বৃদ্ধাশ্রম: পশ্চিমা ও আমাদের সমাজ-১
কিছুদিন আগে বাংলাদেশের সবচেয়ে আনকমফোর্টেবল কিছু টপিকের একটি ‘বৃদ্ধাশ্রম’ নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। ভাবলাম, কমেন্টে এই আলোচনা সীমাবদ্ধ না রেখে বরং একটা আলাদা পোস্টই করা যাক। এতে বেশি পাঠকের কাছে পৌঁছানো যাবে। খুবই প্রয়োজনীয় বিষয়, তাই বিশেষ মনোযোগ চাইছি।
বৃদ্ধাশ্রম কনসেপ্টটা বিদেশি, আমাদের দেশে কয়েক দশক আগেও এর অস্তিত্ব ছিল না। বর্তমানে দেশব্যাপী এক শর ওপর বৃদ্ধাশ্রম আছে (এটি আমার ধারণা কেবল, সংখ্যা হাজার ছাড়াতে পারে, কমও হতে পারে, আমি নিশ্চিত না), তবে আমাদের সমাজে একে নেতিবাচক হিসেবেই দেখা হয়। ধরেই নেওয়া হয় যাঁদের বাবা–মা বৃদ্ধাশ্রমে থাকেন, তাঁরা কুলাঙ্গার। আবার পশ্চিমা দেশে ব্যাপারটা খুবই স্বাভাবিক। বাবা–মা বৃদ্ধাশ্রমে থাকবেন, সেটাই তাঁদের জন্য ভালো। তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, একই পৃথিবীতে আমরা থাকি, অথচ দুই সমাজে এমন বিপরীত চিত্র কেন?
উত্তর হচ্ছে, দুই সমাজের চরিত্রই ভিন্ন।
পশ্চিমা বিশ্বে সবাই একক পরিবারে বিশ্বাসী। বাচ্চাকাচ্চা জন্মে, ওদের বেড়ে ওঠার ট্রেনিং এমন হয় যেন ওরা অতি দ্রুত আত্মনির্ভরশীল হয়ে ওঠে। সেই দুগ্ধপোষ্য অবস্থাতেই তাদের আলাদা বিছানা, আলাদা রুমে থাকতে বাধ্য করা হয়। চার–পাঁচ বছর বয়সের আগে বাচ্চা এলার্ম দিয়ে ঘুম থেকে উঠে দাঁত ব্রাশ করে স্কুলের জন্য কাপড় পরে নিচে ব্রেকফাস্ট টেবিলে আসে। ১৬ থেকে ১৮ বছর বয়সেই ওরা বাবা–মায়ের বাড়ি ছেড়ে (ছোট ঘর হোক বা আলিশান রাজপ্রাসাদ) নিজের মতো করে স্বাধীনভাবে থাকতে এপার্টমেন্টে বা রুমমেটের সঙ্গে কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডরমিটরিতে থাকতে শুরু করে। এই খরচের টাকা ওরা নিজেরাই রেস্টুরেন্টে বা দোকানে কাজ করে তোলে। পাশাপাশি পড়ালেখা চালিয়ে যায়। ওদের বন্ধুবান্ধবের মধ্যে যারা ‘প্রাপ্তবয়স্ক’ (এডাল্ট) হওয়ার পরও বাবা–মায়ের সঙ্গে থাকে, তারা ‘লুজার।’ আমাদের দেশের কনসেপ্টে, যদি আমরা দেখি কলেজে পড়া কোনো সুস্থ–সবল ছেলেকে তাঁর মা হাত ধরে স্কুলে নিয়ে আসেন এবং নিয়ে যান, কোচিং সেন্টারেও একইভাবে নিয়ে যান, ব্যাপারটা ওর সমবয়সী ছেলেমেয়েরা যেভাবে নেবে, এখানেও ঘটনা একই। আমাদের দেশে ছেলে এসএসসি এইচএসসি পাস করার পর নিজের মতো আলাদা থাকতে শুরু করেছে, এই দৃশ্য আমরা এখনো কল্পনাও করতে পারি না। মেয়েদের ক্ষেত্রে তো প্রশ্নই ওঠে না। ‘আমাদের দেশের মেয়েরা বাড়ি ছেড়ে উচ্চশিক্ষার জন্য হোস্টেলে কিংবা মেসে থেকে পড়াশোনা করে’—এই উদাহরণ আর বিদেশি লাইফ স্টাইল এক নয়। আমাদের মেয়েরা বাড়ির বাইরে গেলেও বিদেশিদের মতো স্বাধীন ও আত্মনির্ভরশীল থাকে না। বাবা–মায়ের শাসন, বারণ ইত্যাদি মেনে চলে। ওয়েস্টার্ন একটি এডাল্ট মেয়েকে আপনি কিছুই বলতে পারবেন না। ও প্রাপ্তবয়স্ক, ওর জীবন, ও যা খুশি তাই করতে পারে। তা এই হচ্ছে দুই সভ্যতার ছেলেমেয়েদের বেড়ে ওঠার মাঝে বেসিক পার্থক্য।
এখন অতি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট, পশ্চিমা দেশে বাবা–মায়েরা সারা জীবন চাকরি করেন এবং রিটায়ারমেন্টের জন্য টাকা জমান। যাতে বৃদ্ধ বয়সে কারোর কাছে হাত পাততে না হয়। সন্তানেরা বিপদে পড়লে, টাকার প্রয়োজন হলে বাবা–মা ইচ্ছা করলে এই টাকা ধার দেন, লিখিত কন্ট্রাক্ট থাকে যে সন্তান এত দিনের মধ্যে টাকা ফেরত দেবে। অনেক ক্ষেত্রে অনেক বাবা-মা টাকা দেন না। ওর বিপদ, ও নিজেই উদ্ধার হওয়ার পথ খুঁজে বের করুক। আমি দিলে যদি টাকা ফেরত না দেয়? শেষ জীবনে কে হোমলেস হতে চায়?
আমাদের দেশের কনটেক্সটে ব্যাপারটাকে ‘স্বার্থপর’ শোনালেও ব্যাপারটা যথেষ্টই প্র্যাকটিক্যাল। জীবনের সব সঞ্চয় ছেলেমেয়েদের পেছনে ব্যয় করার পরে গ্যারান্টি কি যে এই সন্তান আপনাকে সম্মানের সঙ্গে শেষ দিনগুলোতে দেখেশুনে রাখবে? আবেগ আলাদা বিষয় এবং বাস্তবতা ভিন্ন। তাই ওরা ‘সাবধানের মাইর নাই’ নীতিতে বিশ্বাসী।
আমেরিকায় ‘ফ্যামিলি টাইম’ হচ্ছে ক্রিসমাস এবং ‘থ্যাংকস গিভিং’ ডিনার। গোটা বছরে এই একটা সময়ই এডাল্ট বাচ্চারা বাবা–মায়ের সঙ্গে দেখা করতে আসে, ডিনার করে একসঙ্গে। ফাদার্স ডে, মাদার্স ডেতে নিজেদের বাচ্চাদের নিয়ে নানা পরিকল্পনা থাকে, তাই সব সময়ে সবাই নিজের বাবা–মায়ের কাছে সশরীর উপস্থিত হতে পারে না। একটা ফোনকল করে, কার্ড পাঠায়, গিফট দেয়। দায়িত্ব শেষ। ওরাও মেনে নেয়। ওরাও এমনই করেছিল। এটাই ওদের দেশের বাস্তবতা।
এবং সব শেষে ওদের বৃদ্ধাশ্রমের পরিবেশটাও একটু তুলে ধরা যাক। ট্রেইন্ড প্রফেশনালরা কাজ করে, যারা জানে কখন কোন পরিস্থিতিতে কী করতে হয়। নিবাসীদের জন্য নানা অ্যাক্টিভিটিজ থাকে। সময়মতো পুষ্টিকর খাওয়াদাওয়া ও ব্যায়ামের ব্যবস্থা থাকে। কোনো নার্স বা কর্মচারী দুর্ব্যবহার করলে ঠিক জায়গামতো বিচার দিলে এবং তদন্তে দোষী প্রমাণিত হলে ওর চাকরি চলে যেতে পারে। কাস্টমার রিভিউ ওদের কাছে সবকিছু। একটা রেটিং যদি বাজে আসে, তাতেই ওদের ব্যবসা চরম মার খায়। কাজেই প্রতিটা কাস্টমারকে খুশি করতে ওরা জানপ্রাণ দিয়ে দেয়।
এখন দেখব আমাদের দেশের দৃশ্যপট। চলবে...