যাদের ঘর থাকে না

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

খানিকটা উদ্ভট জিনিস সংগ্রহের শখ ছোট থেকেই। একসময় মুঠোফোন রিচার্জ করার কার্ড জমানোর ভূত মাথায় চাপল। তখন সবেমাত্র স্কুলে ভর্তি হয়েছি। গ্রামীণফোনের ৩০০ টাকার কার্ড কিনে রিচার্জ করা হতো আদ্যিকালের নোকিয়া ১১০০ ফোন। কার্ড কিনে রিচার্জ করা মাত্র আমি কার্ডটা নিয়ে নিতাম। এভাবেই ধীরে ধীরে টেলিটকসহ অন্য কোম্পানির বহু রংবেরঙের কার্ড জমিয়ে ফেললাম। মাঝেমধ্যে দেখতাম কার্ডগুলো। পরে ফ্লেক্সিলোড চলে আসায় সে সংগ্রহ বন্ধ হয়ে গেলেও কার্ডগুলো রয়ে গেছে।

২৩ কেজি ওজনের যে দুটি ব্যাগ নিয়ে আমি সাত মাস আগে ঘর ছেড়ে মার্কিন মুল্লুকে পা রেখেছিলাম, সেই ব্যাগে কিন্তু ছোটবেলার সেই কার্ডগুলোর জায়গা হয়নি।
নানা রকমের স্টিকারও জমাতাম। আর জমাতাম মুদ্রা। খুব বেশি না হলেও ৩০ থেকে ৩৫টা দেশের মুদ্রা ছিল, ছিল বাংলাদেশের বিভিন্ন সময়ের মুদ্রাও। সেসবেরও জায়গা হলো না ব্যাগে, ভার বেশি হবে বলে।

বইয়ের সংগ্রহের কথা বললে তো আর শেষই হবে না। একবার জন্মদিনের আগে পাড়ার প্রিয় লাইব্রেরি বইকুঞ্জে গিয়ে দেখি তিন গোয়েন্দার ভলিউম ২৯, পুনর্মুদ্রিত সংস্করণ। এই বই নীলক্ষেত, বাংলাবাজারসহ কত জায়গায় তন্নতন্ন করে খুঁজেছি, কোথাও পাইনি। নিজের জন্মদিনের আগে বইটা দেখে চোখে জল চলে এসেছিল। তখনই বাবাকে নিয়ে কিনে ফেললাম, আর ঘরে ঢুকেই পড়তে শুরু করেছিলাম ‘আরেক ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’। এভাবে তিন গোয়েন্দার ভলিউম ১ থেকে ১০০-এর সব বইয়ের সংগ্রহ শুরু করি।

অথচ এ রকম অজস্র স্মৃতিবিজড়িত প্রিয় বইয়ের পুরোটাই রেখে আসতে হয়েছে আমাকে, ব্যাগে জায়গা হবে না বলে।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
আরও পড়ুন

কী জানি, আমাকে ছাড়া বইগুলো এখন কেমন থাকে!
এযাবৎ জীবনে কত কিছুর পিছে ছুটেছি, কত কিছুর জন্য ছুটছি, কত কিছুর জন্য ছুটব...অথচ দিন শেষে সবই রেখে চলে যেতে হবে জীবনের নতুন কোনো ধাপে। নতুন করে ঘর বুনতে হয়, বছর শেষে ভেঙে দেব বলে। কী লাভ? কে জানে!

বড় হওয়ার অন্যতম খারাপ দিক হলো এই ঘরছাড়া হওয়া। ভাগ্যবান বলে মোটামুটি স্নাতক অবধি ঘরের কাছাকাছি থাকতে পেরেছিলাম, অনেকের ক্ষেত্রেই বড়জোর কলেজ পর্যন্ত ঘরে থাকার সুযোগ মেলে; এর পর থেকে ঘরছাড়া। যেদিন তোশক, বালিশ আর কিছু জামা-কাপড় নিয়ে হলের উদ্দেশে বাসা থেকে বের হয়েছিলাম, তখন না বুঝলেও এখন বুঝি যে সেদিন থেকেই ঘর নাই হয়ে গেছে। এরপর সেই ঘর আর ফিরে আসবে না। নিজের ঘরে অতিথি হওয়ার দুঃখ অন্য রকম, যার হয় সে-ই বোঝে।

আসলে ঘর কাকে বলে? সহজভাবে দেখলে হয়তো যেখানে বাবা-মা-ভাই-বোন থাকে, তা-ই ঘর। কিন্তু সবই তো সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত হয়। একসময় সবাই গ্রামে একত্রে থাকত; এরপর দেশভাগ হলো, যুদ্ধ হলো, কত দাঙ্গা হলো। কেউ ঘর ছেড়ে দিল, কেউ ছাড়তে বাধ্য হলো, কত ঘর দখল হয়ে গেল। আবার কেউ চাকরির জন্য শহরে পাড়ি জমাল, কেউবা পা রাখল ভিনদেশে।

আরও পড়ুন

নিজের স্বাচ্ছন্দ্যের জায়গা থেকে বেরিয়ে না আসতে পারলে স্থবিরতা ঘিরে ধরে। তাই ভালো থাকার আশায় হয়তো বেরিয়ে আসি সবাই, কিন্তু তবু কোথায় যেন একটা চাপা আক্ষেপ লুকিয়ে থাকে। নতুন ঘরকে নিজের ঘর বলে সহজে মানতে চায় না মন। ভালো আছি বলেও ভালো থাকার সংজ্ঞা নিয়ে দ্বন্দ্বে পড়ে যাই। কোথায় যেন কী নেই। এভাবে দৌড়েই যেতে হবে এক ঘর থেকে আরেক ঘরে? থিতু হওয়ার জো নেই?
ঘর নেই, নাকি ছিল না কোনো দিনই?

*লেখক: অংকন ঘোষ দস্তিদার, শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয় আরবানা-শ্যাম্পেইন

**দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস [email protected]