কানাডার চাকরিবৃত্তান্ত: অষ্টম পর্ব
সপ্তম পর্বের ধারাবাহিকতায়...
তখন কনসেনট্রিকসে কাজের রুটিন ছিল প্রতি সোম থেকে শুক্রবার সকাল নয়টা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত। আর বাকি দুই দিন ওয়ালমার্টে চলে যেতাম। পুরো সপ্তাহে কোনো ছুটি থাকত না! প্রাথমিকভাবে কারও কোনো সমস্যা মনে হওয়ার কথা নয়, আমারও মনে হয়নি। কনসেনট্রিকসের চাকরিতে যতটা বিরক্তি বা ঝামেলার মধ্য দিয়ে যেতে হতো, সেটার ধকল অনেকটাই কাটিয়ে উঠতাম ওয়ালমার্টের কাজে!
বছরখানেকের কাজের অভ্যাসের কারণে ওয়ালমার্টে গেলেও মানসিকভাবে খারাপ লাগত না। কেন জানি মনে হয় অপর চাকরির খাটুনির পরিবর্তে ওয়ালমার্টের বাজে কাজও ভালো লাগত! যার কোথাও যাওয়ার পথ থাকে না, সে তার ঘরের এক কোণে জানালায় বসে বাইরের সুনীল আকাশে নিজের আনন্দ খুঁজে ফেরে। ঘরের ফুটো হওয়া টিনের ছাউনি দিয়ে বৃষ্টির গুঁড়ি গুঁড়ি ফোঁটা অভাবীর কল্পলোকে বহুমূল্য মুক্তা মনে হতেই পারে!
সারা দিনের মানুষের অভিযোগ অনুযোগের কথা শোনাও একধরনের চাকরি হতে পারে এটা ধারণা ছিল না। হ্যাঁ, তাদের বহু সমস্যার সমাধান করতে পেরে অনেক ভালো লাগাও কাজ করেছে—অস্বীকার করার জো নেই!
এভাবে অবিশ্রান্তভাবে কাজ করা আর্থিকভাবে স্বচ্ছতা এনে দিলেও মানসিক স্বাস্থ্যের সংকট তৈরি করে। আমার ক্ষেত্রেও সেটাই হলো। একসময় সব মিলিয়ে হাঁপিয়ে উঠলাম। আর ঘরে বসে কাজ করার কারণেও আমার দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়েছিল। বাকিদের কেমন লাগে জানি না, নিতান্তই ব্যক্তিগত অভিমতের আলোকে বললাম।
ভাবতে লাগলাম কীভাবে এ চাকরিকে বিদায় দিয়ে অন্য কোথাও কাজ শুরু করা যায়? ধারণা ছিল না যে নতুন চাকরির খোঁজ পাওয়া কতটা দুষ্কর হতে পারে! এক পরিচিত বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে জানতে পারি, ওদের কাজের ক্যাটাগরি বি! ওর কথামতো সিভি জমা দিয়ে এলাম ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা করে। ক্যাটাগরি বি হওয়ার কারণ এটা সুপারভাইজারের পদ। তখন ওখানে কর্মী নিয়োগের কথা চলছিল।
ওয়ালমার্টে যে সহকর্মীর সূত্রে এখানে যোগাযোগের সুযোগ হয়েছিল, ও-ই জানিয়েছিল ব্যাপারটা। মূলত ভুলের গোলকধাঁধায় ফেঁসে যাওয়ার আগের পর্যায়ে ছিলাম। এরপরই শুরু হলো মূল গল্পের সূত্রপাত, যার মাশুল দিতে হয়েছে দীর্ঘদিন! মানসিক স্বাস্থ্যের চূড়ান্ত অবনতি হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে পুরোনো বিরক্তিকর কাজকে বিদায় দিতে একপ্রকার বাধ্য হলাম। কনসেনট্রিকসের চাকরির সংজ্ঞা আমূল বদলে গেছে। কানে হেডফোন লাগিয়ে আবার বসতে হবে টেবিলে এটা ভাবতেই অসহায় লাগত। তখন চিকিৎসাও নিতে হয়েছে চিকিৎসকদের কাছে। কিন্তু আমি নতুন চাকরির ব্যাপারে আশাবাদী ছিলাম।
সব আশার গুড়ে বালি—নিয়তি আমাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সরে গেল দূরে, অনেক দূরে। পুরো ঘটনার বিবরণ তুলে ধরতে আরও তিনটা পর্বও যথেষ্ট নয়! যা হয়েছিল তার সারসংক্ষেপে এই দাঁড়ায় সে চাকরির আবেদন আমি আগে করলেও দায়িত্ব পেয়ে গেল আমারই পরিচিত সহপাঠিনী! বাকি ঘটনাটা নিজেরাই বুদ্ধিবলে বুঝে নেবেন। মাঝেমধ্যে মনে হয়, যতই পরিশ্রম করুন না কেন ললাটের লিখন বলে হয়তো একটা ব্যাপার আছে।
আর্থিক দিক থেকে ক্ষতির চেয়ে মানসিক বিষণ্নতা আর অবসাদকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারাটাই অনেক কঠিন হয়ে গেল। তখন করোনা অতিমারির থাবায় ছোট্ট শহর সিডনি প্রায় খাঁ খাঁ করছে। যে যেদিকে পারছে চাকরি নিয়ে না হয় বিনা কাজে আশপাশের শহরে চলে গেল। কেউ কেউ তো অন্য প্রদেশেই উড়াল দিল। আমাকেও বন্ধুবান্ধবীরা হ্যালিফ্যাক্সে চলে আসার কথা বলল। হ্যাঁ, এটা ঠিক। একটা প্রদেশের কেন্দ্র হওয়ায় ওখানে কাজের সুযোগ অনেক বেশি। কিন্তু কোনো কাজ ছাড়া তল্পিতল্পা গুটিয়ে ওখানে গিয়ে আচমকা হাজির হওয়াটা অথই জলধিতে ঝাঁপিয়ে পড়া ছাড়া আর কিছুই নয়। তা ছাড়া বিশ্বের যেকোনো রাজধানীর মতো খরচটাও অনেক বেশি। বলা হয়, কোনো প্রদেশের কেন্দ্রস্থল না কি টাকার আকর? সবখানেই টাকা ওড়ে, শুধু কুড়িয়ে নিলেই হলো! বাস্তবতা তা বলে না।
তখন ওয়ালমার্টের মাধ্যমে হ্যালিফ্যাক্সে বদলির হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। এক শহর থেকে অন্য শহরের স্টোরে স্থানান্তরের সুযোগ আছে। শুধু প্রয়োজন হয় স্টোর ম্যানেজারের সদিচ্ছা, সাহায্যের। বিধি বাম! জেনিফার চলে যাওয়ার পর নতুন ম্যানেজার কেটির ব্যক্তিগত আক্রোশের শিকার বারবার কেন হয়েছিলাম তার উত্তর আজও খুঁজে ফিরি। তবে ভাবলাম বিপদে পড়লে হয়তো সে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেও দিতে পারে। আমার ধারণাকে শুধু ভুল নয়, রীতিমতো দুই পায়ে মাড়িয়ে কেটি বুঝিয়ে দিল কিছু মানুষ শুধু নামেই মানুষ, কাজে এরা গুবরে পোকার চেয়েও নগণ্য!
বুঝলেন না তো ব্যাপারটা?
বলছি—আমি ওকে হ্যালিফ্যাক্সের বিভিন্ন স্টোরে যোগাযোগ করতে অনুরোধ করলাম। এটাই নিয়ম। কেটি আমাকে উল্টো পথে হাঁটার রাস্তা দেখিয়ে দিল। নিজে যোগাযোগ না করে আমাকেই বলল, বাকি স্টোরগুলোর ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলতে। আমিও ভাবলাম, যেহেতু ও বলছে, এর মানে নিজেও কল করবে বাকি ম্যানেজারদের। কিন্তু আমি ফোনে কথা বলতেই বুঝলাম, ও কিছুই করেনি। স্বাভাবিকভাবেই অন্য ম্যানেজারদের কাছে আমার কল করার ব্যাপারটা বেখাপ্পা লেগেছে—ওদের সঙ্গে ফোনে কথা বলেই বুঝতে পারছিলাম। এভাবে মাস পার হয়ে গেলেও কোনো আপডেট না পেয়ে আমি নিজের ডিপার্টমেন্ট ম্যানেজার মার্ককেও বিষয়টা জানালেও কোনো ফল তো হয়ইনি, বরং সে আমাকে বলল, ও কারও জন্য ফোন করতে পারবে না! সবকিছু মিলিয়ে একটা সোজাসাপটা কাজ বেশ হযবরল হয়ে গেল কেটির চূড়ান্ত অসহযোগিতার কারণে। এভাবে দুই মাসেও কোনো ফল হলো না দেখে আমি নিজেই হ্যালিফ্যাক্সের স্টোরে সশরীর গিয়ে ওখানকার ম্যানেজারদের সঙ্গে দেখা করব সিদ্ধান্ত নিলাম। করলামও সেটা। আমি যাওয়ার পর কেটিকে ফোন করে জানালাম, ওর সাহায্য লাগবে। কারণ, ওখানকার ম্যানেজার বলল, ও কেটির সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলতে চায়। যখন আমি ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বললাম, ও জানাল অনেক পদই ফাঁকা রয়েছে। এ মুহূর্তে না দেখে ওর পক্ষে বলা সম্ভব না। তবে ও কেটির সঙ্গে আগে কথা বলবে আর অফিসের কাগজপত্র দেখে আমাকে জানাচ্ছে। এরপর কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার কেটির কল পাই। আমি স্টোরের বাইরে অপেক্ষায় ছিলাম! ফোনে ও বলল, আপাতত গ্রিটার পজিশন ছাড়া আর কোনো পদ ফাঁকা নেই। তা–ও মজুরির কোনো নিশ্চয়তাও নেই। রীতিমতো আকাশ থেকে পড়লাম! আশা করি, এ ক্ষেত্রে আর কোনো ব্যাখ্যার প্রয়োজন হবে না। আপনারা এতক্ষণে মূল ঘটনার সূত্রপাত, যবনিকা পতন বুঝতে পেরেছেন।
সিডনি থেকে চাকরি নিয়ে বের হয়ে অন্য শহরে যাওয়ার পথ বন্ধ হয়ে গেল! তখন থেকেই আবেদন করে যেতে লাগলাম। একদিকে পূর্ণকালীন চাকরির সংকট, অন্যদিকে মহামারির দাপট। দুই পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে চিড়েচ্যাপটা হতে লাগলাম। মনে হতে লাগল, এ পরিস্থিতি বের হয়ে আসার কোনো পথ নেই! ওই সময় ওয়ালমার্টের কাজের ফাঁকে ফাঁকে আমার ফেলা দীর্ঘশ্বাস হয়তো ওখানকার প্রতিটি পণ্যসামগ্রীই শুনেছে! শুধু মানুষ শুনতে পায়নি। এই নাভিশ্বাস ওঠা অবস্থার আপাতসমাধান পেলাম না!
একজন মানুষের ব্যক্তিগত আক্রোশ আরেকজনের জন্য কতটা ক্ষতির কারণ হতে পারে, এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ ওয়ালমার্টের বদলি আটকে যাওয়ার ঘটনা। আরও কয়েকটা ঘটনা উল্লেখ করি। এর জন্য আমাদের একটু আগের দিনগুলোতে ফিরে যেতে হবে—প্রথমে কেটি যখন ওয়ালমার্টে যোগ দিল, তখন ও আর গাসি—এ দুজনই মূলত সিডনি ওয়ালমার্ট থেকে বদলি হয়ে এসেছিল। ওখানে কেটি ছিল অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার আর গাসি প্রডিউস ম্যানেজার। এক জায়গায় কাজ করলেও দুজন সম্পূর্ণ বিপরীতে মেরুর মানুষ, এটা এদের কাজের ধরনে পরে বুঝতে পারলাম। নিয়মানুযায়ী আমি কাজের উপস্থিতি শিডিউল জমা দিলাম। একই কাজ এক বছর ধরে করে আসছি। পুরোনো কোনো ম্যানেজার আমার শিডিউল রিজেক্ট করেননি। কেটি জয়েন করেই প্রথম যে কাজটা করল, সেটা আমার রুটিন বাতিল করা। তা–ও বিনা কারণে। অফিসে এসে ওর কাণ্ড দেখে চক্ষু চড়কগাছ! সরাসরি ওর সঙ্গে দেখা করি। ও আমাকে জানাল গাসির সঙ্গে দেখা করতে। কার্টের পর ও তখন নতুন ম্যানেজার হয়েছে মাত্র। অফিসের কম্পিউটারে গাসিকে ঘটনা দেখাতেই ও খুব আশ্চর্য হয়ে বলল, এর বিন্দুবিসর্গ কিছুই জানে না! আমাকে আশ্বস্ত করল, এর সমাধান করবে। করলও তা–ই। কেটিকে বলতেই ও রুটিন মেনে নিল। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এর আগে কেন রিজেক্ট করা হলো?
একই ঘটনা ও আবার করল ক্রিসমাসের ছুটিতে...আবার রুটিন বাতিল। এর আগেরবার গাসি বলেছিল আমার শিডিউলে নাকি সময় যতটা দিয়েছিলাম, সেটাতে কেটি অসন্তুষ্ট, আরও বেশি সময় দিতে হবে। ওকে বুঝিয়ে বললাম, বেশি দিই কী করে, যেখানে সপ্তাহে ২০ ঘণ্টার বেশি কাজই করার নিয়ম নেই! আর এবার কেন করল বোঝা দুষ্কর? তখন ক্লাস না থাকায় রোববার ছাড়া প্রতিদিন কাজের সময় দিয়েছি, তারপরও বাতিল! পুনরায় গাসিই ত্রাণকর্তা হিসেবে হাজির হয়ে বিপদের হাল করল। পরেরবার গাসি বেশ আশ্চর্য হলো কেটির কাণ্ড দেখে! কারণ, সপ্তাহের এক দিন ছাড়া প্রতিদিন সময় দেওয়ার পরও রিজেক্ট করার কী কারণ থাকতে পারে?
পরের ঘটনা করোনাকালে—চারদিকে লকডাউন দেওয়ার পর অধিকাংশ কানাডীয় কর্মী ওয়ালমার্টে কাজ করতে আসা বন্ধ করে দিলেন। ভরসার পাত্র হয়ে রইলাম আমরা এশীয় কর্মকর্তারা। আমাদের বলা হলো কোনো বিরতি না দিয়েই আমরা যত ঘণ্টা ইচ্ছে কাজ করতে পারব। এ ছাড়া কর্তৃপক্ষের আর কোনো উপায়ও ছিল না। অবস্থা এমনও বেগতিক হয়েছিল যে সিডনি ওয়ালমার্ট থেকে অনেক ভারতীয় ছেলেমেয়েকে এসে আমার নর্থ সিডনি স্টোরে কাজ করতে দেখেছি! যথারীতি আবার বাদ সাধল কেটি! চলবে...