বৃদ্ধাশ্রম: পশ্চিমা ও আমাদের সমাজ-২

এখন দেখব আমাদের দেশের দৃশ্যপট।

প্রথম পার্থক্য হচ্ছে, আমাদের বাবা-মায়েরা জীবন উৎসর্গ করতে রাজি থাকেন সন্তানদের জন্য। যত সম্পদ গড়েন, সবই সন্তানদের জন্য। নিজের বাড়িতে রেখে ছোট থেকে বড় করে পড়ালেখা করিয়ে চাকরি তো পাওয়া, তারপর যখন বিয়ের সময় আসে, তখন নিজের পকেটের সব টাকা উজাড় করে হলেও ধুমধামের সঙ্গে বিয়ে দেন। সন্তানদের বিয়ে দিয়ে পথে বসেছেন, এমন কিছু পরিবারের ব্যাপারে বেশ কয়েক বছর আগে পড়েছিলাম। এখনো এমনটা ঘটে অহরহ। পশ্চিমা বাচ্চারা নিজেদের বিয়েতে বাবা-মায়ের টাকা চায় না। আর আমরাই অবুঝের মতো এমন সব আবদার করে বসি, একবারের জন্যও চিন্তা করি না বাবা-মায়ের সামর্থ্যে আছে কি না।

রিটায়ারমেন্টের টাকা যা জমানো থাকে, সন্তান বিপদে পড়লে সেটা নির্দ্বিধায় দিয়ে দেন। অনেকে নিজের বাড়িঘর বেচে দেন। চিন্তা করেন না যে সন্তান যদি তাঁদের নিজের বাড়িতে আশ্রয় না দেয়, তাহলে তাঁদের কী হবে! মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে কোরবানির সময়ে গরু বা খাসি বা রমজানে প্লেটভর্তি ইফতারি না পাঠালে ইজ্জত থাকে না। বাবা-মায়ের সামর্থ্যে না থাকলেও এই বর্বর সামাজিক প্রথার কারণে নিজেদের ব্যাংক-ব্যালান্স খালি করে ফেলতে হয়। এ ছাড়া বিয়ের সময়ে যৌতুকের কথা বাদ দেব কীভাবে? মেয়ের গয়না, জামাকাপড় সবকিছুর পুরোটাই আসে বাবা-মায়ের পকেট থেকে। ওয়েস্টার্ন ছেলেমেয়েদের মতো ছেলেমেয়েরা নিজেদের খরচে নিজেরা বিয়ে করে দেখাক, দেখবেন অনেক অযথা ফালতু আহ্লাদী প্রথা লুপ্ত হয়ে যাবে।

আমাদের সমাজে প্রতিদিনই বাবা দিবস, প্রতিদিনই মা দিবস, প্রতিদিনই থ্যাংকসগিভিং।

দুই সমাজের মধ্যে কোনটা ভালো কোনটা মন্দ এই বিচার করতে যাবেন না। পশ্চিমা সমাজের এই রীতিটা অবশ্যই প্রশংসনীয় যে তাঁদের সন্তানেরা অতি অল্প বয়স থেকেই আত্মনির্ভরশীল হয়ে গড়ে ওঠে। নিজের খরচ মেটাতে বাবা-মায়ের হাতের দিকে তাকিয়ে থাকে না। গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে ডেটিং থেকে শুরু করে বিয়ে পর্যন্ত কোথাওই বাবা-মায়ের কাছে হাত পাতে না। শ্রমের মর্যাদা ওরা কেবল রচনায় ভালো নম্বর পাওয়ার জন্য মুখস্থ করে না, ওরা বাস্তবেই তা করে দেখায়। এগুলোর সবই আমাদের সমাজে মিসিং। আমাদের দেশেরও অনেক কিছুই ভালো, অনেক কিছুই খারাপ। ‘সব’ ভালো বা ‘সব’ খারাপের অস্তিত্ব কোনো সভ্যতাতেই নেই।

তাহলে বাংলাদেশের কনটেক্সটে বৃদ্ধাশ্রমের ব্যাপারে কী বলা যায়?

প্রথমত, আমাদের দেশটা স্বপ্নপুরী নয়। বিশ্বের কোনো দেশই তা নয়। দেশে অনেক সন্তানই আছে যারা বাবা-মায়ের দায়িত্বকে বোঝা মনে করে। ব্যাডমিন্টনের শাটল ককের মতো এই কোর্ট থেকে ওই কোর্টে ছুড়ে মারা হয়। বড় ভাই বলে ছোট ভাই দায়িত্ব নিক, ছোট ভাই বলে বড় ভাই নিক। নিজের বাবা-মায়ের পেছনে সে কত টাকা খরচ করেছে, সেই হিসাব টুকে রাখে আলাদা ডায়েরিতে। সংসারে চলে অশান্তি। বউ বলে শ্বশুর-শাশুড়ি এই এই সমস্যা করেছে, শ্বশুর-শাশুড়ি বলে বউ এইটা-ওইটা করেছে, মাঝে দিয়ে ছেলের অবস্থা দফারফা।

আরও পড়ুন

তারপর একদিন মাথায় বুদ্ধি আসে, এই যন্ত্রণা বিদায় করতে পারলে ভালো। তাই একদিন সকালে বাবা-মাকে রেল বা বাসস্টেশনের বেঞ্চে বসিয়ে ছেলে পালিয়ে যায়। অতি দয়াবান হলে হয়তো সে বৃদ্ধাশ্রমে ভর্তি করিয়ে আসে। এসব ঘটনা মোটেও কাল্পনিক না। বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রিত প্রায় প্রতিটা বৃদ্ধ-বৃদ্ধার জীবনের বাস্তব ঘটনা। টিভিতে, পত্রিকায় এসব ঘটনাই বারবার আসে। সামনাসামনি কথা বললেও একই গল্পই শুনবেন। বাংলাদেশের বৃদ্ধাশ্রম এবং এতিমখানার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। এই উক্তির সূত্র ধরেই আসা যাক, বাংলাদেশের বৃদ্ধাশ্রমের পরিবেশ কেমন সেই আলোচনায়।

প্রথমে আমার এ প্রশ্নের জবাব দিন, সেখানে কোনো কর্মচারী যদি কারও সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে, ওর কোনো বিচার হবে? না, হবে না। বাংলাদেশের বড় বড় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতেও যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে কেউ কোনো ব্যবস্থা নেয় না, কাজেই এতিমখানা হোক, মাদ্রাসা হোক কিংবা বৃদ্ধাশ্রম, কোথাওই কোনো রকমের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না যতক্ষণ না ঘটনা পত্রিকা বা সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হচ্ছে।

বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা বলতেও পারবেন না কিছু। কারণ ওদের নিজেদের বাড়িতেই আশ্রয় নেই, এই আশ্রয়টুকুও যদি যায়, তখন? যৌন নিপীড়ন ছাড়াও যেকোনো ছোট-বড় দুর্ব্যবহারের উদাহরণই ধরে নিন, কোথাওই কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে না। সেখানে খাওয়াদাওয়ার মান কতটা উন্নত? পানির মধ্যে ডাল খুঁজে পাওয়া যায় না, ঝোলের নিচে মাংসের অস্তিত্ব নেই—এসব আমাদের কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় হল ক্যানটিনের সাধারণ দৃশ্য। তাগড়া যুবকদের প্রতিষ্ঠানেই যদি এ অবস্থা হয়ে থাকে, তাহলে দুর্বল বৃদ্ধদের খাবারের মান কী হবে তা সহজেই অনুমেয়। নিজের বাড়িতে নিজের স্বাধীনতা থাকে। একদিন মুরগি খেতে ইচ্ছা করে, একদিন মাছ, একদিন নিরামিষ। বৃদ্ধাশ্রমে বা দুনিয়ার কোথাও কি এই স্বাধীনতা থাকে?

আরও পড়ুন

এ ছাড়া নিজের নাতিপুতিদের সঙ্গে কাটানো সময়কে আপনি দুনিয়ার আর কোনো কিছুর সঙ্গেই সমতুল্য করতে পারবেন না। আপনি যুক্তি দিতে পারেন, বৃদ্ধাশ্রমে বৃদ্ধদের সময় ভালো কাটার কথা। সমবয়সীরা একসঙ্গে মিলেমিশে গল্পগুজব করে। যেসব বাড়িতে সন্তানেরা অফিস করে এবং বৃদ্ধ বাবা-মাকে একা থাকতে হয়, ওদের বিপদে দেখার কেউ নেই, সেই বাড়ির জন্য বৃদ্ধাশ্রম বেস্ট সমাধান। কথা ঠিক, তবে সেটা অবশ্যই একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত। যতক্ষণ বাড়িতে কেউ নেই, সেই সময়টা তাঁরা যদি বৃদ্ধদের সঙ্গে হাসিঠাট্টা আনন্দ করে কাটান, ততক্ষণ পর্যন্ত এটি ঠিক আছে। বাচ্চাদের ডে-কেয়ারের মতো বৃদ্ধদের ডে-কেয়ার ফ্যাসিলিটি। অফিস শেষে বাড়ি ফেরার সময়ে সবাই ফিরে এলেন।

এখন প্রশ্ন ওঠে, বাংলাদেশে বৃদ্ধাশ্রমের প্রয়োজন আছে কি নেই? অবশ্যই প্রয়োজন আছে। না হলে যেসব ছেলেমেয়ে বাবা-মাকে রাস্তাঘাটে ফেলে যায়, তাদের কী হবে? রাস্তায় ভিক্ষাবৃত্তি ছাড়া তাঁদের যে কিছুই করার থাকবে না। তাঁদের জন্যই প্রয়োজন আছে বৃদ্ধাশ্রমের।

এ ছাড়া যদি কোনো বৃদ্ধ-বৃদ্ধা স্বেচ্ছায় বৃদ্ধাশ্রমে থাকতে আগ্রহী হন, প্রবাসে যা অতি স্বাভাবিক ঘটনা, সে ক্ষেত্রে তাঁদের জন্যও বৃদ্ধাশ্রমের প্রয়োজন আছে। আমি নিজেই হয়তো পছন্দ করব নিজের জীবনের শেষ অধ্যায়টা বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে দিন-রাত আড্ডাবাজি করে কাটাতে। এ ক্ষেত্রে মূল পার্থক্যটা হচ্ছে, এখানে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা স্বেচ্ছায় বৃদ্ধাশ্রমে আসতে আগ্রহী, আর অন্যটায় ছেলেমেয়েরা ধোঁকা দিয়ে তাঁদের ফেলে দিয়ে আসে।

সর্বক্ষেত্রেই বৃদ্ধাশ্রমের পরিবেশ উন্নত হতে হবে। সেখানে কর্মরত কর্মচারীদের দৈনন্দিন সাধারণ কাজের পাশাপাশি মোরাল, এথিকাল ট্রেনিংও দিতে হবে। যারা স্রেফ টাকার প্রয়োজনে এই চাকরি করছে, এমন লোক নিয়োগ না দিয়ে বরং যারা মানবসেবাকেই নিজের জীবনের ব্রত জ্ঞান করছে, এমন কর্মচারী নিয়োগ দিতে হবে। না হলে ‘কাস্টমার সার্ভিস’ জীবনেও উন্নত করতে পারবেন না।

অনেকেই দাবি করেন, এতিমখানার এতিমদের এবং বৃদ্ধাশ্রমের বৃদ্ধদের কেননা একসঙ্গে এক ছাদের নিচে রাখা হোক। দুই পক্ষেরই আপন কেউ নেই। এরাই এক পক্ষ আরেক পক্ষকে আপন করে নিক।

খুবই মহান চিন্তা। কারণ, এর ফলে বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা শেষ বয়সে এসে নাতিনাতনি পান এবং এতিম শিশুরাও দাদা-দাদির ভালোবাসার সঙ্গে পরিচিত হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও একটি বিপদের শঙ্কা থাকে। গোটা বৃদ্ধাশ্রমে যদি একটাও পার্ভার্ট বৃদ্ধ থাকে, যে স্বভাবে পেডোফাইল, তাহলেই সর্বনাশ হয়ে যাবে। এরা খুঁজে খুঁজে এমন সব দুর্বল শিশুদেরই টার্গেট করে, যারা মুখ ফুটে কাউকে কিছু বলতে পারে না। তখন সেই শিশুর জীবন শেষ। এই রিস্ক কে নেবে? যদিও সাধারণ এতিমখানাতেও একই রিস্ক থাকে। মাদ্রাসাতেও। সব প্রতিষ্ঠানেই।

এখন একটি সত্য ঘটনা বলি।

আমার বাবা আমেরিকায় পড়ালেখা করতে চেয়েছিলেন। ছোট চাচা চলে এসেছেন তত দিনে, ভালোই করছে। আব্বুরও ইচ্ছা হলো। এর ফলে জীবনে স্বচ্ছন্দ আসবে, সবচেয়ে বড় কথা, ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা অনেকখানিই কমে যাবে। যত দূর জানি, একটি ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগও পেয়েছিলেন। দাদাও খুশি হলেন, তবে শুধু একটি প্রশ্ন করলেন, ‘আমরা থাকব কোথায়?’

আসলেই যদি আব্বু যদি আম্মুকে নিয়ে চলে আসতেন তাহলে দাদা-দাদির থাকার কোনো স্থান ছিল না। কোন স্টুডেন্ট, সে যত ব্রিলিয়ান্টই হোক, নিজের বাবা-মাকে আনতে পারে না। গ্রিনকার্ড, সিটিজেনশিপ ইত্যাদি বহু বছরের ধাক্কা। তত দিনে দাদা-দাদির হায়াত থাকার সম্ভাবনা কম।

কাজেই, আব্বু নিজের ইচ্ছা, ক্যারিয়ার ইত্যাদি কোরবানি করলেন।

আমার বাবার গর্ব ছিল এই যে আমার দাদা-দাদির মৃত্যু তাঁর বাড়িতেই ঘটেছে। সেই বাবা-মায়ের দোয়াতে জীবনে কখনোই তিনি কোথাওই আটকে থাকেননি। যে ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যতের জন্য তিনি প্রবাসে পড়াশোনা করতে চেয়েছিলেন, সেই তিনজনই প্রবাসে প্রতিষ্ঠিত। সবই শুধু সময়ের ব্যাপার। মাথার ওপর বাবা-মায়ের দোয়া থাকলে পৃথিবীর কিছু নিয়েই চিন্তার কোনো কারণ নেই।

আপাতত এখানেই লেখা শেষ করি।

অনেকের জন্যই অস্বস্তিকর বিষয় এটি জানি। কিন্তু এটি এখন আমাদের সমাজের ‘এলিফ্যান্ট ইন দ্য রুম’। মানে হচ্ছে, আমাদের সমাজে ঘটনাটা ঘটছে এবং আমরা সবাই তা জানি, কিন্তু কেউই পাত্তা দিচ্ছি না। ভাবছি পাত্তা না দিলে আপনাতেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। বাস্তবতা হচ্ছে, কোনো সমস্যাই আপনাতে সেরে ওঠে না। আমরা চুপচাপ ইগনোর করলে, কিংবা গালাগালি ও তিরস্কার করলে যেই হারামজাদা নিজের বাবা-মাকে রাস্তায় ফেলে আসে, সে শুধরে যাবে না।

বাস্তবতা মেনে নিয়ে ইতিবাচক-নেতিবাচক ইত্যাদি বিবেচনায় ধরে কীভাবে এটাকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব, সেটা নিয়েই বরং আমাদের ভাবা উচিত। ইংরেজিতে যেটাকে বলে ‘ড্যামেজ কন্ট্রোল’।