সৌদি আরব ভ্রমণের গল্প-১

পবিত্র ওমরাহ করতে যাব লন্ডন থেকে। একজন বললেন, সৌদি এয়ারলাইনসে যান। ভালো হবে। যদিও টিকিটের দাম একটু বেশি। একটা নামী ট্রাভেল এজেন্টে গিয়ে একটা প্যাকেজ নিলাম। ওরা বলল, জেদ্দা বিমানবন্দরে আপনাদের জন্য প্রাইভেট কার অপেক্ষা করবে। প্রাইভেট কারে জেদ্দা থেকে নিয়ে যাবে মক্কা। একজন বললেন, লন্ডন থেকে সৌদির একটা সিম (মুঠোফোনের) কিনে নিয়ে যান। বিমানবন্দরে নেমে সবার সঙ্গেই যোগাযোগ করতে পারবেন। লন্ডন থেকে ১০ পাউন্ড দিয়ে সিম কিনলাম। জেদ্দায় নেমে দেখি, সিম কাজ করে না। বিমানবন্দরে বাইরে বেরিয়ে দেখি, আমাদের জন্য প্রাইভেট কারও নেই। বউ–ছেলে নিয়ে পড়লাম বিপাকে।

বিমানবন্দরের বাইরে প্রচণ্ড গরম। এই সকালেই। একজন সৌদি এজেন্টকে আমাদের কাগজপত্র দেখালাম। তিনি আমাদের এজেন্ট ও হোটেল চিনতে পারলেন। বললেন, তাঁর মাইক্রোতে আমরা যেতে পারব কিন্তু মাইক্রো ফুল না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। আমরা প্রচণ্ড গরমে, টার্মিনালে অপেক্ষা করতে লাগলাম। মাইক্রো ছাড়ার কোনো লক্ষণই নেই। ঘণ্টাখানেক পর মাইক্রো ছাড়ল। মাইক্রোতে ঢুকে কিছুটা স্বস্তি। শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্রটা কাজ করছে। জেদ্দা পৌঁছে হোটেলে হোটেলে লোক নামাতে লাগলেন মাইক্রোবাসওয়ালা। সবাইকে নামিয়ে দেওয়ার পর চালক জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা কোন হোটেলে যাবেন। কাগজ দেখালাম। চালক আমাদের হোটেলের সামনে নামালেন। সবার পরে। হোটেলে ঢুকেই থ হয়ে গেলাম। এসব কী দেখছি! লবিজুড়ে মাছি আর মাছি। বালক ছেলে ভয়ে দৌড়াতে লাগল। এসব কী হচ্ছে। ট্রাভেল এজেন্ট বলেছিলেন থ্রি স্টার হোটেল দেবেন। এটা তো কোনো স্টারেই পড়ে না। হোটেল ম্যানেজার আমাদের কাগজপত্র দেখে বললেন, এখানে আপনাদের বুকিং ছিল কিন্তু আপনার এজেন্ট তো বুকিং বাতিল করে দিয়েছেন।
এখন!

বাঙালি ম্যানেজার বললেন, সমস্যা নেই, আপনাদের এজেন্টকে ফোন দিচ্ছি। ফোন দিলেন। এজেন্ট বললেন আধা ঘণ্টার মধ্যে তিনি আসছেন। আমরা আধা ঘণ্টা মাছির মধ্যেই বসে থাকলাম। আধা ঘণ্টার মধ্যেই এক তরুণ এলেন, বাঙালি, তিনি আমাদের নিয়ে গেলেন অন্য একটা হোটেলে। এই হোটেল মাছির হোটেল থেকে ভালো কিন্তু থ্রি স্টার মানের নয়। বড় একটা রুম দিলেন, পাঁচ বেডের, তিনজনের জন্য। বিশাল তার বাথরুম। পুরোনো মডেলের হোটেল সেটা। কাবাঘরে যেতে কিছুটা হাঁটতে হয়। বাঙালি এজেন্টকে বললাম, এখনই ওমরাহ পালন করব, পারলে আপনি আমাদের সঙ্গে চলেন, পথ চিনিয়ে নিলেন, নিয়মকানুন বলে দিলেন। এর জন্য আমরা পে করব। তিনি তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে গেলেন। আমরা ভালোভাবে ওমরাহ করলাম। আমার আট বছর বয়সী ছেলে খুশিতে লাফাতে লাফাতে ওমরাহ পালন করল কিন্তু বিপত্তি দেখা গেল মাথার চুল কামানোর সময়, সে কিছুতেই ন্যাড়া করবে না। ন্যাড়া মাথা হয়ে গেলে তার স্টাইল নষ্ট হয়ে যাবে। কী আর করা। এজেন্ট বললেন, ছোট মানুষ, না করলেও সমস্যা নেই। ওমরাহ করে, গোসল করে, ম্যাকডোনাল্ড খেলাম। এজেন্ট কয়েকটা টাকা পেয়ে বিদায় হয়ে গেলেন। অতঃপর রোজ হারাম শরিফে যাই। প্রায় ৫০ ডিগ্রি উষ্ণতায় হেঁটে হেঁটে। পথে ঝাঁকে ঝাঁকে কবুতর পাওয়া যায়, ছেলে এসবের সঙ্গে খেলে খেলে যায়, ভালোই লাগে, গরমকে অসহ্য মনে হয় না। হারাম শরিফে ঢুকে গেলেই শান্তি।

শীতাতপনিয়ন্ত্রিত। ফ্রি জমজমের পানি। কত দেশের, কত বর্ণের লোক, এক কাতারে, এক ভালোবাসায়। কোনো ঠেলাঠেলি নেই, চুরিচামারি নেই। পুরুষের পাশে নারীরাও হাঁটছেন, খারাপ কিছু চোখে পড়ে না কোথাও। মনোবাসনা যেখানে পবিত্রতা, আত্মসমর্পণ, সেখানে অন্ধকার উঠে আসে কী করে! সব দিকেই মমতা ছড়ানো। মসজিদে বসেছি, পাশেই হয়তো কোনো আফ্রিকান ভাই, নাম জানি না, ভাষা জানি না, দেশ জানি না, পাশে বসে আছেন। আমার ছোট ছেলেটাকে ধরে আদর দিচ্ছেন, ছবি তুলছেন, ই–মেইল আইডি দিয়ে ইশারায় বলছেন, ছবিগুলো ওখানে পাঠিয়ো। আহারে মমতা, মানুষে মানুষে।

আমাদের অসংখ্য লোক সৌদিতে কাজ করেন, বাঙালি। তাঁদের প্রখর রোদে, খোলা আকাশের নিচে কাজ করতে দেখে খারাপ লেগেছে। আবার যখনই যে শপিং মলে গেছি, বাঙালির আধিপত্য দেখে মনটা ভরে গেছে। প্রায় দোকানের মালিক বাঙালি, কর্মচারী বাঙালি, যেন মরুর পথে বাঙালির জয়। এক ছেলেকে পেলাম, টুপি বিক্রি করছে, কথা বলছে চিটাগাংয়ের ভাষায়। খবর নিয়ে জানলাম, তার দাদার বাড়ি বার্মায়। তার বাবার জন্ম সৌদি আরবে, তারও, তার স্ত্রীও সৌদি কিন্তু সে কথা বলছে আমাদের ভাষায়। শুধু কি তা–ই! বাংলাদেশের সব খবর সে জানে, হাসিনা, খালেদা—সব। এক দোকানে আতর কিনতে গেলাম, দোকানি দাম নিয়ে তর্ক শুরু করে দিলেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনার বাড়ি কোথায়?
নোয়াখালী।

কথা বলতে বলতে পরিচয় বেরিয়ে গেল। তিনি আমার এক বন্ধুর ফুফাতো ভাই। এখন তর্কের জন্য লজ্জা বোধ করছেন, কিছুতেই আতরের টাকা রাখতে চান না। আহারে বাঙালি!

সবচেয়ে ভালো লেগেছে কড়া এক নিয়মে। আজান পড়ার সঙ্গে সঙ্গে দোকানিরা দোকানের শাটার টানতে শুরু করেন। তখন যদি আপনি বলেন, দাঁড়ান, আমি লাখ টাকার বাজার করব, দোকানটা দুই মিনিট খোলা রাখেন, তিনি রাখবেন না। আজানের সঙ্গে সঙ্গেই সবাই দরজা বন্ধ করে মসজিদের দিকে ছোটেন। আহা নিয়ম!
মক্কায় চার দিন থাকলাম। এক বাঙালি ট্যাক্সিচালক ভাই আমাদের ঘুরে ঘুরে সব দর্শনীয় স্থান দেখালেন। সেই সঙ্গে ইতিহাসও বললেন। তাঁর জ্ঞান দেখে আমি অভিভূত হলাম। শ্বশুরবাড়ি সুনামগঞ্জে। আমাদের পাড়া থেকে অল্প একটু দূরে। বেশ খাতির–যত্ন করলেন, শ্বশুরের দেশের মানুষ।

মক্কায় খাবারের কোনো সমস্যা নেই। সম্ভবত কল্ক টাওয়ারে একটি বাঙালি রেস্তোরাঁ আছে, আমরা ওখানে গিয়ে ভাত খেতাম। ভাত খেতে খেতে মনে হতো, বাংলাদেশেই আছি। চারদিকে বাঙালি। বাংলা ভাষার মধুর উচ্চারণ।

মক্কায় চার দিন থাকার পর আমরা মদিনায় যাব। মনের মধ্যে ভয় শুরু হলো; কারণ, থ্রি স্টার হোটেল দেওয়ার কথা ছিল, দেয়নি; বিমানবন্দরে গাড়ি থাকার কথা ছিল, গাড়ি থাকেনি। এখন প্রাইভেট গাড়িতে মদিনায় নিয়ে যাওয়ার কথা, প্রাইভেট কার আসলেই দেবে কি না, নাকি বাসে চড়াবে, বাসে চড়লে শরীর খারাপ হয়, বমি হয়। এটা নিয়ে চিন্তা। রাতে বাঙালি এজেন্ট বললেন, সকালে প্রাইভেট কার আসবে, হোটেল ছেড়ে দিতে হবে। কিন্তু কথায় বিশ্বাস করতে পারছি না। রুম ছেড়ে দেওয়ার পর যদি দেখি বাইরে বাস দাঁড়ানো, তখন?

সকালে হোটেল ম্যানেজার ফোন দিলেন রুম ছেড়ে দেওয়ার জন্য। আমি ছাড়ি না, যতক্ষণ পর্যন্ত প্রাইভেট কার দেখতে না পাব, ততক্ষণ রুমেই থাকব।