অন্য জীবন
একটু আগে অরণ্যকে ওর মামার কাছে ফিরিয়ে দিয়েছে সুফী। গাড়ির পেছনের সিটে বসে গাড়ির কাচের ওপর হাত রেখে আব্বু-বাবা বলে চিৎকার করে কাঁদছিল সাড়ে চার বছরের অরণ্য।
শুষ্ক চোখে তাকিয়ে ছিল নিরুপায় সুফী। বুকের ভেতরের দহন কাকে দেখাত সুফী!
কিছু লোকজন জমে গিয়েছিল। সুফী কারও দিকে না তাকিয়ে হেঁটে যেতে লাগল। গুলশান এক পার হয়ে গুলশান দুইয়ের কাছে চলে এল।
জুলাই মাসের গরমে ঘেমে নেয়ে গেছে সুফী। একটা ঘোরের মাঝে হেঁটে এসেছে ও।
অরণ্যর কান্নাভেজা মুখ চোখের সামনে ভাসছিল। জিনসের পকেটে মোবাইল বাজছে। সুফী ফোন হাতে নিয়ে দেখল—মায়ের ফোন। নিজেকে সামলে নিল। কথা বলে রেখে দিল।
উত্তরা ফিরতে হবে।
গুলশান দুইয়ের মোড়ে দাঁড়িয়ে একটা পানির বোতল কিনল সুফী। একনিশ্বাসে বোতলের সবটুকু পানি খেয়ে নিল। পকেট থেকে সিগারেট বের করে ধারাল। নিজেকে সামলে রাখা অনেক জরুরি। বাসায় ওর বৃদ্ধ বাবা আর মায়ের জন্য। আর নিজের জন্য।
রিকশা নিয়ে কাকলি যাওয়া যায়। সুফী হাটঁতে লাগল। নিজেকে সময় দেওয়া।
অরণ্যর মায়ের সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছে এক মাসের একটু বেশি। সুফী জানে ওরা নিকেতনে থাকে। চাইলেই অ্যাড্রেস বের করা যায়। অরণ্যের মা আসলেই ওকে চিনতে পারেনি। সব শেষ হয়ে গেছে।
ওর বাড়ির ঠিকানা জানলে সুফী কী করবে—এসব ছেলেমানুষি আর নিচু মন আর মানসিকতা সুফীর নেই।
সকাল নয়টার দিকে অরণ্য এসেছিল। ওর মা গাড়ি করে নামিয়ে দিয়ে গেছে।
আজ অফিস যায়নি সুফী। এর পর থেকে বাপ আর ছেলে একসঙ্গে পুরোটা সময়। হাত–পায়ের নখগুলো বড় হয়ে গেছিল অরণ্যর। নখ কেটে দিয়ে, গোসল করিয়ে, পিৎজা খেতে নিয়ে গেল।
ওরা চারজন। সুফী, অরণ্য, বাবা, আর মা।
ফেরার পথে সুফীর বুকেই ঘুমিয়ে গেল ছোট্ট অরণ্য। সন্ধ্যায় যখন ঘুম ভাঙল আবারও বাপের বুকে ঢুকে বসে রইল। টিভিতে ওর প্রিয় নোবিতা। ওর ছোট্ট ব্যাগ গুছিয়ে নেওয়ার সময় সকালের পরে আসা শার্ট সরিয়ে রাখল সুফী।
অরণ্য ওর কাছে থাকুক—সুফী চায়। ছোট্ট অরণ্যর জন্য মা–ও জরুরি। সুফী নিজের কষ্টের চেয়ে অরণ্যর প্রয়োজনকে বেশি প্রাধান্য দিল। শুধু অরণ্যর জন্য ওর মায়ের সুবিধা–অসুবিধা সবকিছু দেখার কথা দিয়েছে সুফী। শুধু ছেলের মুখ চেয়ে। নিজের জন্য কিছুই চায়নি। অহেতুক সিচুয়েশন কমপ্লিকেটেড করার কোনো কারণ দেখে না সে।
বাস খালি। জানালার পাশে বসে সিগারেট ধরিয়ে ভাবছিল সুফী।
ব্রাঞ্চ থেকে ছুটি নেওয়া আছে। ম্যানেজার ওর বন্ধু। ট্রান্সফার নিয়ে কথা হচ্ছে। সুফী অন্য ব্যাংকে সুইচ করবে। এটাই ওর জন্য ভালো। অহেতুক প্রশ্ন নেই। কেউ ওকে ভালো করে চিনবে না। নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকলেই চলবে। তবে ঢাকার বাইরে ও যাবে না। অরণ্যর জন্য ওকে থাকতে হবে। বাবা আর মাকেও ওর সঙ্গে রেখে দেবে। ওঁরা চলে গেলে বাড়ি ভাড়া পেতে নতুন মুশকিল আসবে।
বাস থেকে নেমে এবার রিকশা নিল সুফী। বাসার সামনে এসে মাকে ফোন দিল। বারান্দায় বসে ছিলেন, চাবি ওর হাতে ছুড়ে দিলেন মা।
মায়ের মুখটা ফুলে গেছে। কাঁদছিল বোধহয়। কী সান্ত্বনা দিতে পারে সুফী! ঘরে ঢুকতেই মা জানতে চাইল অরণ্যর কথা। সুফী হেসে ওকে আশ্বস্ত করল। নিজের ঘরে গিয়ে বাথরুমে চলে গেল ফ্রেশ হতে। কাপড় বদলে ডাইনিংরুমে এসে পানি খেল। মা–বাবা ঘুমিয়ে পড়েছেন।
শোবার ঘরের লাইট নিভিয়ে দিল সুফী। বালিশে মাথা রেখে অরণ্যর কথা ভাবছিল। আব্বু-বাবাটা কি ঘুমিয়ে পড়েছে। অরণ্যর শার্ট নিয়ে গন্ধ শুঁকতে লাগল। একসময় ডুকরে কেঁদে উঠল। ওর নীরব কান্নাতে ভিজে গেল শার্ট।
রাতের নিস্তব্ধতা আর অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে যাওয়া কষ্টের একটা ভাঙা বাড়িতে ভূতের মতো জেগে রইল সুফী।
একটু উষ্ণতার জন্য সুফী ফোনের অ্যাপে চোখ বুলাল। উবার পৌঁছাতে আরও মিনিট দশেক লাগবে। ঢাকার জ্যাম। বেশিও লাগতে পারে।
এখন ফোন বাজতেই থাকবে। একবার জুয়েল, একবার তুহিন, তো একবার সিয়াম। সিয়াম ছয় বছর পর দেশে এসেছে। আজ জুয়েলের বাসায় দাওয়াত।
বৃহস্পতিবার। ব্যাংক থেকে একটু আগেই বেরিয়েছে সুফী। ফোন হাতে নিয়ে মাকে ফোন দিল। মা জানে আজ রাতে ফিরতে দেরি হবে।
সুফী: কী করছো? বাবা কোথায়?
মা: এই যে টিভি দেখছে। তুমি ফিরতে কি বেশি রাত হবে?
সুফী: তা একটু হবে। তোমরা ভেবো না। জুয়েল ড্রপ করে যাবে।
সুফী ফোন রেখে গলার টাই খুলে ব্যাগ এ রাখল। একটু পর টয়োটা করোলা ঠিক তার সামনে এসে দাঁড়াল। ড্রাইভার গাড়ির কাচ নামিয়ে বলল ‘সুফী স্যার?’
সুফী গাড়িতে উঠল। ড্রাইভার বেশ হাসি খুশি। বলল, ‘স্যার উত্তরা আইজকা জ্যাম নাই। খুব আরামে যামু গা। স্যার কি ওইখানে থাকেন?’
সুফীর কথা বাড়াতে ইচ্ছা করছে না। হ্যাঁ বলে চুপ করে গেল। কানে এয়ার প্লাগ গুঁজে গান শুনতে লাগল। শুভমিতা গাইছেন ‘যেভাবেই তুমি সকাল দেখো, সূর্য কিন্তু একটাই’...
সিয়াম জড়িয়ে ধরে বলল, ‘সুফী তুই তো পুরাই দরবেশ হয়ে গেসোস। দাড়ি তোকে খুব মানাইসে। সব সাদা।’ সুফী হাসল।
সিয়াম বদলায়নি। জুয়েলের ফ্ল্যাটে ঢুকতেই বাচ্চাদের চিৎকার আর চেঁচামেচি। সুফীর অরণ্যের কথা মনে পড়ল। চার বছর হলো ডিভোর্সের। অরণ্য একসময় এই বাচ্চাগুলোর সঙ্গে খেলা করত। ব্যাগ থেকে চকলেটের টিন বের করল। সিয়ামের দিকে তাকিয়ে বলল ‘তোর বাচ্চাদের দেব?’
সিয়াম হেসে বোলো ‘দে, জিজ্ঞেস করছিস কেন?’
পারভেজ, রাসেল, রাজন আর নাজমুল ঘরে ঢুকল। সিগারেট পার্টি। মাসুম নামাজ শেষ করে পাশে বসল। সবাই গল্পে মশগুল।
সুফী দেখছে আর শুনছে। অরণ্য এখন কী করছে? সুফী ভাবছে।
সিয়ামের ছেলেটা বাপ–পাগল। বাবার কোলে ঝুলে আছে। সুফী হাত বাড়িয়ে দিল। সাদা দাড়ির জন্য বাবুটা কোলে এল। এসেই সুফীর দাড়িতে হাত।
তুহিন বলল ‘তোকে দাদাভাই ভাবছে’। খাবার ডাক পড়ল। সবাই খাবার টেবিল ঘিরে দাঁড়িয়ে।
জুয়েলের বৌ মিতা এসে দাঁড়াল। ‘সুফী ভাই কত দিন পর! একবার খোঁজ ও করলেন না।’
সুফী বলল—‘ভাবি এত্ত মজার খাবার। সময় পেলাম না তো।’
সিয়াম ওর বউকে পরিচয় করিয়ে দিল। ‘আপনার অনেক গল্প শুনি ওর কাছ থেকে। আপনাদের সবার।’
সুফী হাসল। ‘ভাবি নতুন বাড়ির জন্য কংগ্রেটস। ছবি দেখলাম ফেসবুকে। খুব সুন্দর।’
খাওয়া নিয়ে সবাই বসল। গল্প আর খাওয়া। খাবার পর পান সুপারি এল। মিতা ভাবির অনেক সুন্দর গুণের মধ্যেই এইটা আরেকটা।
সিয়াম পান নিয়ে বলল, ‘আজকে পান আর সিগারেট দুইটা একসঙ্গে খাব।’
আমি বললাম, ‘আমেরিকাতে তুই পান কিনিস?’
সিয়াম পানের গল্প করছে। তানভীর উঠে বলল, চল ছাদে যাই। সিগারেট উইথ পান। গ্র্যান্ড কম্বিনেশন।
জুয়েলের ফ্ল্যাটের এই ছাদ খুব সুন্দর। এই ফ্ল্যাটের সবাই ওর ভাই আর বোন। সুন্দর করে সাজিয়ে নিয়েছে। বসে গল্প চলছে।
একসময় মেলা ভাঙল। সবাই বেরিয়ে গেছে।
মাসুম, জুয়েল, তুহিন, সিয়াম আর সুফী।
সিয়াম বলল, ‘আর কত একা থাকবি। এইবার কিছু একটা কর। চাচা আর চাচির কথা ভাব।’
সুফী হাসল।
জুয়েল ওর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোর নিজেরও একজন সঙ্গী দরকার।’
সুফী শুনছিল।
তুহিন বলল, ‘তুই ভালো থাকলে এইটা অনেক ইম্পরট্যান্ট। যা ভালো লাগে কর।’
ওদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মা–বাবা শান্তিতে আছে। এইবা কম কি? সুখ না থাকলেও শান্তি তো আছে। আমি জ্বলন্ত চিতায় ছিলাম। রোজ দেখত চোখের সামনে ছেলেটা পুড়ছে। অরণ্যর মার গল্প কারও অজানা ছিল না। আমি অরণ্যর জন্য পারছিলাম না। আমি চাইনি এই চিতায় আমার ছেলেটা পুড়ে যাক। একসময় আর পারিনি। জানিস আমি রিকশা করে অরণ্যকে নিয়ে ঘুরতাম। টানা অনেক দিন ওকে বুঝিয়েছি। মা আর বাবা আলাদা হয়ে যাব। ও মায়ের কাছে থাকবে। বাবা মাঝেমধ্যেই ওকে দেখতে যাবে। আমার চার বছরের ছেলেটা কিছু বোঝেনি।’
একবার রিকশাওয়ালা মাথা ঘুরিয়ে আমাকে বলেছিল, ‘ভাই আপনে এইগুলান কী কন এই দুধের বাচ্চারে। আপনি মানুষ না।’
‘আমি আসলেই মানুষ না।’
তুহিন বলল, ‘তুই অমানুষ। পরকীয়া দেব-দেবীদের অধিকার। পৌরাণিক গল্প তাই বলে।’
আমি হেসে ফেললাম। পরিবেশ হালকা হয়ে গেল। আমরা গল্প করতে লাগলাম।
জুয়েল বলল, ‘আজ থেকে যা সবাই।’
সুফী ভাবছে আরেকজন মানুষ কি ওর যন্ত্রণা বুঝবে। তা ছাড়া অরণ্যের খরচ দেওয়া এখন সহজ। মা, বাবা আর অরণ্য।
এই জীবন সঙ্গী চায়—সুফী কি চায়? স্বাধীন একটা অনুভব। কোনো পিছুটান নেই , কোনো কমিটমেন্ট নেই। মা, বাবা আর অরণ্যদের কথা আলাদা।
নির্ঘুম রাত আর অবিরাম একটা যন্ত্রণা থেকে এই একাকী থাকা ঢের ভালো।
সিয়াম সবাইকে নিয়ে মেতে আছে। বাচ্চাগুলো খেলছে। ভাবিরাও এখন এখানে। সিয়াম পারেও মাতিয়ে রাখতে।
সুফীর ভালো লাগছে। জীবনের সব রং আসলে ফিকে হয় না। শীতের সময় গরিব মানুষগুলো আগুন জ্বালিয়ে উষ্ণতা খোঁজে। সুফী তার বন্ধুদের জীবনের সুখ থেকে একটু ওম নিতে থাকল।
ভালো লাগার উষ্ণতা—সুফীর খুব দরকার।
বৃষ্টি, মেঘ আর জল।
চা-ঘর বলে এখানকার পুরোনো মানুষজন। নতুন কুঁড়ি পাতা শুকিয়ে চা তৈরি হয় এই কারখানাগুলোতে।
চা-ঘরের উল্টোদিকে একটা মাঠ। লাল মাটির রাস্তা মাঝখানে। চা-ঘরের অন্যদিকে শিরীষগাছের ছায়ার নিচে একতলা দালানঘর। টিনের চাল। ডিসপেনসারি নামেই চেনে সবাই।
সুফী মাঠের একপাশে বসে আছে।
বাজার বসেছে পুরো মাঠজুড়ে। চা–বাগানের শ্রমিক মানুষগুলো এই বাজারের মূল ক্রেতা। কেরোসিনের কুপি বাতির অন্য রকম জাদুকরি আলো। অনেক ছবি তুলেছে সুফী। মাঠের একপাশে বসে ছবিগুলো দেখছে।
কুপি বাতির লাল আলোর জাদুকরি লালচে-হলুদ আভায় চা–শ্রমিক তরুণী মেয়েটার ঘামে পিচ্ছিল কালো ত্বক, ডাগর চোখ, আর কপালের গাঢ় লাল সিঁদুর। কম্পোজিশনটা ভালো লাগছে।
মাটির সঙ্গে মিশে থাকে গাছের পাতা, কেরোসিনের পড়া গন্ধ, ধূপের গন্ধ, চায়ের গন্ধ। ভরা বর্ষায় চায়ের মৌসুম চলছে। বাগানজুড়ে কাজের ব্যস্ততা।
বাজার প্রায় শেষ, ক্রেতা-বিক্রেতা সবাই নিজের বাড়ি ফিরছে। শহর থেকে দূরে এই গ্রামীণ পরিবেশ। এই জায়গা থেকে মাইল তিনেক দূরে আরেকটা বাজার আছে। সেখান থেকে সিএনজি চলে শমশেরনগর অব্দি। তাতেই চড়ে ফিরছে সুফী। ওখানে এক বাড়িতে পেয়িং গেস্ট থাকছে ক’দিন ধরে।
এই হোমস্টের মালিক স্কুলে পড়াতেন একসময়। স্বামী–স্ত্রী দুজনেই সরকরি চাকুরে ছিলেন—এখন অবসরে। তাঁদের দুই মেয়ে, দুজনেই প্রবাসী। সিলেট অঞ্চলের অনেক পরিবারেই এ রকম ছবি।
দোতলা বাড়ি। একতলার বাইরের দিকের ঘরটা হোমস্টে। সদালাপী মানুষ, খুবই অতিথিপরায়ণ। এই নিয়ে তিনবার এসেছে সুফী। এই বাড়ি থেকে মিনিট দুয়েক হাঁটলেই শ্রীমঙ্গল-কুলাউড়া রোড। দিনের বেলায় বাস চলে। রাস্তার পাশেই ঝাঁ–চকচকে শাহীন স্কুল।
আশেপাশের বাড়িগুলোতে মফস্সলের সারল্য ছেড়ে শহুরেপনার ছোঁয়া। ঘন সবুজ আর মাটির গন্ধ এখানে আর নেই। পোড়া তেল আর নাগরিক বর্জ্য চারদিকে। অথচ কয়েক মিনিট হাঁটলেই চারদিক সবুজ। এখানে একটা লেক আছে। প্রথম দিন এসে দুপুরে ওই লেকে গিয়েছিল সুফী। আকাশ কালো হয়ে মেঘ জমল। একটা শেডের নিচে বসে বৃষ্টি দেখার আনন্দ অন্য রকম। ঢাকার জীবনে বৃষ্টি একটা আপদ। এই চা–বাগান ঘেরা মফস্সলের রূপ খুলে যায় বর্ষায়।
রাতের খাওয়া শেষ। চারদিকে রাতের নীরবতা।
বিছানায় বসে কেন যেন বিকেলের দেখা শিরীষগাছের নিচের সাদা রঙের ডিসপেনসারির কথা মনে হলো। একটা সুন্দর ছবির মতো। একদিন ভোরবেল গিয়ে ছবি তুলতে হবে।
রুমে এসে শুয়ে পড়ল সুফী।
বাইরে মেঘের গুড়গুড়, বিজলি চমকাল। ফ্যান চলছে, আরামদায়ক একটা শীত। ক্লান্ত সুফী কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
হোমস্টে থেকে রেলস্টেশন ১০ মিনিটের হাঁটা পথ। ছ’টা বাজতে মিনিট পাঁচেক বাকি। একটু আগে ঢাকা-সিলেট মেইল ছেড়ে গেছে।
সুফী প্ল্যাটফর্মে বসে আছে। ছবি তুলল অনেকগুলো। ট্রেনের যাত্রীদের ছবি। প্ল্যাটফর্মের কুকুর। সিগারেটরর খালি প্যাকেট।
আকাশ কালো করে মেঘে ছেয়ে গেল। মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। প্ল্যাটফর্মের টিনের চালে বৃষ্টির একটানা ঝরে পড়ার শব্দ।
প্ল্যাটফর্মের পাশে একটা রেস্তোরাঁ। সুফী গরম পরোটা আর চা অর্ডার করল। অরণ্য গরম চায়ে ডুবিয়ে পরোটা খেতে ভালোবাসে। কোর্টে অরণ্যর কাস্টডি নিয়ে মামলা চলছে। সুফী চায়নি, অরণ্যর মা মামলা করল। কোর্টে মাসে একবার আসে ওরা। সুফী আর অরণ্য কোর্টের পাশে কোনো রেস্তোরাঁতে গিয়ে বসে। বাবার চায়ের কাপে পরোটা ভিজিয়ে খায় অরণ্য।
ফোন বাজছে। সিমিন কলিং। সুফী ধরল।
সিমিন: ঘুমাচ্ছিলেন?
সুফী: না। একটা রেস্তোরাঁয় বসে চা আর পরোটা খাচ্ছি।
সিমিন: এত্ত সকালে ওখানে রেস্তোরাঁ খোলে? কবে ফিরবেন ঢাকায়?
সুফী: হুম। আমি রেলস্টেশনে। ছবি তুলছিলাম। অফিস যাবে কখন? কাল ফিরব। তিনটা বেজে যাবে। বিকেলে ফ্রি আছ?
সিমিন: আপনি এলে আমি বের হয়ে যাব। আপনার পাঠানো ছবিগুলো দেখলাম। কয়েকটা খুবই সুন্দর। ছবিগুলো দেখলে মন খারাপ লাগে।
আরও কিছুক্ষণ কথা বলে ফোন রেখে দিল।
এই বয়সে একটা ডিভোর্সি মানুষ প্রেম করছে! একটু লজ্জা পেল সুফী। এমনিতেই দেখা হয়ে গেল, তারপর পরিচয়। দুজনের মনে একটু দ্বিধা কিংবা ভয় কাজ করে। দুজনে পুড়ে যাওয়া মানুষ। যাদেরকে তারা দুজন একসময় অনেক ভালোবেসেছিল, বিশ্বাস করেছিল—তারাই ওদেরকে অবলীলায় ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল। এক পা এগিয়ে দুজনেই কয়েক পা পিছিয়ে যায়।
কবিতাটা পড়েছিল কোথাও, কার লেখা মনে নেই। ওদের জীবনের সঙ্গে কেমন যেন মিলে যায়। সুফী সিমিনকে টেক্সট করল।
এভাবে নয়, এমন করে হয় না।
নদীর বুকে বৃষ্টি পড়ে,
পাহাড়—তারে সয় না।
কীভাবে হয়!
কেমন করে হয়?
ফুলের বুকে গন্ধ আর বাতাস দুজনে
যেভাবে রয়—যেমন করে রয়।
এভাবেই হয়, এমন করেই হয়।
রিকশায় অফিসে যাচ্ছে সিমিন। হ্যান্ডব্যাগে রাখা ফোন বিপ করছে, মেসেজ এসেছে। ফোন হাতে নিয়ে সুফীর মেসেজটা পড়ল।
ঢাকার আকাশে মেঘ। মন চাইছে অনেক বৃষ্টি হোক আজ। সব ভেসে যাক। কাল বিকেলেও থাকুক—অনেক অনেক বৃষ্টি। ওদের দেখা হবে। সুফী খুব ভালোবাসে—বৃষ্টি, মেঘ আর জল।
দূর পরবাসে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]