সৌদি আরব ভ্রমণের গল্প-২
এজেন্ট ফোন করল। বলল, তাড়াতাড়ি রুম ছাড়েন, আপনাদের প্রাইভেট কার নিচে দাঁড়ানো। আপনাদের মক্কা থেকে মদিনায় নিয়ে যাবে। হোটেলের নিচে নামলাম। নেমে দেখি সত্যি প্রাইভেট কার দাঁড়ানো। রুম ছেড়ে দিলাম। পাকিস্তানি চালক আমাদের নিয়ে চলল মদিনার পথে। দীর্ঘ পথ। চালককে পথে কোথাও থামতে বললাম, আমরা লাঞ্চ করব। সে বলল, পথে সৌদির বড় একটা ফ্রাই চিকেনের দোকান আছে, খুব বিখ্যাত। সেখানে তোমাদের নিয়ে যাব।
আমরা মরুভূমি পেরোচ্ছি। বিস্তৃত ধু ধু প্রান্তর। কোথাও গাছপালা নেই। পাঁচ থেকে দশ মাইল পরপর দু–একটা বাড়ি। কোথাও মেষ ও উটের পাল দেখা যায়। এই তপ্ত মরুভূমিতে, যেখানে গাছপালা নেই, শস্য নেই, সবুজ নেই, অথচ কত বিত্তের মালিক তারা। সৃষ্টিকর্তা সদয় বলেই মাটির নিচ থেকে টাকা ওঠে। পথে গ্রামের একটা মসজিদে নামাজ পড়লাম আমরা। তারপর গেলাম সেই ফ্রাই চিকেনে। মানুষের ভিড়। প্রচণ্ড গরমে ঘামতে ঘামতে রুটি বানাচ্ছেন শ্রমিক। কাউন্টার থেকে দেখা যায়। হঠাৎ লেগে গেল ঝগড়া। ম্যানেজার আর এক কাস্টমারে। আরবি ঝগড়া। পাশে থাকা ক্লিনারকে বললাম, ভাই, আপনি কি ভারতীয়?
না, বাংলাদেশি।
ক্লিনার বলল, এখানে যারা কাজ করে, সবাই বাঙালি। বাঙালি ম্যানেজারের আরবি বলার দক্ষতায় অবাক হলাম। যাক, কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর আমাদের খাবার এল। আমরা খাবার খেয়ে পরিতৃপ্ত। আসলেই খুব ভালো, সুস্বাদু খাবার ছিল সেটি। খাবার খেয়ে আবার আমরা যাত্রা শুরু করলাম। চালক বলল, মদিনা পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত হয়ে যাবে। এখন আরেক টেনশন। হোটেল কেমন হয়, মাছিওয়ালা যদি হয়! ছেলে মাছি ভয় পায়। থ্রি স্টার তো দেওয়ার কথা ছিল। ফোন করব লন্ডনের ট্রাভেলওয়ালাদের! যারা প্যাকেজ বিক্রি করেছিল আমাদের কাছে! না থাক। আল্লাহর ঘরে এসেছি, ইবাদতই মুখ্য। ঝগড়া–বিবাদ করে লাভ নেই।
রাতে মদিনা পৌঁছালাম। হোটেল দেখে আমার বউ-ছেলে খুব খুশি হয়ে গেল। ঝকঝকে আধুনিক হোটেলে। মসজিদে নববির একদম কাছে। আহা। মদিনায় গিয়েও বাঙালি রেস্তোরাঁর সন্ধান পেয়ে গেলাম। আসলে ভাত ছাড়া তো চলেই না। তবে সৌদির খেজুর খুব সুস্বাদু। মসজিদে নববি খুব সুন্দর এক পবিত্র স্থান। বাইরে থাকা ছাতাগুলো খুবই দর্শনীয়। মসজিদে ঢুকেই আমার ছেলে দৌড়াতে থাকে। কী ব্যাপার! দৌড়াচ্ছ কেন!
তুমিই তো বললা আগের কাতারে নামাজ পড়লে সওয়াব বেশি।
একদিন দেখি বিভিন্ন দিকে ইফতার সাজান হচ্ছে। সবাই টানছে তাদের লাইনে যাওয়ার জন্য। হঠাৎ ছেলে একটা রাজকীয় স্টাইলের কেটলি দেখিয়ে বলল, বাবা, ওই কেটলির চা খাব। ওই লাইনেই গিয়ে বসলাম আমরা। বিভিন্ন ধরনের রুটি ও ফলমূল দিয়ে সাজান প্লেট। আমরা খাবার খুব একটা খেলাম না। খুব আগ্রহ নিয়ে চা নিলাম, কিন্তু চুমুক দেওয়ার পর আমাদের মুখ বাঁকা হয়ে গেল। কেমন টেস্ট রে বাবা! অ্যারাবিয়ান চা। হয়তো এতে আমরা অভ্যস্ত নই বলেই ভালো লাগছে না। মসজিদে নববিতে ঢুকেই সবার যে আগ্রহটা প্রবল থাকে, তা হলো হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর রওজা মোবারক দেখা, জিয়ারত করা। বিশাল এক আবেগের ব্যাপার। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মহামানব এখানে শায়িত। ১ হাজার ৪০০ বছর আগের ঘটনা। গেলাম সেখানে, আমি আর আমার ছেলে, স্ত্রী গেলেন অন্যদিকে, মেয়েদের জন্য অন্য পথ। রওজা মোবারকের পাশে মানুষ পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত করছেন। কর্তব্যরত পুলিশ সেখানে মানুষকে বেশিক্ষণ দাঁড়তে দেয় না, যাতে মানুষের ভিড় জমে সমস্যা না হয়। রওজা মোবারকের কাছে গিয়ে মন অন্য রকম হয়ে যায়, আবেগঘন। আমাদের প্রিয় নবী যেখানে শায়িত, পাশেই আমরা দাঁড়িয়ে। হে মহামানব, লও সালাম।
একদিন মসজিদে নববিতে রাখা পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত করতে চাইল আমার ছেলে, কিন্তু পারল না। ওখানে ‘জের-জবর’ নেই বলে পড়তে অসুবিধা হলো। মদিনা খুব সুন্দর নগরী, পরিপাটি। এখানে তিন দিন থাকার পর আমরা অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটে যাব জেদ্দা, সেখান থেকে লন্ডন। দুপুরে মক্কা থেকে আমার বাঙালি এজেন্ট ফোন করে বলল রুম ছেড়ে দিতে। আমি তো অবাক। আমার ফ্লাইট রাত ১০টায়, দুপুরে রুম ছেড়ে দিলে এতক্ষণ বউ-ছেলে নিয়ে থাকব কোথায়! এজেন্টকে বললাম, এ রকম তো কথা ছিল না।
এজেন্ট বলল, লবিতে গিয়ে বসে থাকেন। সিদ্ধান্ত নিলাম, আমি রুমেই থাকব। দরকার হলে এক্সট্রা পে করব। কিন্তু হোটেল ম্যানেজার বলল, রুমটা বুক হয়ে গেছে, সমস্যা নেই, বিকেলে ছাড়লেই হবে। আমরা বিকেলে রুম ছেড়ে লকারে জিনিসপত্র রাখলাম। তারপর মসজিদে নববিতে গিয়ে কিছুক্ষণ ইবাদত করলাম, সন্ধ্যায় রওনা হয়ে গেলাম বিমানবন্দরে দিকে। বিমানবন্দরে নেমে ট্যাক্সিচালকের ভাড়া দাবি করল। আমি বললাম, আমার প্যাকেজে তো বিমানবন্দরে ট্রান্সফার ছিল।
চালক মানে না। ফোন করলাম মদিনার সাব–এজেন্টের কাছে। সে পাকিস্তানি। সব শুনে সে বলল, ঠিক আছে, ভাড়া দিতে হবে না, আমি চালককে বলে দিচ্ছি। সাব–এজেন্টের সঙ্গে কথা বলার পর চালক নরম হলো। আমাকে আর ভাড়া দিতে হলো না।
বিমানবন্দরে ঢুকলাম। লাগেজ চেকিং সব সারলাম, কিন্তু প্লেন কখন ছাড়বে, সে বিষয়ে কোনো ঘোষণা নেই। যাকেই জিজ্ঞেস করি, সে-ই বলে জানি না। পেলাম কয়েকজন পাইলটকে। তারাও যত্রতত্র হাঁটছে। তাদের জিজ্ঞাসা করলাম, তারাও বলে জানি না। এদিকে ফ্লাইটের নির্ধারিত সময় পেরিয়ে যাচ্ছে, ফ্লাইট ছাড়ার কোনো আয়োজন নেই। সৌদি এয়ারলাইনের লোকেরা কিছুক্ষণ পরপর খাবার-ড্রিংকস রেখে যায়। যার যত ইচ্ছা খাও, কিন্তু প্লেন কখন ছাড়বে, তার খবর কেউ জানে না। ভাবলাম, আমার দেশ হলে অন্তত বলত, এ কারণে দেরি হচ্ছে, এই টাইমের বদলে ওই টাইমে ছাড়বে।
রাত গভীর হচ্ছে। আমাদের টেনশন—কানেকটিং ফ্লাইট ধরতে পারব তো? লন্ডনের বিমান! যদি মিস করি! তাহলে!
রাত ১১টা। ফ্লাইট ছাড়ার কোনো আলামত নেই। ছেলে বলল, বাবা, চলো আমরা মসজিদে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। আমাদের কাউন্টারের পাশেই ছোট একটা মসজিদ। আমি আর আমার ছেলে মসজিদে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। স্ত্রীকে বললাম, কাউন্টার ওপেন হলে আমাদের ডাক দিয়ো। চোখটা লাগতে যাবে, অমনি স্ত্রী ডাকল। বলল, কাউন্টার ওপেন হয়েছে, তাড়াতাড়ি আসো। দৌড় দিলাম। প্লেন ছাড়ল। কিছুক্ষণ পরপর ঘড়ি দেখি। জেদ্দা পৌঁছে ফ্লাইট পাব তো! লন্ডনের ফ্লাইট! মিস করলে! চলবে...
দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]