধ হয় বঙ্গদেশেই জন্ম নেয়!’ পরে তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে জানলাম, তাঁরা সবাই একেকজন পাক্কা ড্রাইভার। লাইসেন্স কার্ড বাগাতেই এখানে আসা। তাঁদের মধ্যে আমার উপস্থিতি অনেকটা চাঁদের হাটে গোবর গণেশের হাজির হওয়ার মতো। নিরুপায় হয়ে ভাবলাম, যদি প্রশিক্ষণগুরুর কৃপাদৃষ্টি পাওয়া যায়, তাহলে কাজ হলেও হতে পারে। তবে মনের কোণে সন্দেহের দানা বেঁধেছিল তাঁর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের গল্প শুনে। ভাবখানা এমন, যেন তিনি সেখানকার মহাপরিচালক।
ড্রাইভিংয়ের প্রথম দিন থেকেই তাঁর উদ্ধত আচরণ প্রতিমুহূর্তের জন্য বড্ড বেখাপ্পা লেগেছে! কথায় কথায় ‘আরে! আরে! এটা কী করেন? আমি কি এটা করতে বলছি? আপনে কী করেন বুঝি না কিছু! ধুর মিয়া, আপনারে দিয়া কিচ্ছু হইব না’—এই অধম ছাত্রের সঙ্গে এভাবেই কথোপকথন চলতে থাকে। কখনো আমার মাথায় রাগ চটে যায়, তো কখনো তাঁর।
প্রথম দিন প্রাথমিক ধারণা, যেমন গাড়ি ইগনিশন, ব্রেক স্পিড নিয়ন্ত্রণ, গিয়ার চেঞ্জের পদ্ধতি—এসব দেখিয়ে দিতেই সময় ফুরিয়ে গেল। বলা বাহুল্য, এর কোনোটাই ঠিকঠাক আয়ত্ত করতে পেরেছি বলে মনে হয়নি একবারও। প্রত্যেকের জন্য ২০ থেকে ২৫ মিনিট বরাদ্দ। আমার জন্য সেটা কমপক্ষে এক ঘণ্টা হলে হয়তো বেশ হতো। আর গাড়িতে থাকা অন্য ব্যক্তিদের ভুবনজোড়া কিচ্ছাকাহিনি শুনতে শুনতে চালানোটা নিজের ধাতের সঙ্গে যায় না। সবচেয়ে বেশি ধোঁয়াশা রয়ে গেল গিয়ার নিয়ন্ত্রণের কৌশলে।
আমাদের মধ্যে সবচেয়ে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন সদস্য ছিলেন আনিসুর ভাই। বয়স চল্লিশের কোঠায়। ব্যাংকে কাজ করেন। তিনি রীতিমতো প্রশিক্ষকের সঙ্গে বেশ ভালো ভাব করে ফেললেন। তবে ড্রাইভিংয়ের কলাকৌশল জানতেন। তাই হয়তো তাঁর গুরুজি মনে মনে তাঁর ওপর বেশ প্রসন্নও ছিলেন। এরপর বলা যায় নাজমুলের কথা। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবসায় শিক্ষায় পড়ছে। দ্বিতীয় বর্ষ। আমার চেয়ে বয়সে কয়েক বছরের ছোট হলেও বেশ চটপটে আর প্রত্যুৎপন্নমতি। তাদের নিজস্ব গাড়ি আছে। বোঝো হাল!
কথায় কথায় সে বলে বসল, ১২-১৩ বছর বয়স থেকেই সে গাড়ি চালিয়ে আসছে। তার ড্রাইভার কাকুকে নিয়ে বাসার পাশের খেলার মাঠে চলে যেত প্রায় প্রতিদিন বিকেলে। নিজে থেকেই বলল, যেদিন সে রাস্তায় প্রথম ঠিকঠাক গাড়ি চালিয়েছিল, মনে হয়েছিল, পুরো পৃথিবী জয় করেছে! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী রনি। তার অবস্থাও আসলে আমার মতোই। বাসার পীড়াপীড়িতে এসে হাজির হয়েছে। শিখতে পারলে খুব ভালো আর না পারলেও তেমন কোনো মাথা ব্যথা নেই। বেশ নির্ভার লাগছে রনিকে। তবে এ ছোকরাও বন্ধুর সঙ্গে গাড়ি চালিয়েছে ইন্টার পরীক্ষার পরের ছুটিতে।
এখন সবাইকে দেখে মনে হচ্ছে, রাজ্যের যত চিন্তা সব ভর করেছে আমার মাথায়! সবাই কত নিশ্চিন্ত আর চাপমুক্ত, ভারমুক্ত। ক্লাস শেষে দেখা গেল প্রশিক্ষক মহাশয়ের পাশাপাশি নিজের সন্তুষ্টির কোটা একেবারে শূন্য!
ক্লাসের পর ফেরার পথে বলাকা বাসের জন্য অপেক্ষায় আছি, এমন সময় ভাবলাম, রাতে সুমন ভাইয়াকে জিজ্ঞাসা করব। দাদামণির বাল্যবন্ধু। তিনি তো এসবের ওস্তাদ। আমার ইউনিভার্সিটির প্রথম বছরের কথা—বউদিমণির ড্রাইভিং শেখার ইচ্ছা পূরণে সুমন ভাইয়া প্রশিক্ষকের ভূমিকায় শুরু করলেন ক্লাস নেওয়া।
প্রথম দিন আমি গাড়িতে উপস্থিত থেকে পরিস্থিতি দেখিনি। তবে দ্বিতীয় দিনের কথা মনে পড়লেই গা শিউরে ওঠে! ভাইয়া ওই দিন গাড়ির স্টিয়ারিং না ধরলে একটা খাদের বেশ কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিলাম আমরা। আরেকটু হলেই ড্রাইভিংয়ের ব্যাপারটাই আমাদের কাছে ডোবার পচাগলা পানি গিলে ‘জলবৎ তরলং’ হয়ে যেত! সুমন ভাইয়ার বদৌলতে শেষ রক্ষা। ফোনে যোগাযোগ করলে তিনি রাতে বাসায় গিয়ে দেখা করতে বললেন। যাওয়ার পর বেশ কিছু কথা বললেন, যেমন ব্রেক কষানোর কৌশল সবাই জানে; কিন্তু তিনিই ভালো ড্রাইভার, যিনি ব্রেক কষেন ঝাঁকুনি দেওয়ার জন্য নয়, বরং আরাম দেওয়ার জন্য! তবে সব পরিস্থিতিতে সেটা না হলেও অধিকাংশ সময়ই তাঁর পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের নিয়ন্ত্রণ থাকে অবারিত। রাস্তায় ছোটখাটো গর্তও কখনো তাঁর দৃষ্টি এড়ায় না আর অন্য কিছুর কথা তো বাদই দিলাম। গিয়ার নিয়ন্ত্রণের হযবরলর ব্যাপারে জানাতেই একটা ছোট্ট কাগজে কোন গিয়ার কোন দিকে কাজ করে, তার ছবি এঁকে বুঝিয়ে দিলেন। তখন মনে মনে ভাবছিলাম, বিআরটিসির ওই মহাপণ্ডিতের জায়গায় যদি ভাইয়া থাকতেন, তাহলে হয়তো ২০ মিনিটের ক্লাসই যথেষ্ট ছিল। আমার সমস্যা–অভিযোগ সব শুনে ‘যেখানে যেমন, সেখানে তেমন’—এ তত্ত্বই মেনে নিয়ে এগোতে উপদেশ দিলেন ভাইয়া।
পরের দিন আবার একইভাবে আড়াই ঘণ্টার বাসভ্রমণ শেষে আমরা যখন হাজির হলাম, তখনো আমাদের প্রশিক্ষক মহোদয় চায়ের কাপে চুমুক দিতে ব্যস্ত। আমরা এসে নিজেদের মধ্যে কথা বলছিলাম। এমন সময় তিনি চা শেষ করে হাজির হলেন আমাদের কাছে। আগেই করে এসেছিলেন কি না জানি না, তবে প্রথমেই আমাকে গাড়ি চালিয়ে দেখাতে বললেন। আমি ভাবলাম, কোথায় প্রথমে একটু অন্য পাক্কা ড্রাইভারদের চালিয়ে নেওয়া দেখে নেব। চলবে...