কানাডার চাকরিবৃত্তান্ত-৭ম পর্ব

ইউনিভার্সিটির অফিশিয়াল পেজ
ছবি: লেখক

* ষষ্ঠ পর্বের ধারাবাহিকতায়...

স্বাভাবিকভাবেই ক্লাস, ওয়ালমার্টে দুই ঘণ্টার আসা–যাওয়ার চাকরির পাশাপাশি ইউনিভার্সিটির অ্যাসিস্ট্যান্টের চাকরি তো ছিলই। প্রফেসরের অ্যাসিস্ট্যান্টের চাকরির মেয়াদ চার মাসের। প্রতি সেমিস্টারের শুরুতেই ওটা ডিন হেলেনকে বলে নবায়ন করিয়ে নিতে হতো। তত দিনে আমি প্রায় চারজন প্রফেসরের সঙ্গে কাজ করে ফেলেছি। শুরুটা হেলেনকে দিয়ে হলেও এরপর ক্যারেন বাটারওর্থ, মেলিসা ও সবশেষ মিশেল। সবচেয়ে বেশি মজা পেয়েছিলাম মিশেলের সঙ্গে কাজ করে, অবশ্যই হেলেনের পর।

ইন্টারন্যাশনাল অফিসের সাক্ষাৎকারের পর ষষ্ঠ দিনে ই–মেইল পাই জয়েন করার ব্যাপারে। তবে গতবারের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ে গিয়েছিল। আর্ট গ্যালারিতেও এমন ই–মেইল পেয়েছিলাম, তারপরের ঘটনা আশা করি আপনাদের সবারই জানা আছে। এত দ্রুত বিস্মৃত হওয়ার কথা নয়। ওই ঘটনা থেকে উপযুক্ত শিক্ষা নিয়ে প্রথমেই নিশ্চিত হই এবার এমন কিছু হবে না।

‘গার্ড মি’র সেচ্ছাসেবক দল
ছবি: লেখক

এ পদের মেয়াদও চার মাস! এরপর নবায়নের সিদ্ধান্ত ম্যানেজারের। মূলত আমার চার মাসের কার্যক্রম দেখে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবেন। জয়েন করার প্রথম দিনই ড্যানিয়েলের সহধর্মিণী কেলি আমাকে এটা বলে আশ্বস্ত করলেন, ওনারা সাধারণত চাকরি চুক্তির চার মাসের স্বল্প সময়ের মেয়াদ নবায়ন করেন। এ ব্যাপারে খুব একটা হেরফের হবে না। আমি কিছুদিনের জন্য হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম! অফিসে প্রধান কর্মকর্তা বলা যেতে পারে ডোনাল্ডা জনসটনকে। ইমিগ্রেশনের লাইসেন্স প্রাপ্ত অফিসার তিনি। কেলি, ডোনাল্ডা আর ড্যানিয়েল। আমাকে ট্রেনিং দেওয়ার জন্য ব্রিটনি আর সুমিকে ঠিক করলেন ওনারা। সুমি নেপালি ছেলে আর ব্রিটনি চীনের মেয়ে। তাঁদের সবাইকে নিয়ে গল্পের আসর বসানো যাবে একদিন।

আগের দুটি চাকরির সঙ্গে আরও একটা চাকরি যোগ হলো। কাজের চাপের কথা বাদ দিয়ে আপাতত ইউনিভার্সিটির বেতন ঠিকঠাক দিতে পারব এটাই অনেক স্বস্তির কারণ। বর্তমানে যে পদে চাকরি হলো, সেখানকার আরও একটা বিশেষ সুবিধা হচ্ছে, যত ঘণ্টা ইচ্ছা, কাজ কর। বলা যায় প্রতি সপ্তাহের প্রতিদিনের ৮ থেকে ১০ ঘণ্টার কাজের পুরো সময়ই কাজ করতে পারবেন কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে। ক্যাম্পাসের বাইরের জবের ব্যাপারে এটা করা যায় না। প্রতি সপ্তাহে আপনি ২০ ঘণ্টার বেশি কাজ করতে পারবেন না। বর্তমানে এ নিয়ম বদল হয়েছে।

তখন থেকে শুরু করে ফাইনাল পরীক্ষা পর্যন্ত কোনো সমস্যা হয়নি বলা যাবে না। ছোটখাটো ঝামেলা পিছু ছাড়েনি। কখনো সেটা ইউনিভার্সিটিতে ঘণ্টার হিসাব নিয়ে, আবার কখনো ওয়ালমার্টে। কানাডায় আসার পর ওই সময়ে কাটানো দিনগুলো আমার কাছে স্বপ্নের মতো মনে হয়। ইউনিভার্সিটিতে কাজ করার দরুণ ওখানকার কর্মচারীরা যেখানে কাজ করতেন, সেসব জায়গায় আমাদের ডাকা হতো। সমাবর্তন অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে দীপাবলি উদ্‌যাপন, কেপ ব্রেটন ইউনিভার্সিটির ওপেন হাউসসহ প্রায় সবখানে কাজ করাটা উপভোগ্য ছিল। পাশাপাশি বেশ পরিচিত মুখ হয়ে উঠেছিলাম সিডনি শহরে।

ইন্টারন্যাশনাল অফিসে কাজের এক দিন
ছবি: লেখক

শপিং মল থেকে শুরু করে বাজারের কেনাকাটা, এমনকি বাসে উঠলে, ওখানেও সবাই আমার পিছু নিত! নানাবিধ প্রশ্নের ফুলঝুরি, অধিকাংশই ইমিগ্রেশন আর চাকরিসংক্রান্ত। ওনাদের ইনস্টাগ্রামে পেজ থেকে শুরু করে ফেসবুক, ইউনিভার্সিটি, ওয়েবসাইট—সবখানেই আমাদের নানা ছবি। অনেকটা তারকা খ্যাতি বলা যায়!! একসময় যখন নানা পোস্টারে বিভিন্ন ছেলেমেয়েদের ছবি দেখতাম, এখন সে একই জায়গায় নিজের ছবি দেখতে পাওয়াটা বেশ মজার বলতে হবে! ইন্টারন্যাশনাল অফিসের চাকরির সুবাদে ভার্সিটির স্বাস্থ্যবিমা কোম্পানি ‘গার্ড মি’র সেচ্ছাসেবী সংগঠনের কাজেও যুক্ত হয়েছিলাম। দলের অধিনায়ক হিসেবে সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতাও ছিল দারুণ!

তবে সুখের দিন ক্ষণস্থায়ী। ইউনিভার্সিটিতে ঘণ্টার বাটোয়ারা করল আমাদের ম্যানেজার ভিক্টর। কাজেই ‘যত ঘণ্টা পার, কাজ কর’—এ তত্ত্ব আমাদের বেলায় আর খাটল না! তারপরও তিনটে চাকরি একই তালে করলে তার কিছু সুফল পাওয়া যায়।

অনেক চড়াই–উতরাই পেরিয়ে এসে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে এর পরবর্তী চাকরির খোঁজ করতে লাগলাম। এখানে এত অসংখ্য ঘটনার সম্মিলন ঘটেছে যে অনায়াসে আরেকটা বই লিখে ফেলা যায়! পড়াশোনার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরির বাইরে খণ্ডকালীন কাজের সুযোগ ছিল। এখন সেটা বদলে যাচ্ছে। লেখাপড়ার জন্য স্টাডি পারমিটের প্রয়োজন হয়, যাতে প্রতি সপ্তাহে ২০ ঘণ্টার বেশি কাজ করা বারণ আর গ্র্যাজুয়েশন হয়ে গেলে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ওয়ার্ক পারমিটের জন্য আবেদন করতে হয়।

এরপর পুরো এক বছর ফুল টাইম বা পূর্ণাঙ্গকালীন চাকরি করে স্থায়ী বসবাসকারী হিসেবে নাগরিকত্বের জন্য কাগজপত্র জোগাড় করা শুরু কর। নিজের কাজের ক্যাটাগরি অনুযায়ী আবেদন করার নিয়ম। বেশ পড়াশোনা করতে হয় এসব নিয়ে।

ইউনিভার্সিটির ইনস্টাগ্রাম পেজ
ছবি: লেখক

যা-ই হোক, তখন আমি পূর্ণকালীন চাকরির খোঁজে আবেদন করে যাচ্ছি। বেশ কিছু জায়গা থেকে রিজেকশন আসতে শুরু করল। অবশেষে কনসেনট্রিকস থেকে ইন্টারভিউয়ের কল পাই। আমার পাশের ঘরের রুমমেট জুয়েল এখানে আসার পর থেকে ওখানেই কাজ করে যাচ্ছিল। ও আমাকে জানাল আবেদন করতে। কারণ, ওরা তখন কর্মী নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিল। অবশ্য সারা বছরই এভাবে নিয়োগ দিয়ে থাকে।

কারণ, কল সেন্টারের চাকরিতে বেশি দিন টিকতে পারাটা একটা বড়সড় পরীক্ষার চেয়ে কম নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কানাডিয়ানরা টেকে না আর যারা একবার স্থায়ী হয়ে যায়, তারা মোটামুটি একই জায়গায় বাকি জীবন কাটিয়ে দিতেও বিন্দুমাত্র দ্বিধা বোধ করে না। নিজের চোখে দেখা অভিজ্ঞতার আলোকেই বলছি। তিন ধাপে সাক্ষাৎকার শেষ হলো কনসেনট্রিকসের। সবকিছুই ফোনেই হয়েছে। প্রথম দিনে পরিচিতি পর্ব, দ্বিতীয় ধাপে যাচাই-বাছাই আর তৃতীয় দিনে সমাপ্তি সাক্ষাৎকার।

মূলত দ্বিতীয় ধাপেই চাকরি অনেকটাই নিশ্চিত হয়ে গেল। এরপর ব্যাকগ্রাউন্ড চেক হলো। এটার জন্যও কিছুদিন সময় লাগে। টানটান উৎকণ্ঠার সমাপ্তিতে এল সাময়িক স্বস্তি! তখন করোনা অতিমারি ভয়াল থাবায় অগণিত প্রাণ ঝরে যাচ্ছে প্রতিদিন। কাজেই অফিসে কাজ করার রীতি পাল্টে গিয়ে ঘরে বসে অফিসের কাজ করা শুরু হলো।

আমরা জয়েনের নির্দিষ্ট দিনে অফিসে গিয়ে একটা কমন রুমে সবাই সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে যার যার কম্পিউটারে বসে কিছুটা নিয়মকানুন শিখে নিলাম। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক বিষয় মনে হলো, ওই গ্রুপের ১৭ জনের মধ্যে ১১ জন এসেছে অন্টারিও প্রভিন্স থেকে। আমাদের নোভা স্কসিয়া প্রদেশ থেকে বহু গুণে বড় আর অঢেল সুবিধা থাকা সত্ত্বেও এ ছোট শহরে এসে হাজির হওয়ার কারণ আপনারাই অনুসন্ধান করুন! আশা করি, উত্তর পেয়ে যাবেন।

চাকরির পূর্বশর্ত অনুযায়ী প্রথম একমাস ট্রেনিং আর এর পর থেকে মূল কাজ শুরু। সোজা কথায় কাস্টমারের কল নেওয়া আর তাদের প্রশ্নের উত্তর দেওয়া। হিউমেনা ফার্মেসি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান ফার্মেসিগুলোর মধ্যে একটা। এখানের কাজ ছিল তাদের কাস্টমারদের ওষুধপথ্যের ব্যবস্থা করা। অধিকাংশ গ্রাহকেরাই বয়সে বয়োবৃদ্ধ।

যেকোনো কল সেন্টারের চাকরির ট্রেনিংয়ের সময়কালকে বলা হয় মধুচন্দ্রিমা কাল। তারপরের সময় কতজন চাকরিতে থাকবেন আর কতজন বিদায় নেবেন, তার কোনো ঠিক থাকে না! দেখা গেল আমাদের ব্যাচের সবচেয়ে ভালো ছাত্রীই সবার আগে চলে গেলেন। আমাদের গ্রুপে হেদার ছিলেন সবচেয়ে ভালো ছাত্রী। তাঁর অকস্মাৎ কনসেনট্রিকস ছেড়ে যাওয়া আমাদের বাকি ১৬ জনের জন্য অনেক বড় মানসিক ধাক্কা ছিল।

এতে একটা জিনিস পরিষ্কার হয়ে গেল, যতই বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান থাকুক না কেন, যখন ফোন রিসিভ করে মানুষের আজেবাজে কথা শুনতে হয়, তা হজম করার ক্ষমতা রাখবেন, তাহলে টিকে যাবেন, না হলে এ পথ নিতান্তই কণ্টকাকীর্ণ!

আমাদের ট্রেইনার ক্রিস্টিয়ান অনেক ঠান্ডা মস্তিষ্কের মানুষ ছিলেন। অনুপ্রেরণা দানে তাঁকে অনেকের চেয়ে এগিয়ে রাখব। তবে ট্রেইনিংয়ের সময় বলা ওর অপ্রিয় সত্যি কথাগুলো পরবর্তী সময় কঠোরভাবে বাস্তবরূপে সামনে উপস্থিত হয়ে বেশ অবাকই করেছিল! ও বলেছিল, ‘আমি প্রথম সপ্তাহেই এটা দেখতে চাইব না যে তোমরা একসঙ্গেই বেশ কয়েকজন মিলে চাকরিকে বিদায় জানিয়ে আমার দ্বারা হবে না বলে ছেড়ে চলে যাচ্ছ।’

কিন্তু তাঁর কথাগুলোই সত্যি হয়েছিল, ফোন রিসিভ করার মূল চাকরি শুরু হওয়ার পর আমরা রইলাম ১৩ জন! চারজনের প্রথম দুই দিন, পরেই হদিস নেই! আর পাশাপাশি কারিগরি ত্রুটি লেগেই ছিল সব সময়! ফোন রিসিভ করার পর থেকে শুরু করে পুরো আট ঘণ্টার টানা কাজ করার ধকলের পাশাপাশি সারা দিন মানুষের নানা অভিযোগের কথা শুনতে শুনতে একসময় হাঁপিয়ে উঠতে লাগলাম ধীরে ধীরে। আর এটা ছিল সি ক্যাটাগরির চাকরি।

সবাই আমাকে বি ক্যাটাগরি চাকরি খুঁজতে অনুপ্রেরণা দিলেন। কারণ, যেখানে সি ক্যাটাগরিতে স্থায়ী অভিবাসনের জন্য আবেদন করলে পুরো প্রক্রিয়া শেষ হতে সময় লাগবে ১৮ থেকে ২০ মাস, (বর্তমানে বদল হয়েছে) সেখানে বি–তে সময় লাগে মাত্র আট মাস! তখন থেকেই নতুন চাকরি খুঁজতে লাগলাম। আরও একটা মস্ত বড় ভুল হয়েছিল সে সময়!! আপাতদৃষ্টিতে সবার মনে হবে, ‘বাহ! বেশ তো।’ আমারও সেটাই মনে হয়েছিল, তবে এর ফলাফল ছিল ভয়াবহ! চলবে...