কবির সিং, অ্যানিমেলের মতো সাইকো পরিচালকের সিনেমা ব্লকবাস্টার ব্যবসা করে কেন

‘অ্যানিমেল’ ছবির পোস্টারে রণবীর কাপুর ও তৃপ্তি। ইনস্টাগ্রাম থেকে

ঘটনাটা সেদিন ঘটল, আমারই চোখের সামনে।

এক গ্রোসারি দোকানে বাজার করতে গেছি। মাংস, সবজি, ফল, মসলা ইত্যাদি টুকটাক কিনে কার্ট ঠেলে পার্ক করা গাড়ির দিকে এগোচ্ছি। এই সময়ে এক লোক নিজের গাড়ি বের করছিলেন।

ওনার গাড়ি বের করার ভঙ্গিতেই বুঝে গেলাম তিনি খুব একটা ভালো ড্রাইভার না। আমি আমার ছেলের হাত ধরে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলাম।

আমার ধারণা সঠিক প্রমাণ করতেই যেন তিনি গাড়ি পেছানোর সময় উল্টো দিকে পার্ক করা একটা এসইউভিকে ঠুকে দিলেন। ড্রাইভার হিসেবে টের না পাওয়ার কোনো কারণ নেই।

কিন্তু তিনি ‘যেন কিছুই হয়নি’ ভাব নিয়ে সুন্দরমতো গাড়ি ঘুরিয়ে বেরিয়ে গেলেন।

পাশে বসা ওনার স্ত্রীর চেহারায়ও কোনো বিকার দেখলাম না।

তাঁরা জাতিতে বাংলাদেশি, পাকিস্তানি অথবা ইন্ডিয়ান হবেন হয়তো, ত্বকের রং, পোশাক ইত্যাদি সেটাই বলছে। আমাদের ওসব দেশে এসব ঠোকাঠুকি কোনো বিষয়ই না। বেশির ভাগ সময়েই পালিয়ে যাওয়া যায়। ধরা খেলে পাবলিকের চড়থাপ্পড়, গালাগাল, টাকাপয়সার লেনদেনের মাধ্যমে সমাধান হয়ে থাকে।

বিদেশে সাধারণ নিয়ম হচ্ছে, নেমে দেখা যে ক্ষতি কেমন হয়েছে। তারপরে ভিকটিমকে ইনস্যুরেন্স ইনফো দিয়ে ‘দুঃখিত’ বলা। কারও গাড়ি ঠুকে পালিয়ে যাওয়াটা এখানে আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। ক্ষতির পরিমাণভেদে জেল–জরিমানাও হতে পারে। এই ইমিগ্র্যান্ট দম্পতি হয়তো সেসবের তোয়াক্কাও করেন না।

কিন্তু পেছনের সিটে বসা ওনাদের ছেলেটা (বয়সে আমার বড় ছেলের সমান হবে) এ দেশের আলো–বাতাসে বড় হচ্ছে। সে বেচারা টিপিক্যাল আমেরিকানদের মতো পেছন ফিরে দেখছিল ওই গাড়ির কোনো ক্ষতি হলো কি না। একবার আমার সঙ্গে চোখাচোখি হলো। আমি যে ঘটনার একজন সাক্ষী, সেটা ওর মা–বাবার বোধে না এলেও ওর চেহারায় সেই অপরাধবোধ ছিল। বাপের অপকর্মে সে যেন লজ্জিত।

এবার আসি অন্য একটা ঘটনায়।

আমেরিকার এক তরুণী ইউটিউবার হতে চেয়েছিল। হাইস্কুলের বয়ফ্রেন্ডকে সঙ্গে নিয়ে ভ্যান নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল আমেরিকার পথে পথে ঘুরতে, ভিডিও আপলোড করতে। এটাই ছিল ওর ক্যারিয়ার ড্রিম।

ভিডিওতে যদিও ওদের সুখী দম্পতি দেখাত, কিন্তু ভেতরে ভেতরে বেশ সমস্যা চলছিল। বেশির ভাগ সোশ্যাল মিডিয়া কাপলেরই এই কাহিনি। তবে এখানে ‘ডমেস্টিক’ ভায়োলেন্স যুক্ত আছে।

মেয়ের পরিবার, মেয়ের বান্ধবীরা, সবাই জানে এই ছেলের সমস্যা আছে। মেয়ে নিজেও জানে। মার খায়। কিন্তু তারপরে ওই ছেলে এমনভাবে সরি বলে যে মেয়েটার ধারণা হয় ছেলেটা একেবারে ফেরেশতা, ওর নিজের সব দোষ। ও এই ছেলের যোগ্য না। সে ছেলেটাকে ভালোবাসা দিয়ে পুষিয়ে দিতে চায়।

আমাদের দেশের বহু নারীর ক্ষেত্রে ঘটনার মিল পাওয়া যাচ্ছে?

সমস্যাটা হচ্ছে, এই মেয়েটা একদিন গায়েব হয়ে যায়।

পরিবার বহু খোঁজাখুঁজি করেও ওর সন্ধান পাচ্ছিল না। ছেলেটা ওই মেয়েটার ভ্যান নিয়ে নিজের বাপ–মায়ের বাড়িতে পালিয়ে আসে। পুলিশ সেই ভ্যান উদ্ধার করে, কিন্তু আমেরিকান আইনের মারপ্যাঁচের কারণে ছেলেটার সঙ্গে কোনো কথাবার্তা বলতে পারে না।

আরও পড়ুন

পুলিশ/এফবিআই ওদের বুদ্ধি খাটিয়ে মেয়েটার নিথর দেহ উদ্ধার করে। পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট অনুযায়ী মেয়েটাকে ভারী কোনো বস্তু দিয়ে আঘাত করে ও গলা টিপে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়।

অবশ্যই খুনি হিসেবে এই ছেলেটাকেই সন্দেহ করা হয়।

কিন্তু ছেলেটা এরই মাঝে গায়েব হয়ে যায়।

পুলিশ আবারও নিজেদের বুদ্ধি খাটিয়ে ছেলেটাকে খুঁজে বের করে। সে আত্মহত্যা করে একটা জঙ্গলে পড়ে ছিল। শরীর পচে গলে শেষ।

মরার আগে শেষ চিঠিতে সে নিজের অপরাধ স্বীকার করে।

তো যা বলছিলাম। ইন্টারেস্টিং ঘটনা হচ্ছে, মেয়েটা হারিয়ে যাওয়ার আগে পুলিশ ওদের হাইওয়েতে ধরেছিল। কেউ একজন ছেলেটাকে মেয়েটার গালে চড় মারতে দেখে পুলিশে জানায়, পুলিশ রাস্তাতেই ওদের ধরে, এবং মেয়েটা তখন কাঁদছিল। পুলিশ কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে ওদের আলাদা আলাদা করে ছেড়ে দেয়।

এখানেই লোকজনের অভিযোগ যে পুলিশ কেন কিছু করল না? মেয়েটা হয়তো বেঁচে থাকত।

পুলিশ কী বলবে? এ ধরনের ডমেস্টিক ভায়োলেন্স এ দেশে অজস্র ঘটে। কয়টা নিয়ে ওরা মাথা ঘাঁটাবে?

আরও পড়ুন

ঘটনাটা দুঃখজনক। কিন্তু গোটা বিশ্বেই সমস্যাটা বিকট। এ ক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান-আস্তিক-নাস্তিক, খ্যাত, স্মার্ট, শিক্ষিত, মূর্খ কোনো ভেদাভেদ নাই। বিষয়টা এড়িয়ে যাওয়ারও কোনো উপায় নাই। এই যে কিছুদিন আগে এক মহিলাকে ট্রেনে উঠতে গিয়ে স্বামীর পায়ে লাথি খেতে হলো, এক অর্থে সেই মহিলা বেঁচে গেছেন। যে হারামজাদা প্রকাশ্যে এভাবে কাউকে লাথি মারতে পারে, সে যে গোপনে মহিলাকে বিষ খাওয়াবে না, এর গ্যারান্টি কী?

উত্তরার কোপাকুপির ঘটনায় যা প্রকাশ্যে এল এবং যে হাসপাতালের বিছানা থেকেই বউকে হুমকি দিয়ে যাচ্ছে, ও বউকে প্রাইভেটে পেলে কী করতে পারে বুঝে নিন।

বা আরেকটা ভিডিও ভাইরাল হয়েছে, যেখানে এক ছেলে সজোরে এক মেয়েকে চড়–থাপ্পড় দিয়ে যাচ্ছে। বহু মানুষ কমেন্টে প্রশংসাও করছে। ওসব দেশে কবির সিং, অ্যানিমেলের মতো তৃতীয় শ্রেণির ‘সাইকো’ পরিচালকের সিনেমা ব্লকবাস্টার ব্যবসা করে কেন, সেটা বুঝতে খুব বেশি বুদ্ধি না থাকলেও চলে।

প্রথমে গ্রোসারি স্টোরের বাইরে যে ঘটনাটির উল্লেখ করেছিলাম, সেটার রেফারেন্স টেনেই শেষ করি।

আমরা মা–বাবারা টেরই পাই না, আমাদের ছোটখাটো আচরণই আমাদের বাচ্চাদের ওপর কতটা প্রবল প্রভাব ফেলে। ছোটখাটো ভুল করলেও সেটা ওদের নজরে আসে, এবং সেটা নাড়াচাড়া করার মাধ্যমেই ওদের চরিত্র গড়ে ওঠে। কেউ মহাপুরুষ হয়, কেউ হয় নৃশংস খুনি। আদর্শ বাপের পোলাপান আদর্শ হবে, এর গ্যারান্টি নেই। তবে চেষ্টাটা থাকা উচিত। ছেলে যদি দেখে বাবা ওর মাকে পেটাচ্ছে, সেও ওর বৌকে পেটাবে। মেয়ে যদি দেখে মা মার খাচ্ছে, সেও মার খেয়ে চুপ থাকবে। ওই যে ছেলেটা পেছন ফিরে দেখছিল বাপ কী ক্ষতি করেছে, খুব শিগগিরই ওর মস্তিষ্ক এই ধ্যানধারণা থেকে সরে আসবে এবং নতুন ধারণা আয়ত্ত করবে যে অপরাধ করে পালিয়ে যাওয়া যায়। বোকারাই সেটা শোধরানোর চেষ্টা করে।

আরও পড়ুন