রোদের অপেক্ষা

মধ্যাহ্নভোজ শেষ করে আয়েশ করে বসতে বসতে বেলা অনেকটাই গড়িয়ে যায়। ইলিনয় রাজ্যের এ অঞ্চলে আকাশ বেশ উদারভাবে দেখা যায়, ভবন নামক দৈত্যগুলো এখনো এ স্থান দখল করতে পারেনি। সেই আকাশ ভেদ করে নিচের বাড়িঘর আর রাস্তার ওপরে উষ্ণ রোদ ছড়িয়ে আছে। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলে কেমন যেন ঘোর লাগে। মনে হয়, এমনটা তো আগেও দেখেছি।

কবে দেখেছি মনে করতে গেলে সময়ের হদিস পাই না। আবছাভাবে শুধু মনে পড়ে, অনেক বছর আগে গ্রামের দুপুরের রোদ ঠিক এ রকম উষ্ণ ছিল। দুপুরে খাবার পর সবাই যখন তন্দ্রাচ্ছন্ন কিংবা ঘুমে, ঠিক তখন আমি বেরোলে দেখতে পেতাম— কাঁঠালগাছ, পাশের উঠান, গরুর ঘর, ফুলের গাছ আর মন্দিরজুড়ে এ রকম রোদ ছড়িয়ে থাকত। আমি একা একা এদিক-ওদিক হাঁটতাম, বেশ লাগত। এর খানিক পরে ভাইয়েরা সবাই ঘুম থেকে উঠলেই একসঙ্গে ক্রিকেট খেলা হবে, আশপাশের বাড়ির ছোটরাও আসবে। তারও খানিক পরে ঠাকুমা সান্ধ্যপূজার তুলসীপাতা খাইয়ে দেবে। এর পরপরই বাড়িতে কিংবা বাজারে গিয়ে তেলেভাজা কিছুর সঙ্গে চা খাওয়া হবে।

বাড়ি ফিরে আবার ব্যাডমিন্টন, কিংবা লোডশেডিং হলে হারিকেনের আলোতে চোর-পুলিশ খেলা হবে মেঝেতে পাটি বিছিয়ে। ‘ওরে, ঠান্ডা লাগবে’ বলে ঠাকুমা চিৎকার করবে, যা আমরা এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্য কান দিয়ে বের করে দেব। একে একে নিষেধাজ্ঞা আসবে মা–বাবা-কাকা-কাকি সবার থেকে।

প্রায়ই বেশ কুয়াশা পড়ত, কয়েক ফুট দূরের বস্তুও তখন একেবারেই আবছা। এর মধ্যেই সব ধরনের খেলা চলত। এরপর রাতে কনকনে ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে রাতের খাবার খাব, কিংবা মা খাইয়ে দেবে। বাকিরা অবশ্য এরপরও ব্যাডমিন্টন খেলবে। আমি ছোট, আমার রাত জেগে খেলার অনুমতি নেই।

সামান্য রোদ থেকে এত কিছু কেন মনে পড়ল, পুরোপুরি নিশ্চিত নই। সম্ভবত এ ধরনের রোদের মধ্যে একধরনের অপেক্ষা লুকিয়ে থাকে। সেটা হতে পারে রোদ পড়লেই সবাই মিলে ক্রিকেট খেলার অপেক্ষা। কিংবা একসঙ্গে বসে চা খাওয়ার অপেক্ষা। শিশিরে ভিজে ব্যাডমিন্টন খেলার অপেক্ষা। ভাইদের সঙ্গে খুনসুটি করার অপেক্ষা। হারিকেনের নিভু নিভু আলোতে চোর-পুলিশ খেলার অপেক্ষা। ঘরের এক কোনায় শুয়ে আমাদের ঠান্ডা লাগবে কি না বা ঠিকমতো খেয়েছি কি না, ভাবতে থাকা ঠাকুমার বকা খাওয়ার অপেক্ষা।

ওই সময়ের কিছু পাওয়া না–পাওয়ার পুরোটাই যে প্রাপ্তি ছিল, তা বুঝতে বুঝতে ক্যালেন্ডারের হিসাবে যুগ কেটে যায়।

সময়গুলো চলে গেছে, কিছু মানুষও চলে গেছে। বোকা অপেক্ষাগুলো কোথাও চলে যাওয়ার জায়গা পায়নি, ওগুলো রয়ে গেছে। রয়ে যাবে রোদের ভাঁজে, শীতল হাওয়ার আঁচলে, কিংবা ভবিষ্যতের চিলেকোঠায়।

* লেখক: শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয় আরবানা-শ্যাম্পেইন, যুক্তরাষ্ট্র