গাড়ি চালনার যত কেচ্ছা : বাংলাদেশ পর্ব-১

ঈদের সকালে স্বপ্নের ঢাকা। জসীমউদ্‌দীন রোড, উত্তরা
ছবিটি: কয়েক বছর আগে তোলা

গাড়ি চালনা নিয়ে কানাডা পর্ব শেষে এবার বাংলাদেশ পর্ব শুরু।

সে আজ থেকে পাক্বা আট বছর আগের কথা।

পোস্টগ্র্যাজুয়েট শেষে বিভিন্ন জায়গায় চাকরির খোঁজে চেষ্টা করে যাচ্ছি। অবশেষে একটি হাসপাতালে চাকরিও হয়ে গেল। তবে সাক্ষাৎকারের আগের মাসে কিছুদিনের জন্য গিয়েছিলাম সরকারি পরিবহন সংস্থা বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট করপোরেশনে (বিআরটিসি) ড্রাইভিং শিখতে ট্রেনিংয়ে। তা-ও স্বেচ্ছায় একেবারেই নয়, অনেকটাই বাপির পীড়াপীড়িতে! তাদের অফিস মহাখালী থেকে একটু এগিয়ে গিয়ে যে জায়গায়, নাবিস্কো বিস্কুট ফ্যাক্টরি, চ্যানেল আই, ইনসেপটা এসবের অফিস ওদিকটায়, মূলত ওই জায়গাকে বলে তেজগাঁও। নাবিস্কোর ফ্যাক্টরির জায়গায় এলে সব সময়ই বিস্কুটের সুগন্ধির ভকভক করা গন্ধ নাকে টের পাওয়া যায় অনায়াসেই। ঘুমে চোখ বন্ধ থাকলেও বুঝতে কোনো অসুবিধা হয় না, এটা নাবিস্কো! বাসা থেকে বিআরটিসির অফিসের দূরত্ব আধা ঘণ্টার পথ হলেও পৌঁছাতে লেগে যাবে দুই ঘণ্টার কাছাকাছি। কারণটা জানতে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকে গুগলে শুধু লিখুন ‘ট্রাফিক জ্যাম ঢাকা’, এরপর যেসব ছবি ভেসে আসবে, সেটার একঝলক দেখলেই পুরো ব্যাপার আপনার কাছে জলের মতো পরিষ্কার হয়ে যাবে। যেদিন থেকে ক্লাস শুরু করব, তার আগের দিনের পেপারে ট্রেনিংয়ের বিজ্ঞাপনের পাতাটা আমার ঘরে দিয়ে গেল বাপি। মায়ের সঙ্গেও কিছু কথা-কাটাকাটি হলো বাপির কথার সূত্র ধরে।

বিআরটিসির সংবাদপত্র বিজ্ঞাপন
ছবিটি: কয়েক বছর আগে তোলা

পরের দিনই সকালে যাওয়ার মনস্থির করলাম। বাসা থেকে লেগুনা বা অটোরিকশায় যেতে হবে হাউস বিল্ডিং। মূলত ওখান থেকে পদচারী-সেতু পেরিয়ে আরও কিছুটা এগোলে বাস কাউন্টারগুলোর সারি দেখতে পাওয়া যায়। তবে যে বাসে আমাকে যেতে হবে, সে-ই বলাকার কোনো কাউন্টার নেই! ওরা কিছুটা পাশ করে দাঁড়িয়ে যাত্রী উঠিয়ে নেয় বা বিপজ্জনক অবস্থায় রাস্তার মাঝখানেও যাত্রী বাসে উঠিয়ে নেয়।

বাংলাদেশ ট্রাফিক বিভাগের দেওয়া আইনকানুন অনেকটা জাদুঘরে রক্ষিত পুরোনো গ্রন্থপঞ্জির মতো! কবে যে বন্ধ করা হয়েছে বইয়ের পাতা, কেউ জানে না। কারও কারও হয়তো আধ-একটু ধারণা আছে, আর অন্যরা কেউ এসবের পরোয়া করে না। ট্রাফিক লাইট থাকলেও সেগুলো কোনো কাজে আসে না। ট্রাফিক পুলিশকে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। আসলে হিমশিম খেতে হয় বলা যায়! দশ লাখ বসতির এক জায়গায় যদি আড়াই কোটি জনসংখ্যা বসবাস করে, তাহলে এমন হওয়াই স্বাভাবিক। রাজধানী বিকেন্দ্রীকরণেরও কোনো উদ্যোগ এখন পর্যন্ত কোনো সরকার নেয়নি। এ ক্ষেত্রে রাজনীতির অনেক কঠিন মারপ্যাঁচ আছে, যা সাধারণ জনগণের বোধগম্য হলেও সবাই যার যার পিঠ বাঁচিয়ে চলছে।

আরও পড়ুন

ফিরে আসি বলাকা বাসের ভেতর। এর আগে এই বাসে শেষ কবে উঠেছি মনে নেই। ওঠার পর লক্ষ করলাম জানালাগুলো বেশ চাপানো, আকারেও ছোট। অন্য বাসগুলোর জানালা কিছুটা চওড়া বলে বাতাসের চলাচল ঠিকঠাক হয়। কেন এদের জানালার এমন দশা, কে জানে? তখন গরমের প্রচণ্ড ভাব অতটা না থাকায় সেদ্ধ হইনি। আশা করা যায় কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই সূর্যিমামার তেজ বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাসের ভেতরে পুরোপুরি সেদ্ধ হওয়ার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হবে! বসার কোনো ব্যবস্থা না হওয়ায় দাঁড়িয়ে থেকেই পিঠাপিঠি আড়াই ঘণ্টার যানজটের ঝক্কি পেরিয়ে ট্রেনিং সেন্টারে গিয়ে পৌঁছালাম।

নিচতলায় একটি কক্ষে ট্রেনিংয়ের টাকা জমা দিয়ে ওখানকার ভবনের ভেতরকার প্রবেশপথের সামনে থাকা বিজ্ঞাপন ফলকের নির্দেশনা অনুযায়ী রুমে গিয়ে উপস্থিত হতেই দেখি আগে আরও অনেকে বসে আছেন। ক্লাসের মতো পরিবেশ। কিছুক্ষণ পর ডোরাকাটা দাগের সাদা শার্ট পরা একজন ভদ্রলোক এসে ক্লাসে উপস্থিত সবাইকে নিজের পরিচয় দিয়ে ট্রাফিকের বিভিন্ন নিয়মকানুন, কোন ধরনের চালক কয় নম্বর গাড়ি চালাতে পারেন, সড়ক দুর্ঘটনার বিভিন্ন কারণ, এর প্রতিকার, নবীন চালকদের লাইসেন্স পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশাবলি—সব বিষয়ের প্রাথমিক ধারণা দিলেন। সবচেয়ে বেশি কয়েকটা ব্যাপারের ওপর তিনি জোর দিলেন। যেমন রাস্তায় ওভারটেক করার সময় সব সময় পেছনের গাড়িকে যেতে দিন। কখনো পথ আগলে রাখতে নিষেধ করলেন। আরও একটা ব্যাপার নিয়ে ভদ্রলোক বেজায় অসন্তুষ্ট—স্পিড ব্রেকার। তিনি জানালেন, স্পিড ব্রেকারে যখন কোনো চালক ব্রেক কষেন, তখন ইঞ্জিনের কর্মক্ষমতা হ্রাস পায়। এভাবে যে ইঞ্জিনের পাঁচ বছর কাজ করার কথা, সেই ইঞ্জিন বড়জোর দুই থেকে আড়াই বছর চলে। দুটি ব্যাপারই আমাদের দেশে হরহামেশা দেখা যায়। মনে মনে ভাবছিলাম, পরিচালক মহোদয়ের উদ্দেশ্য শতভাগ সৎ হলেও রাস্তার ট্রাফিকের বেহাল আর অব্যবস্থাপনার কারণে স্পিড ব্রেকারের বিকল্প নেই! এরপরও এত সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে, আর ব্রেকার না থাকলে কি হতো!
ক্লাস শেষে আমাদের চারজনের একটা গ্রুপে ভাগ করে দেওয়া হলো। প্রশিক্ষক একজন মাঝবয়সী যুবক।

লিস্টে আমাদের নাম বুঝে নিয়ে গাড়িতে উঠে পড়লেন। মেরুন রঙের পুরোনো টয়োটা গাড়ি। ম্যানুয়াল আর অটোমেটিক—দুই ধরনের গাড়ি হলেও আমাদের প্রশিক্ষণের জন্য আনা গাড়িটা ম্যানুয়াল। গাড়িতে উঠে চারজনের প্রাথমিক কথাবার্তায় যা বুঝলাম, অন্যরা এখানে এসেছেন শুধু লাইসেন্স নিতে, ক্লাস করে গাড়ি চালানো শিখতে নয় মোটেও। আর আমি হারাধনের একটি মাত্র সন্তান, যিনি এর আগে কখনোই ড্রাইভিং করিনি।

চলবে...