ইমিগ্রেশন সমস্যা

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

১.

সেদিন শুনি এক বাংলাদেশি ছেলের সুডেন্ট ভিসা বাতিল হয়েছে। কারণ, সে স্টুডেন্ট ভিসা পেয়েই ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে জানতে চেয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে ওকে যেহেতু রেস্তোরাঁ বা গ্যাস স্টেশনে কাজ করতে হবে, তাই কোনো বড় ভাই আছেন কি না, যিনি ওকে এসব চাকরি পেতে সাহায্য করবেন।

বেচারার মাথাতেই ছিল না যে যুক্তরাষ্ট্রে স্টুডেন্ট হিসেবে এলে আইনত ওর ক্যাম্পাসের বাইরে কাজ করার কথা নয় (কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সুযাগ আছে)। এসব কাজ গোপনে করতে হয়। কর্তৃপক্ষ ভালো করেই জানে, ওরা শুধু না দেখার ভান করে। কিন্তু এমন বোকামি করলে তো ওদেরও বাধ্য হয়ে অ্যাকশন নিতেই হবে, সেটাই করেছে।

২.

সেদিন আমার এক আপু জানাল, ওদের অঙ্গরাজ্য এক বাংলাদেশির স্টুডেন্ট ভিসা বাতিল করে দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। কারণ, সে নাকি গ্যাস স্টেশনে (যেখানে সে চাকরি করে) এক অচেনা ‘স্বর্ণকেশী সুন্দরীকে জোর করে চুমু খাওয়ার চেষ্টা করছিল’। আসলে সে হয়তো গোপনে দুষ্টু সিনেমা দেখে এত দিন শিখেছে, যুক্তরাষ্ট্র ফ্রি.... দেশ। কাজেই ও একটু ফ্রি সার্ভিস নিতে গিয়েছিল।

এর মধ্য দিয়ে ওর পরিবার পথে বসে গেছে। অনেক অর্থ খরচ করে, হয়তো জায়গাজমি বিক্রি করে ছেলেকে বিদেশ পাঠিয়েছিল লেখাপড়া করে শিক্ষিত হতে। ছেলে লেখাপড়া না করে ইমরান হাশমি বা উদিত নারায়ণের মতো ‘চুম্বনদেব’ হতে চেয়েছিল। কী আর করার!

৩.

ইদানীং দেখছি, ‘গেরামের কাজিন হঠাৎ বিদেশে আইসা পড়ছে’–টাইপ লোকজন ধুমায়ে ‘ইনফ্লুয়েঞ্জা’ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে, মানে সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার হওয়ার ধান্দা করছে যা–তা ভিডিও পোস্ট করে।

‘গাইজ! এইটা আমার বাড়ি। এখানেই আমি থাকি। এ বাড়ির ভাড়া বাংলাদেশি মুদ্রায় মাসে এক লাখ টাকা। বেশি বেশি করে লাইক আর শেয়ার করে ছড়িয়ে দেবেন।’

‘গাইজ! এইটা আমাদের রাস্তা আর আমরা এভাবে রাস্তা ‘করস’ করি। লাইক দিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করুন।’

আচ্ছা, এরা ‘গাইজ’ ‘গাইজ’ করে কেন? ‘স্মার্ট’ হতে হলে কি সারাক্ষণ গাইজ গাইজ বলতে হয়?

সমস্যা এটাতেও ছিল না। ভুলভাল কথাবার্তা বলে অন্যকে বিপদে ফেলে তারা। যেমন সেদিন একটা ভিডিও এল আমার ফিডে, যার শিরোনাম ‘আমেরিকার হাসপাতাল এত খারাপ জানলে কখনোই আসতাম না’।

আমি ভাবলাম, আহারে, বেচারার সঙ্গে নিশ্চই কোনো অন্যায় হয়েছে। দেখি সাহায্য করতে পারি কি না।

ভিডিও খুলে দেখি ঘটনা পুরো উল্টো। ওর সদ্যোজাত বাচ্চাকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তিন দিন আলাদা করে রেখেছে। এ সময়ে কাউকে বাচ্চা কোলে নিতে দেয়নি। তাই ‘আমেরিকার হাসপাতাল খারাপ হয়ে গেছে’।

এই ফ্যাক্ট জেনে নিন, যুক্তরাষ্ট্রে কোনো হাসপাতাল আপনাকে বিনা কারণে একটা ঘণ্টাও বেশি রাখবে না। কারণ, ওদের বিল নিয়ে ইনস্যুরেন্স কোম্পানির সঙ্গে দেনদরবার করতে হয়, শুধু শুধু অ্যাডমিট করলে ইনস্যুরেন্স কোম্পানি ওদের টাকা দেয় না। হাসপাতালের বিল কী পরিমাণ আসে, সে সম্পর্কে হালকা ধারণা দিই। আমার বাচ্চাদের জন্ম হয়েছে সি সেকশনে। প্রতিবার হাসপাতালে গিয়েছি। যেদিন বাচ্চা হবে, সেদিন এবং পরের দিনই বাচ্চাসহ মাকে রিলিজ করে দিয়েছে। বিল এসেছে প্রতিবার ৫০ হাজার ডলারের বেশি। ৫০ হাজার ডলার অনেক পরিবারের বার্ষিক আয়ও না। মাত্র দুই দিনের বিল। আমাকে ইনস্যুরেন্স ডিডাকটিবল হিসেবে ছয় হাজার ডলার দিতে হয়েছে, আর বাকিটা ইনস্যুরেন্স কোম্পানি থেকে আদায় করতে হয়েছে। ইনস্যুরেন্স কোম্পানি নানান প্যাঁচ খোঁজে। কেন এত বিল এল? কী করেছে যে এত বিল এল! এইটা না করলে কি হতো না ইত্যাদি।

তাহলে বুঝে নিন, কেন হাসপাতাল আপনাকে শুধু শুধু তিন দিন বসে বসে খাওয়াবে? যে ভ্লগার, সে নিউইয়র্কে ‘গরিব’ হিসেবে সিটির ইনস্যুরেন্স পায়, মানে ওর পকেট থেকে একটা পয়সাও দিতে হয় না, পুরোটাই ইনস্যুরেন্স কোম্পানি থেকে আদায় করা হয়। তাই শুধু শুধু এত দিন হাসপাতালে কাউকে রাখার প্রশ্নই ওঠে না।

তিন দিন রাখার মূল কারণ ছিল, নিশ্চিত থাকুন, জটিল কোনো রোগের কারণে হয়তো শিশুটিকে নিবিড়ভাবে পরিচর্যা করতে হয়েছে। এই লোক উল্টা ওদেরই বিরুদ্ধে একটা ভিডিও পোস্ট করে ফেলল। তার চেয়েও বড় সমস্যা, এই ভিডিও দেখে আরও কিছু লোক নিজের বউকে হাসপাতালে নিতে টালবাহানা করবে এবং এর ফলে হয়তো দুয়েকটা মা বা শিশুর মৃত্যুও ঘটতে পারে।

তারাই দেশে চিকিৎসক ভুল চিকিৎসা করেছে ইত্যাদি হট্টগোল করে চিকিৎসককে মারধর করে, হাসপাতাল ভাঙচুর করে।

আরও পড়ুন

৪.

এমনই আরও কিছু বাংলাদেশি পোস্ট করে বেড়াচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রে এসে কীভাবে ভিজিটর ভিসা পাল্টে অ্যাসাইলাম (আশ্রয়প্রার্থী) নিতে হয়। মানে সাধারণ মানুষের গাধামির সীমা যেখানে গিয়ে শেষ হয়, তাদের শুরুটা তারও বহু সামনে থেকে। ইদানীং দামি ব্র্যান্ডের দুই নম্বরি চাইনিজ পণ্য যেভাবে ফলাও করে বিক্রি করছে, তেমনিভাবে ফলাও করে আশ্রয়প্রার্থী ভিসা বা দুই নম্বরি পথগুলো ফেসবুকে শেয়ার করছে তারা। তাদের কি মাথায় বুদ্ধিশুদ্ধি নেই? মাথায় কী ভরা থাকে? তারা কি মনে করে, যুক্তরাষ্ট্রের ইমিগ্রেশনের লোকজন কলা খেয়ে গাছে ঝুলে বেড়ানো পাবলিক? এসব তাঁদের নজরে এলে সাধারণ বাংলাদেশিদেরও ভিসা পাওয়া কঠিন হয়ে যাবে।

৫.

শেষটা করি হাস্যকর ঘটনার মাধ্যমে।

তবে তার আগে আরেকটি ঘটনা বলি।

উড়োজাহাজে বা বাংলাদেশ দূতাবাসে, ঠিক মনে নেই কোথায়, আমি একটা ফরম পূরণ করছিলাম। আমার পাশে এক বাংলাদেশি যুবক, যাকে দেখেই বুঝতে পারছিলাম যে সে জানেই না কীভাবে কোনো ফরম পূরণ করতে হয়। আমাকে বলে দিতে হচ্ছিল, এখানে আপনার নামের প্রথমাংশ লিখুন, এখানে মধ্যমাংশ, এখানে বংশ।

লোকটা জিজ্ঞাসা করল, ‘আমার নামের প্রথমাংশ কী?’

‘আমি কীভাবে বলব? আপনি আপনার নিজের নাম জানেন না?’

‘জি, আমার নাম রকিব। রকিব লিখি?’

‘রকিব কী?’

‘শুধু রকিব।’

‘রকিব উদ্দিন, আহমদ, মোহাম্মদ, খান কিছু নেই?’

‘না, এটা আমার ডাকনাম। পুরা নাম মোহাম্মদ ফয়জুর রহমান।’

‘ভালো, তাহলে মোহাম্মদ হবে আপনার প্রথমাংশ।’

‘কিন্তু ভাই, নামের শুরুতে এ কে এ আছে।’

‘সেটা কী?’

‘আবুল কালাম আজাদ।’

‘তাহলে এ কে এ মোহাম্মদ লেখেন।’

‘কিন্তু ভাই, নামটা “আকামোহাম্মদ” হয়ে যাবে তো।’

‘মাঝে ডট দেবেন, হবে না।’

‘বংশের ওখানে কী লিখব, “চৌধুরী” লিখি?’

‘আপনি কি “চৌধুরী”? ’

‘না।’

‘তাহলে “চৌধুরী” লিখবেন কেন?’

‘আপনি যে লিখেছেন?’

‘আমি “চৌধুরী”, তাই লিখেছি। আপনি “রহমান” লেখেন।’

মনে হলো কথাটা উনি বিশ্বাস করেননি। স্কুলে পরীক্ষায় কোনো...টাইপ বন্ধু যেমন ইচ্ছা করেই অন্য বন্ধুকে ভুল উত্তর লিখতে বলে নম্বর কমিয়ে দিত, ও আমাকে সেই রকম কোনো ‘বন্ধু’ মনে করছে।

মনের বিরুদ্ধে লড়াই করে ফরম পূরণ করতে লাগল। তারপর একটা জায়গায় এসে জানতে চাইল, ‘এখানে কী লিখব?’

মনে নেই ঠিক কী ছিল, কিন্তু ওটা তার জন্য অ্যাপ্লিকেবল ছিল না। তাই বললাম, ‘এনএ লিখুন।’

আরও পড়ুন

দেখি উনি বাংলায় ‘ন’–এ আ–কার ‘না’ লিখলেন। আমি বললাম, ‘“এনএ” লিখতে বলেছি, “না” লিখলেন কেন?’

‘বাংলায় লিখলে দোষ কোথায়?’

হঠাৎ জন্ম নেওয়া এই ভাষা সৈনিককে কীভাবে বুঝাই ‘এনএ’ আর ‘না’ এক নয়? বললাম, ‘কিছুই লেখার দরকার নেই। ব্ল্যাংক রেখে দিন।’

তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘শুধু শুধু খালি রাখব কেন? কিছু একটা লিখে দিই।’

‘কিছুই যদি লেখার না থাকে, তাহলে কেন শুধু শুধু লিখবেন?’

‘কিছুই যদি না লিখি, তাহলে কেমন কেমন লাগে! যে ফরম দেখবে, সে কী মনে করবে?’

এ–ই ছিল ঘটনা। এখন আরেক ঘটনার সঙ্গে কীভাবে মেলে, সেটাই বলি।

সেদিন জানলাম, এক নারী তাঁর মা–বাবার ইমিগ্রেশনের জন্য অ্যাপ্লাই করেছিলেন। এম্বাসি তাঁদের ডেকেছে এবং বলেছে, ‘আপনারা তো ২০০২ সালেই মারা গেছেন!’

মা–বাবা তো আঁতকে উঠলেন। ঘটনা কী? আমরা মারা গেছি, অথচ আমরাই খবর পেলাম না? মরে গেলে এখানে এলাম কীভাবে?

ভিসা অফিসার তখন তাঁদের অ্যাপ্লিকেশন দেখিয়ে বললেন, ‘এই যে দেখেন, ফর্মের “ডেট অব ডেথ”–এ তারিখ বসানো আছে।’

এখন সেই মা–বাবাকে প্রমাণ করতে হবে যে তাঁরা জীবিত।

আমাদের দেশের কিছু মানুষ ফরম পূরণের সময়ে এই বোকামিটা করে। যেহেতু শূন্যস্থান আছে, তাই কিছু একটা লিখে একে পূরণ করতেই হবে। না হলে যদি পরীক্ষায় নম্বর কাটে? তাই যা মনে আসে, লিখে দেয়। লাগলে লাগল, না লাগলে নেই!

এখানেও নিশ্চই ঘটনা একই ঘটেছে। ফর্ম পূরণের সময়ে মৃত্যুতারিখের শূন্যস্থান ছাড়তে ইচ্ছা করেনি।

মাঝখানে মা–বাবা আপসেট! আমেরিকান এম্বাসির সাদা চামড়ার নারী যেহেতু বলছেন তাঁরা মৃত, তাই নিশ্চই তাঁরা মৃত। এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু মৃত্যু হলে তাঁদের নিশ্চই কুলখানি হয়েছে। তাঁদের নিজেদের কুলখানি! অথচ তাঁদেরই কেউ দাওয়াত দিল না!