একজন ডালাসবাসীর চোখে নিউইয়র্ক নগরী

পাঁচ–ছয় বছর ধরেই নানা কারণে প্রতিবছর আমার নিউইয়র্ক যাওয়া হয়। বিশ্ব অর্থনীতির রাজধানী, ব্রডওয়ে থিয়েটারের রাজধানী ইত্যাদি নানান পরিচয় থাকলেও আমার কাছে নিউইয়র্ককে আমার মতো করেই ভালো ও ক্ষেত্রবিশেষে মন্দ লাগে।

প্রথমে বলি ভালো লাগার দিকগুলো।

আমি ডালাসে থাকি। আমার জীবনে আজ পর্যন্ত ১৭ বছরের বেশি সময় কোনো নির্দিষ্ট এলাকায় থাকা হয়নি। এই শহরেই আমার লেখাপড়া, চাকরি, সংসার, বাড়ি, গাড়ি, বাচ্চাদের স্কুল ইত্যাদি। ডালাসে আক্ষরিক অর্থেই আমার শিকড় গজিয়ে গেছে। তবে ডালাস, অস্টিন, হিউস্টোন, সান-আন্তোনিও (টেক্সাসের বড় শহরগুলো) ইত্যাদি শহর অন্যান্য সাধারণ আমেরিকান বড় শহরগুলোর মতোই। কিন্তু আটলান্টিকপারের মহানগরীতে যেহেতু জনসংখ্যা ও বর্ণবৈচিত্র্য অনেক বেশি, সেখানে গেলে আপনি এক শহরের ভেতরেই বহু দেশ ও জাতির সঙ্গে অথেন্টিকভাবে পরিচিত হয়ে যাবেন। যেমন আমি গিয়ে এবার যেখানে হোটেল নিলাম (ফ্ল্যাশিং-মেইনস্ট্রিট), এলাকাটাকে প্রথম নজরে সাংহাই বলে ভ্রম হবে। অনেক চীনা মানুষের বাস। পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন একটা এলাকা। অনেক চাইনিজ রেস্তোরাঁ, বেকারি ও গ্রোসারি শপ। আমার হোটেলটা যদিও আমেরিকান চেইন হোটেল, তারপরও এর ম্যানেজার থেকে শুরু করে রুম সার্ভিস পর্যন্ত সবাই ছিল চৈনিক সভ্যতার নিদর্শন। এবং সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং দিকটা হচ্ছে, আমার এলাকাটা ‘চায়না টাউনও’ না। ওটা আলাদা বিশেষ একটা এলাকা।

এভাবেই নিউইয়র্কের বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষ বছরের পর বছর থাকতে থাকতে আশপাশের এলাকাকে নিজেদের দেশের মতোই করে ফেলেন।

ট্রেনে করে ওদের ম্যানহাটান সিটির অলিগলিতে উঁচু ভবন আর অর্থবিত্তের চাকচিক্যে আপনার মাথা চক্কর দিয়ে উঠবে। সে অঞ্চল দেখলে আপনার মনে বিশ্বাস হতে বাধ্য কেন আমেরিকা বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ এবং নিউইয়র্ক প্রাণকেন্দ্র। কিছু পথ গেলেই আপনি প্রবেশ করবেন চায়না টাউনে। দেখবেন ফুটপাতেই বিক্রি হচ্ছে ফলমূল, খোলাবাজারে বিক্রি হচ্ছে মাছ। টেক্সাসে যেমন আমরা বন্ধ দোকানে মাছ ও ফলমূল কিনে অভ্যস্ত। টেক্সাসে ফুটপাতের ওপর কোনো দোকান এখন পর্যন্ত দেখা হয়নি। ‘চায়না টাউনে’ চাইনিজ বেকারিতে রাস্তার দুই পাশ পরিপূর্ণ। কাচের ওপাশে গ্রিল্ড হাঁস জিব সিক্ত করছে। বাতাসে চাইনিজ খাবারের গন্ধ। দোকানের সাইনবোর্ডও চীনা বর্ণমালায় লেখা। ফুটপাত ধরে হেঁটে বেড়ানো লোকজনের বেশির ভাগই চীনা। কিছু সাদা চামড়ার মানুষের দেখা পাবেন, মনে হবে তাঁরা ট্যুরিস্ট। এমনকি এমন বহু স্থানীয় লোকজন পাবেন, যাঁরা ইংলিশে কথা বলতে ও বুঝতে পারেন না। তাঁরা এ দেশেই থাকেন, কাজকর্ম করেন, বেড়ে ওঠেন। রাস্তার মোড়ে মোড়ে মাঝে মাঝে এনওয়াইপিডির গাড়ি না দেখলে মনে হতে বাধ্য এটি নিশ্চয়ই চীনের কোনো শহর।

রাস্তার উল্টো দিকেই লিটল ইতালি।

ইতালীয় খাবার আমার সবচেয়ে প্রিয় খাবার। ইতালীয় পোশাক আমার সবচেয়ে প্রিয় পোশাক। কাজেই ওখানে গেলে আমার মাথা নষ্ট হয়ে যায়।

ফুটপাত দখল করে (একমাত্র নিউইয়র্কেই বোধ হয় ‘ফুটপাত দখল’ সম্ভব) অথেনটিক আর রেস্টুরেন্টের চেয়ার–টেবিল পাতা থাকে। সুন্দরী ইতালীয় মেয়েরা কাস্টমার ধরার চেষ্টায় থাকে। সুপুরুষ ওয়েটারদের গডফাদার ছাঁটের চুল, পরিপাটি–মার্জিত সাজ, মনে হবে মাইকেল কর্লিওনি নিজে এসেছেন আপনাকে ফুড সার্ভ করতে। আর খাবার? বলার অপেক্ষা রাখে না। ‘নিউইয়র্ক স্টাইল পিৎজা’, ‘নিউইয়র্ক স্ট্রিপ স্টেক’ এগুলো গোটা আমেরিকাতেই বিখ্যাত।

চায়না টাউনের চেয়ে এই এলাকার সুবিধা হচ্ছে এরা মোটামুটি হলেও ইংলিশে কথা চালিয়ে যেতে পারবে। যদিও এদের স্থূল রসিকতা না–ও বুঝতে পারেন। যেমন এক দোকানের সামনে লেখা ‘if you're not an italian and taking my parking place, I'll make sure to break your **ing face."

পড়েই আপনি মনে করবেন ‘শালা’ দোকানদার নিশ্চয়ই মহা রেসিস্ট!

অথবা আরেকটা দোকানের সামনে সাইনবোর্ডে ঝুলছে ‘শুধু ইতালিয়ানদের জন্য।’

যদিও লিটল ইতালি নাম, তবু প্রচুর বাঙালিকে কাজ করতে দেখলাম। আমাদের সার্ভ করা ওয়েটার ছেলেটাও ছিল একজন বাংলাদেশি। মাত্র দেড় বছর হয়েছে আমেরিকা এসেছে, অথচ এরই মধ্যে ভাব নিয়েছে যেন বাংলা ভুলে গেছে। শুরুর দিকে বাংলায় কথা বলতেই চাচ্ছিল না। জেদ হচ্ছে স্বজাতি কারও সঙ্গে বাংলা ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় কথা বলব না। অবশ্য অনেকেই আছেন, ইংলিশে কথা না বললে ছোট করে দেখেন। অনেকে মানুষকে ছোট করার চেষ্টা করেন আয়ের ভিত্তিতে। ‘ওয়েটারি করে? কতই বা কামায়?’—ব্যস, শুরু হয়ে যায় ওর প্রতি দুর্ব্যবহার, ছোটলোকি আচরণ। আমরা বাঙালিরাই–বা কি কম বিচিত্র? ছেলেটা প্রথম দেখাতেই বুঝবে কী করে আমি ওর ইংলিশ গ্রামারে ভুল খুঁজতে আসি নাই?

যদিও লিটল ইতালি, লিটল চায়নার মতো ‘লিটল বাংলাদেশও’ আছে, তবু আমার কাছে ‘মিনি বাংলাদেশ’ হচ্ছে জ্যাকসন হাইটসের ৭৩ ও ৩৭ নম্বর রোড ও জ্যামাইকার ১৬৯তম স্ট্রিটগুলো। বাংলাদেশি গ্রোসারি, রেস্টুরেন্ট ও পণ্যের দোকান, সেখানে বাংলায় সাইনবোর্ড টানানো, রাস্তাঘাটে সব বাঙালির হাঁটাচলা, রাস্তাঘাটে মাঝেমধ্যেই নোংরা আবর্জনা ফেলে রাখা, ফুটপাতে থুতু, চিপসের প্যাকেট, ব্যবহৃত স্টাইরো ফোমের চায়ের কাপ, সিগারেট টানতে টানতে আড্ডা—মনে হচ্ছিল সিলেটের জিন্দাবাজারে আছি। কারণ, অনেক সিলেটির দেখা পেলাম, যারা একদম খাস সিলেটি ভাষায় কথা বলেন। ‘হাটবাজারে’ মুরগির রোস্ট সিলেটি রোস্টের কথাই মনে করিয়ে দিল। সঙ্গে ইত্যাদিতে সকালের নাশতায় পরোটা দিয়ে হাঁসভুনা ছিল অসাধারণ! কমসে কম তিন–চারজন মানুষ খলিল বিরিয়ানির বিরিয়ানি ও তেহারি ট্রাই করতে বলেছিল, খাওয়া হয়নি। সময় করে উঠতে পারিনি। অথেনটিক ঢাকাই কাচ্চি খাওয়া হয় না বহু যুগ হয়ে গেছে।

জ্যাকসন হাইটসের দোকানগুলো দেখলে গাউছিয়া মার্কেট বলে ভ্রম হয়। টেক্সাস থেকে কেউ গেলে কল্পনাই করতে পারবে না এতটুকু জায়গায়ও দোকান হওয়া সম্ভব। অথচ লোকজন দিব্যি পান সিগারেট, মেয়েদের চুড়ি, টিকলি, গয়না, ফোন–ফ্যাক্স, কপি মেশিন, ইমিগ্রেশন সার্ভিস, শাড়ি–কাপড় ইত্যাদি ব্যবসা করে সংসার চালাচ্ছেন। ফুটপাতে বিক্রি হচ্ছে ধর্মীয় বই, নামাজের টুপি, জায়নামাজ, বাচ্চাদের জন্য প্লাস্টিকের সস্তা খেলনা ইত্যাদি। একটা কোণে পাওয়া গেল অনেকগুলো ফুচকার গাড়ির দোকান। বাংলাদেশি কায়দায় তৈরি ফুচকা! আহ! অমৃত!

‘লিটল বাংলাদেশের’ পাশের গলিতেই ‘লিটল ইন্ডিয়া’ পেয়ে গেলাম।

বিয়ের পাঞ্জাবি, শেরওয়ানি, গয়না, মিষ্টি ইত্যাদি দোকানে ঠাসা। পাশের গলিতেই যেখানে সবাই বাংলাদেশি, সেখানে সমানে লোকজন হিন্দিতে কথা বলছেন। কে বলবে এটা আমেরিকা?

নিউইয়র্কের পথে পথে হটডগ, শর্মা স্যান্ডউইচ, রাইস প্ল্যাটারের কার্ট (টং দোকানের মতন)। সবাই হালাল মাংসের স্যান্ডউইচ, হটডগ ইত্যাদি বিক্রি করছে। খ্রিষ্টানদের কিছু যায়–আসে না মাংসটা হালাল নাকি হারাম। ইহুদিরা এমনিতেও কোশার (ইহুদিধর্মের ‘হালাল’) ছাড়া খায় না। কাজেই মুসলিম ক্রেতা পেতে হালাল মাংস বিক্রি করাই লাভজনক। দোকানিরা বুদ্ধিমান এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই দোকানিরাও মুসলিম।

আমেরিকায় এত হালাল দোকান আমার মনে হয় না মিশিগান ছাড়া আর কোথাও পাওয়া যাবে।

‘দ্য হালাল গাইজ’ পৃথিবীখ্যাত একটি রেস্টুরেন্ট চেইন। ম্যানহাটানে গভীর রাতেও ওদের দোকানের সামনে আমাদের ঢাকার খলিলের মাংসের দোকানে যখন ৫৯৫ টাকা কেজি দরে মাংস দেয়, তখন যে ভিড় হয়, তেমন ভিড়। খাবার খেলে বুঝবেন কী এর রহস্য। ওদের দেখাদেখি আরও অনেকেই দোকান খুলে বসেছেন। সে রকম ভিড় না হলেও যার যার সংসার নিশ্চয়ই ঠিকঠাক চলছে।

ব্রুকলিনে চলে যান, মনে হবে ইসরায়েলে চলে এসেছেন। ইহুদি ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। যদিও ইসরায়েলের সঙ্গে আদর্শগতভাবে ওদের মতাদর্শ সাংঘর্ষিক। বাংলাদেশের অনেকেই শুনলে অবাক হবেন যে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা স্থানীয় ইহুদিরাও করে থাকেন। ওদের মতে, ইসরায়েল তাওরাতবিরোধী একটি রাষ্ট্র। তাওরাত অনুযায়ী মাসিহা আসার আগে ওদের কোনো রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার হুকুম নেই। কাজেই জায়ানিস্টরা (ইসরায়েলি) নাস্তিক/সেক্যুলার/কাফের ইহুদি। ওদের যে সমর্থন করবে, সেও ওদের দলভুক্ত হবে।

আমাদের বাংলাদেশিদের বোঝার সুবিধার্থে, কালকে যদি কোনো সন্ত্রাসী জঙ্গি সংগঠন একটি এলাকাকে স্বাধীন ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে দাবি করে, ওদের নেতাই খলিফা, ওর কাছে আনুগত্য করা পৃথিবীর সব মুসলিমের দায়িত্ব, তখন কি বিশ্বজুড়ে সাধারণ মুসলিমরা মেনে নেবে? ঘটনা এখানেও তা–ই।

ইহুদি মেয়েদের মাথায় স্কার্ফ দেখবেন, পুরুষদের মাথায় হ্যাট থাকবে, আর দেখবেন লম্বা দাড়ির পাশাপাশি ওদের মাথার দুই পাশের লম্বা জুলফি ঝুলছে। সাবেথের দিন (শনিবার) গেলে দেখবেন আস্ত এলাকা সুনসান নীরব। এদিনটা ওদের সাপ্তাহিক বন্ধের দিন। এদিন ওরা ঘরে বসে কেবল ইবাদত করে আর বিশ্রাম নেয়। এই দিন দুনিয়ার সঙ্গে ওদের কোনো যোগাযোগ থাকে না।

একটা সময়ে (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ–পরবর্তী সময়) এই এলাকার ইহুদিরাই ছিল অতিগরিব সম্প্রদায় এবং আজকে ওরাই অত্যন্ত ধনী। রহস্য হচ্ছে ওদের ‘একতা’। একজন ইহুদির যদি বাড়িতে চালের প্রয়োজন হয়, সে একটি ইহুদি দোকানেই যাবে। সেই চালের ব্যবসায়ীও ইহুদি পাইকারি বিক্রেতার কাছ থেকেই চাল কিনবে। ওর দোকানে ইলেকট্রিসিটির কাজ করাতে হলে ইহুদি মিস্ত্রির খোঁজ নেবে। এভাবেই ওরা একজন আরেকজনকে সাহায্য করে এগিয়ে নিয়ে যায়। এখানে ‘ইহুদি-নাসারা’ ষড়যন্ত্রের কিছু নেই। একতাই বল।

নিউইয়র্কের আরেকটি ব্যাপার যা চোখে পড়ে, এর জনসংখ্যাকে এরা সহজেই জনশক্তিতে রূপান্তর করে ফেলে। যেমন আগেই বলেছি, বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে নানা ভাষার লোক এখানে এসে নতুন জীবন শুরু করেন। এদের অনেকেরই যাত্রা একদম তলানি থেকে শুরু হয়। ফুটপাতে খাবার বিক্রি, চকলেট, লজেন্স, ক্যান্ডি, চিপস ইত্যাদি ফেরি করা দিয়ে তাঁদের আয়রোজগার হয়। কিন্তু নিউইয়র্ক বলেই ওরা সার্ভাইভ করে ফেলেন। প্রতি ১০০ জনের মধ্যে একজনও যদি কাস্টমার পাওয়া যায়, তাতেই তাঁদের খরচ উঠে কিছুটা লাভ উঠে আসে। অন্য শহরে এমন স্বল্প আয়ের মানুষদের এভাবে টিকে থাকা কঠিন হতো। এর অন্যতম প্রধান কারণ ওদের সাবওয়ে সিস্টেম। দুনিয়ায় এত নিখুঁত, এত গোছানো সাবওয়ে খুব সম্ভব লন্ডন ছাড়া আর কোথাও নেই। শুনেছি মস্কোর সার্ভিসও নাকি দারুণ। যাওয়া হয়নি, তাই নিশ্চিত নই। টেক্সাসে প্রাইভেট গাড়ি ছাড়া আপনাকে পঙ্গু বিবেচনা করা যেতেই পারে। গাড়ি কিনলে ইনস্যুরেন্স কিনতে হয়, মেইনটেনেন্স থাকে, থাকে অন্যান্য খরচ। সাবওয়ে সেদিক দিয়ে সবার জন্যই সাশ্রয়ী। কেবল যে গরিব মানুষ সাবওয়ে চড়েন এমনও না, অনেক মধ্যবিত্ত ও ধনী ব্যক্তিও চড়েন। কারণ, ট্র্যাফিক জ্যামে ঠাসা ও পার্কিং স্পেস না পাওয়া নিউইয়র্ক মহানগরীতে সময় বাঁচাতে সাবওয়ের আসলেই কোনো বিকল্প নেই।

অনেক প্রশংসা করে ফেললাম। এখন বলি এর কোন কোন দিকগুলো আমার অপছন্দের।

প্রথমত এর শীত। বরফ আমি দুচোখে দেখতে পারি না, নিউইয়র্কে এমন কোনো শীত পড়ে কি না জানি না যে সময়ে বরফ পড়ে না। ১–২ ফুট উঁচু বরফ জমে থাকে, কাজে যাওয়ার আগে শাবল দিয়ে নিজের বাড়ির সামনের ফুটপাত পরিষ্কার না করে গেলে সিটি থেকে জরিমানা চলে আসে। আর বরফ ছাড়াও ওদের যে শীত পড়ে, হাডসন নদী থেকে ভেসে আসে যে বাতাস, সেটা চামড়ার জ্যাকেট, উলের সোয়েটার ইত্যাদি ভেদ করে একদম শরীরের হাড্ডিতে গিয়ে বেঁধে। শীত সহ্য না হলে নিউইয়র্কে হেমন্ত-শীত-বসন্ত—এই তিন ঋতুতে যাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ না।

দ্বিতীয়ত, ওদের কস্ট অব লিভিং অনেক হাই। মোটামুটি মধ্যবিত্তের জীবনযাপনেও প্রচুর খাটুনি খাটতে হয়, প্রচুর টাকা কামাতে হয়, বাড়িভাড়া বা মর্টগেজ পেমেন্টে প্রচুর টাকা চলে যায়। ভালো এলাকায় মিলিয়ন ডলারেও যে বাড়ি পাওয়া যাবে, সেটাও মনঃপূত হবে না। প্রচুর টাকা খরচ করে বহু পুরোনো বাড়ি কিনতে হয়, যার বেজমেন্টে হয়তো ইঁদুরের ঘরবসতি। মিলিয়ন ডলার খরচ করে যে বাড়ি কিনব, হয়তো এলাকা পছন্দ হবে না, নয়তো মনমতো বাগান করার একচিলতে উঠোন থাকবে না। অন্যান্য স্টেটে ওই একই টাকায় এক একর জমি কিনে নিজের ইচ্ছেমতো ডিজাইনে বাড়ি বানানো যাবে।

ওপরে যে সাবওয়ের প্রশংসা করলাম, সেই সাবওয়েরই অনেক স্টেশনে, এলিভেটরে আপনি মানুষের মূত্রবিসর্জনের গন্ধে বমি করে দেবেন। আপনার বমিও তখন মেঝেতে পড়ে থাকবে, সেই দুর্গন্ধ যুক্ত হবে আগের দুর্গন্ধের সঙ্গে। কেবল এই গন্ধ থেকে বাঁচতেই আমি নিউইয়র্ক গেলে গাড়ি ভাড়া করি। এতে প্রচুর টাকা অতিরিক্ত খরচ হয় বটে, কিন্তু শরীর ও মন—দুইটাই সুস্থ থাকে।

সাবওয়ের আরেকটা সমস্যা হচ্ছে, প্ল্যাটফর্মে কোনো রেলিং নেই। যখন-তখন দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। ঘটেও। লোক নিয়মিতই আত্মহত্যা করে সাবওয়ের নিচে ঝাঁপ দিয়ে। শুনেছি খুনও হয়। প্রচণ্ড গতিতে এগিয়ে আসা ট্রেনের সামনে কেউ হঠাৎ পড়ে গেলে থামার কোনোই উপায় নেই। কিছুক্ষণ দাঁড়ালেই লোকে শুনতে পারবে যন্ত্র থেকে ভেসে আসা কণ্ঠস্বর, অনুগ্রহ করে কেউ সাবওয়ে সার্ফিং (ট্র্যাকের ওপর হাঁটা) করবেন না। অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার আশায় ঝুঁকিপূর্ণ ভিডিও করে থাকেন। তাই ঘোষণা করা হয়, জীবনের চেয়ে মূল্যবান কিছু হতে পারে না। তারপরও কয়জন শোনে? এ কারণেই হয়তো পুলিশ সর্বদা বিরাজমান। ওদের ইউনিফর্মে এনওয়াইপিডির ব্যাচ দেখলে কেন যেন একটা স্বস্তি আপনাতেই চলে আসে।

নিউইয়র্ক শহরে টাকাপয়সা যেমন বেশি, তেমনই অপরাধপ্রবণতাও বেশি। প্রচুর ছোট–বড় গ্যাং আছে, আছে ছিঁচকে সন্ত্রাসী থেকে শুরু করে বড় গডফাদাররা। শহর নিরাপদ রাখতে এনওয়াইপিডির নাভিশ্বাস উঠে যায়, তবু প্রতিদিনই এখানে প্রচুর ক্রাইম ঘটে থাকে।

ভালো–মন্দ মিশিয়ে নিউইয়র্ক একটি ইউনিক শহর। আমেরিকা ভ্রমণ করে কেউ যদি নিউইয়র্ক ভ্রমণ না করেন, তাহলে সেই ভ্রমণ অসম্পূর্ণ থেকে যায়। আমেরিকার প্রতিটা অঙ্গরাজ্য, প্রতিটা শহরের আলাদা বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ে, আমার কাছে ‘বিগ অ্যাপলের’ সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর জনগণের বৈচিত্র্য। এর বিমানবন্দরে দেখলাম একদল মুসলিম জামাতে নামাজ পড়ছেন তো পাশেই কিছু অর্থোডক্স ইহুদি বসে মোবাইলে কি কাজ করছিলেন, তো এর পাশেই কিছু আফ্রিকান আমেরিকান নারী উঁচু স্বরে নিজেদের মধ্যে রসিকতা করছিলেন, আর একটি শ্বেতাঙ্গ পরিবার নিজের বাচ্চা সামলাতে ব্যস্ত....। এই বৈচিত্র্যই আমেরিকাকে আজকের আমেরিকা বানিয়েছে। সাবেক প্রেসিডেন্ট রিগ্যানের একটি বক্তব্য থেকে বলতেই পারি, ‘আপনি ফ্রান্সে বাস করতে পারেন, কিন্তু আপনি ফ্রেঞ্চ হবেন না। আপনি জার্মানি, টার্কি বা জাপানে থাকতে পারেন, কিন্তু আপনাকে কেউ জার্মান, তুর্কি বা জাপানি ডাকবে না। কিন্তু যে কেউ, দুনিয়ার যেকোনো কোণ থেকে আমেরিকায় এসে বাস করতে পারে এবং “আমেরিকান” হতে পারে।’ নিউইয়র্ক এর আদর্শতম উদাহরণ।

* দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]