সৌদি আরব ভ্রমণের গল্প-৩

হজপ্রতীকী ছবি

জেদ্দা পৌঁছে শুনি আমাদের লন্ডনের ফ্লাইট চলে গেছে। হায় আল্লায়! এখন! বিমানবন্দরে হইচই শুরু হলো। যাত্রীরা খ্যাপা। কারও পরদিন অফিস আছে। কারও সঙ্গে বাচ্চা আছে, বাচ্চার দুধ নেই। সবাই যে করেই হোক যথাসময়ে লন্ডন পৌঁছাতে চায়। কিন্তু লন্ডনের গেটউইক বিমানবন্দরে ফ্লাইটে সিট আছে দুই দিন পর। একটা ফ্লাইট আছে কয়েক ঘণ্টা পর, সেটা যাবে ম্যানচেস্টার। সেটায় সিট পাওয়ার জন্য হুড়োহুড়ি শুরু হয়ে গেল। অনেকের জরুরি কাজ আছে। আমরা ভাবলাম, ম্যানচেস্টার আমাদের বাড়ি থেকে অনেক দূরে। সেখানে গিয়ে লাভ নেই। আমরা আর লাইনে দাঁড়ালাম না। চেয়ারে বসে ঝিমোতে লাগলাম। ওই দিকে কাস্টমারের সঙ্গে সৌদি বিমানবন্দরে কর্মকর্তাদের ঝগড়া চলছে। আমরা কোনো কিছুতেই নেই। আমাদের সিদ্ধান্ত—সবার উপায় হয়ে গেলে আমরা গিয়ে লাইনে দাঁড়াব, দেখি আমাদের কী করে। লাইন ফাঁকা হয়ে গেলে আমরা গিয়ে লাইনে দাঁড়ালাম। সর্বশেষ যাত্রী আমরা। আমাদের টিকিট নিয়ে বাধল নতুন সমস্যা। তাদের ওয়েবসাইটে আমাদের টিকিট খুঁজে পাচ্ছে না। আধা ঘণ্টা চেষ্টার পর টিকিট পাওয়া গেল। তারা বলল, তোমাদের দুই দিন পর ফ্লাই করতে হবে। আমরা ফ্রি থাকা–খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।

আমাদের ব্যাগ টেনে বিমানবন্দরের বাইরে বের করল। কে জানে আর কয় ঘণ্টা বাসে চড়তে হয়। ঘুমে শরীর পড়ে যাচ্ছে। কিন্তু বাইরে বেরিয়ে দেখি কোনো বাস নেই।

বাস কখন আসবে?

বাস লাগবে না, এই তো আপনাদের হোটেল। মন খুশি হয়ে গেল। বিমানবন্দরের আঙিনাতেই হোটেল। হোটেলে ঢুকলাম, বেশ পরিপাটি, তখন মুয়াজ্জিন সরব হয়েছেন—আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম।

রুমে ঢুকে শরীর এলিয়ে দিলাম। রুমবয় বললেন, সকাল ১০টার মধ্যে না জাগলে নাশতা মিস করবেন। নয়টায় উঠলাম। রেস্তোরাঁয় যাব, অমনি হোটেলের এক তরুণ কর্মকর্তা বললেন, খাবার ফ্রি না, কেবল থাকা।

মাথা চক্কর দিয়ে উঠল, বলে কী! এখানেও গাদ্দারি!

যাক, খেতে তো হবেই। পয়সার ব্যাপার পরে দেখব। খুব খিদে পেয়েছে। রেস্তোরাঁয় ঢুকলাম। হরেক রকম পদে সাজানো রেস্তোরাঁ। নাশতা খেতে খেতে দেখি, রেস্তোরাঁ ম্যানেজার ফোনে কথা বলছে, বাংলায়। আরে, এটা তো দেখি দেশি ভাই। নাশতা খেয়ে দেশি ভাইকে বললাম, আমরা সৌদি এয়ারলাইনসের যাত্রী। হোটেলের এক কর্মকর্তা বলেছেন, আমাদের থাকা ফ্রি, খাওয়া নয়।

আরও পড়ুন

ভুল বলেছে। দুটোই ফ্রি।

খুশি হয়ে গেলাম। মনে মনে ভাবলাম, ফ্লাইট মিস করে ভালোই হলো। বিনা খরচে দুই দিন জেদ্দা ঘুরলাম। ফোন দিলাম জেদ্দায় থাকা আমার এক মামাকে। মামা বললেন, সমস্যা নেই, আমার নিজের গাড়ি আছে, আপনাদের নিয়ে ঘুরব। বিকেলে মামা তার বউ–বাচ্চা নিয়ে হাজির। মামা নিজেই ড্রাইভ করেন। আমরা কেএফসির খাবার কিনে সাগরপাড়ে রওনা দিলাম। পথে মামা এটা-সেটা দেখালেন। সাগরপাড়ে নেমে দেখি বেশ গরম, আমাদের দেশের মতো মনোরম বাতাস নয়। সৌদি শেখরা সমুদ্রতীরে কাপড় বিছিয়ে হুঁকো টানছে আর তাদের খেদমত করছে আমাদের গরিব বাঙালিরা। দৃশ্যটা আমাকে খুব পোড়াল। মনে মনে ভাবলাম, আমাদের আসবে কখন সেই সুদিন, যেদিন আমরা পা তুলে হুক্কা খাব, খেদমত করবে ভিনদেশি মানুষ।

দুই দিন পর আমরা ফ্লাই করলাম লন্ডনের উদ্দেশে। ছেলে বলল, বাবা, আমরা আবার কখন সৌদি আসব?

আল্লাহ যেদিন আনে।

আরও পড়ুন

বুঝলাম তার মায়া পড়ে গেছে এই দেশের জন্য। আমাদেরও। জীবন আসলে মায়ায় ভরা। আর এই মায়ার ভুবন ছেড়ে একদিন আমাদের পাড়ি দিতে হয় অন্য ভুবনে। একদিন তার কাছেই ফিরে যেতে হবে। তার কাছেই।

দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]