উত্তরে থাকি, দক্ষিণে যাই
১.
লাগোয়ার্ডিয়া বিমানবন্দরে থেকে আহাম্মদের গাড়ি রাস্তায় নামতেই সেরীন অনেকটা চিৎকার করে উঠল, ‘এ তো দেখি ঢাকা আইসা পড়লাম!’ নিউইয়র্কে পা রাখার আগেই এমনতর বিস্ময়কর অনুভূতি আর অভিজ্ঞতার জন্য আমরা কেউই প্রস্তুত ছিলাম না।
‘আরও দেখবেন। মনে হবে একেবারে বাংলাদেশে এসে পড়েছেন’, পাশ থেকে গোলাপ জানিয়ে দেয়। উবার ড্রাইভার আহাম্মদের গাড়ি এঁকেবেঁকে একে–তাকে পাশ কাটিয়ে, সমানে হর্ন বাজিয়ে ছুটতে থাকে। মাঝেমধ্যে কোথায় যেন গলির ভেতর ঢুকে যায়, আবার বেরিয়ে আসে।
‘১২ বছর নিউইয়র্কে গাড়ি চালাই। রাস্তাঘাট সবই আমার নখদর্পণে। আমি জানি, কীভাবে দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছাতে হবে’, বলতে বলতেই আবার হর্ন টেপে আহাম্মদ। আহাম্মদ আমাদের পোর্ট ইউনিয়ন বাস টার্মিনালে পৌঁছে দেবে। সেখান থেকে বাস ধরে আমরা যাব কানেটিকাটে।
২.
নিউইয়র্কে, বলতে গেলে আমেরিকায় এই প্রথম আসা। ২২ বছরের মতো কানাডায় থাকা কেউ আমেরিকায় কিংবা নিউইয়র্কে আসেনি, শুনলে অনেকেই আমার কানাডিয়ান পাসপোর্ট বাতিল করে দিতে চায়, কিন্তু বাস্তবতা এমনই। একেবারেই আসা হয়নি বললে বোধ হয় ভুল বলা হয়। ২০০১ সালে, ১/১১–এর বর্ষপূর্তিতে আমেরিকার ৬–৭টি অঙ্গরাজ্য সফর করেছিলাম স্টেট ডিপার্টমেন্টের আমন্ত্রণে। ঢাকার বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাতজন সাংবাদিক ছিলেন সেই টিমে। প্রথম আলো থেকে ছিলাম আমি। সাতটি রাজ্য ঘুরে নিউইয়র্কে কয়েক দিন কাটিয়ে ঢাকায় ফিরে যাওয়া। যেহেতু সেটি স্টেট ডিপার্টমেন্টের, মানে সরকারি প্রোগ্রাম ছিল, ফলে সেই অর্থে সাধারণের জীবন দেখার তেমন একটা সুযোগ হয়নি। আর সেরীনের জন্য এটিই প্রথম আমেরিকাযাত্রা।
অনেকে অবশ্য বলে থাকেন, ‘যাহা কানাডা তাহা–ই আমেরিকা। তফাত আর কি!’ হ্যাঁ, দুটি দেশকেই বলা হয় উত্তর আমেরিকার দেশ। কিন্তু কানাডা-আমেরিকা কি কখনো এক দেশ ছিল? না, কানাডা–আমেরিকা কখনোই এক দেশ ছিল না। কানাডা বলা যায় পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য থেকে আলাদা হয়ে ১৮৬৭ সালে ডমিনিয়ন অব কানাডা গঠনের মাধ্যমে। ১৯৮২ সালে সংবিধান চূড়ান্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে স্বতন্ত্র সত্তা পায় কানাডা। বিশ্বের দীর্ঘতম সীমান্ত কানাডা ও আমেরিকাকে পাশাপাশি ও আলাদা করে রেখেছে। সীমান্তের উত্তরে কানাডার অবস্থান বলে মার্কিনরা নর্থে কিংবা নর্থ অব দ্য বর্ডার বলেই কানাডাকে উল্লেখ করেন। কানাডার কাছে আমেরিকা হচ্ছে সাউথ অব দ্য বর্ডার। ভৌগোলিক সেই ব্যাখ্যায় আমরা উত্তরে থাকি, এখন দক্ষিণে, মানে আমেরিকা যাচ্ছি।
উত্তর আর দক্ষিণের এই প্রতিবেশী দুই জনপদের মানুষদের নিয়ে নানা রকম গল্প আছে। তবে ১/১১–এর আগপর্যন্ত ড্রাইভিং লাইসেন্স বা যেকোনো একটি অফিশিয়াল পরিচয়পত্র দেখিয়েই আমেরিকা যাওয়া যেত। ১/১১–এর পর কানাডিয়ানদের পাসপোর্ট দেখাতে হয়, আর কানাডায় যাঁরা পারমানেন্ট রেসিডেন্ট, এখনো কানাডিয়ান পাসপোর্ট হয়নি, তাঁদের ভিসা নিতে হয়। একেকটি হঠকারী ঘটনা, উগ্রতা এভাবেই আমাদের প্রতিবেশীর কাছ থেকে, অন্য মানুষের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়, পরস্পরের মধ্যে সন্দেহ তৈরি করে।
৩.
আমাদের ভ্রমণের আলোচনাটা শুরু হয়েছিল আসলে ওয়াশিংটন নিয়ে। অনেক বছর পর মুক্তভাবে ভ্রমণের সুযোগ এসেছে। কানাডায় আসার আগে আমি আর সেরীন হুটহাট এখানে–সেখানে ঘুরতে চলে যেতাম। মূলত প্রতিবেশী ভারতের বিভিন্ন রাজ্য ছিল আমাদের নিয়মিত ভ্রমণের লক্ষ্যবস্তু। দুজন মানুষ—বাসে, ট্রেনে আরামসে চলে যাওয়া যেত। জীবন পরিক্রমায় এখন আবার দুজনে ঘুরে বেড়ানোর মতো অবস্থায় এসে পড়েছি। মেয়েরা ইউনির্ভাসিটির ডর্মে, একা থাকতে পারে। কাজেই আমাদের ঘুরে বেড়াতে সমস্যা নেই।
ওয়াশিংটনে যাব শুনে জয়ন্তদা (জয়ন্ত বণিক) বললেন, ‘আরে, ড্রাইভ করে চলে যান। যেখানে সন্ধ্যা হবে, সেখানেই কোনো একটা মোটেলে রাত কাটাবেন, নেইবারহুড ঘুরে বেড়াবেন, ছোট্ট কোনো রেস্টুরেন্টে খাবেন, পরদিন সকালে আবার ড্রাইভ করতে থাকবেন। আইডিয়াটা খুবই পছন্দ হয়, বিশেষ করে সেরীনের। চিন্তা করতেই একটা রেমান্টিক রোমান্টিক ফ্লেভার চলে আসে।
ইনফ্যাক্ট, কানাডা-আমেরিকায় যাঁরা নিয়মিত আসা–যাওয়া করেন, তাঁদের বেশির ভাগই সড়কপথেই আসা–যাওয়া করেন। বাসে বা ট্রেনে কানাডা-আমেরিকা যাতায়াত তো একেবারে পানিভাত। আমাদের বন্ধুদের অনেককেই দেখি ড্রাইভ করে দূরে দূরে আমেরিকার বিভিন্ন শহরে চলে গেছেন, আবার আমেরিকার বিভিন্ন শহর থেকে কানাডায় চলে এসেছেন। এই লং ড্রাইভ এঁরা বেশ পছন্দ করেন দেখেছি। একটা পরিসংখ্যান দেখছিলাম, ২৫ থেকে ৩৫ হাজার পর্যটক প্রতিদিন সীমান্তপথে কানাডা-আমেরিকা আসা–যাওয়া করেন। আর পর্যটন, কাজ এবং অন্যান্য মিলিয়ে প্রতিদিন আসা–যাওয়া করেন প্রায় ৯৫ হাজার। কিন্তু আমার জন্য এতটা দীর্ঘ পথ গাড়ি চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব ব্যাপার। পরে অবশ্য ওয়াশিংটনের আইডিয়াটা বাদ দিয়েছি।
৪.
লাগোয়ার্ডিয়া নামলেও আমরা প্রথমে যাব কানেটিকাট, নিউইয়র্ক থেকে চার ঘণ্টার ড্রাইভ। সেরীনের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বান্ধবী সাজুর (সাজেদা চৌধুরী) বাসায় দুদিন থেকে আবার ফিরে আসব নিউইয়র্কে। নিউইয়র্ক থেকে টরন্টো। ফলে টরন্টো-নিউইয়র্ক-টরন্টো—এভাবেই বিমানের টিকিট কাটতে হয়েছে। তবে নিউইয়র্ক থেকে কানেটিকাট আসা–যাওয়াটা হবে বাসে।
ভেবেছি, লাগোয়ার্ডিয়া নেমে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট নিয়ে বাস টার্মিনালে চলে যাব, বিশেষ অসুবিধা হলে ট্যাক্সি তো আছেই। কিন্তু গোলাপ (গোলাম মোস্তফা গোলাপ) জানিয়ে দিল, সে ল্যান্ডিং টাইমটায় অতি অবশ্যই বিমানবন্দরে থাকবে।
শুক্রবারের ওয়ার্কিং আওয়ারে কেউ বিমানবন্দরে আসবে, বুঝতে অসুবিধা হয় না, কাজ বাদ দিয়েই তাকে আসতে হবে। আমি যতই নিষেধ করি, গোলাপের এক কথা, ‘ওটা নিয়ে আপনার ভাবার দরকার নেই। আপনি শুধু আসেন।’ রায়পুরার ছেলে গোলাপ একসময় ঢাকায় সিভিল এভিয়েশনে চাকরি করত। নিউইয়র্কে এসেছে, সেটাও এক যুগের বেশি। লাগোয়ার্ডিয়া এয়ারপোর্টেই ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে এক সময়। কোভিডে যখন এয়ারপোর্টগুলো বন্ধ হয়ে যায়, তখন চাকরি নেয় পোস্ট অফিসে। এখনো সেখানেই আছে।
৫.
গোলাপ ড্রাইভ করে কানেটিকাটে পৌঁছে দেওয়ার প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। অনেক কষ্টে তাকে থামাই। একটা সময় ছিল, বিমানবন্দরে যাতায়াতের জন্য মানুষ খুঁজতে হতো। না হলে ট্যাক্সি কিংবা যাঁরা বিমানবন্দরে পিকআপ এবং ড্রপঅফ করেন, তাঁদের ওপরই নির্ভর করতে হতো। এখনো পরিচিত বন্ধুদের কেউ বিমানবন্দরে নামিয়ে দিয়ে আসে! উবার আসার পর অবশ্য উবার ডেকে বেরুয়ে পড়েন। কিন্তু বর্তমানে সুলভে এবং সহজে বিমানবন্দরে আসা–যাওয়ার জন্য পাবলিক ট্রান্সপোর্টের নানা ধরনের সুবিধা আছে, সেটা আমাদের অনেকেরই জানা নেই।
টরন্টোর কথাই যদি বলি, ইউনিয়ন স্টেশন থেকে বিমানবন্দরে জন্য বিশেষ একটা ট্রেনের ব্যবস্থা আছে। ‘ইউপি এক্সপ্রেস’ প্রতি ১৫ মিনিট পর চলাচল করে। ভাড়াও তেমন বেশি না—ওয়ান ১২.৩৫ ডলার। যাঁরা প্রেস্টো কার্ড ব্যবহার করেন, ৯.২৫ ডলার। ৪০১–এর ঝক্কি এড়িয়ে, সময় বাঁচিয়ে নির্ঝঞ্ঝাট ভ্রমণের এর চেয়ে সুবিধা আর কোথায় পাওয়া যায়। বাংলাদেশ বা অন্য কোনো দেশ থেকে যাঁরা টরন্টো আসেন, তাঁরাও পিয়ারসন বিমানবন্দরে থেকে ইউপি এক্সপ্রেস ধরে সোজা ডাউন টাউনে চলে আসতে পারেন। ইউনিয়ন স্টেশন থেকে শহরের যেকোনো স্থানে যাওয়াটা তো আরও সহজ। আবার টিটিসি ধরে কিপলিং স্টেশনে নেমে সেখান থেকে টিটিসি বাস ধরেও সোজা বিমানবন্দরে চলে যাওয়া যায়। আমরা তো বাসা (স্কারবোরো) থেকে বের হয়ে ‘গো’ ট্রেনে ইউনিয়ন আর ইউনিয়ন স্টেশন থেকে ‘ইউপি এক্সপ্রেস’ ধরে পিয়ারসন ইন্টারন্যাশনাল বিমানবন্দরে চলে এসেছি।
আরেকটা কথা বলে রাখি, বিমানবন্দরে ইউপি এক্সপ্রেসের স্টেশন হচ্ছে ১ নম্বর টার্মিনালে। কিন্তু সব কটি টার্মিনালের সঙ্গেই চমৎকারভাবে কানেকটেড। কানেকটিং ট্রেন দিয়ে অন্য টার্মিনাল থেকে ১ নম্বর টার্মিনালে আসার বা ১ নম্বর থেকে অন্য টার্মিনালে যাওয়ার ব্যবস্থা আছে। বিমানবন্দরে সাইন ফলো করলেই ইউপি এক্সপ্রেসে গিয়ে উঠে বসা যায়।
আবার নিউইয়র্কের লাগোয়ার্ডিয়া থেকে পোর্ট অথরিটি বাসটার্মিনালে যাওয়া যায় একেবারে বিনা ভাড়াতেই। Q70 লাগোয়ার্ডিয়া লিংক বাস বিনা ভাড়ায় বিমানবন্দরে থেকে পোর্ট অথরিটিতে নিয়ে যায়। শহরের আরও কিছু জায়গায় যায় এই ফ্রি বাস।
দূর পরবাস-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
৫.
পিয়ারসন থেকে এয়ার কানাডার ফ্লাইটটি লাগোয়ার্ডিয়ায় এসে পৌঁছাতে দেড় ঘণ্টা লাগার কথা। সম্ভবত তার আগেই এসে গেছে ফ্লাইটটি। নিউইয়র্কের প্রধান তিনটি বিমানবন্দরে একটি লাগোয়ার্ডিয়ার অবস্থান একেবারে শহরের কেন্দ্রে। জন এফ কেনেডি, নেওয়ার্ক ইন্টারন্যাশনাল বিমানবন্দরে হিসেবে পরিচিত হলেও লাগোয়ার্ডিয়া প্রতিদিন গড়ে ৪০০ ফ্লাইট ওঠানামা করে। ব্যস্ত সময়ে এক হাজার ফ্লাইট ওঠানামারও রেকর্ড আছে। আন্তর্জাতিক বেশ কিছু ফ্লাইট এখান থেকে চলাচল করলেও মূলত ডমেস্টিক ফ্লাইট চলাচলের জন্যই এই বিমানবন্দর প্রসিদ্ধ। তবে ভেতরে–বাইরে মিলিয়ে লাগোয়ার্ডিয়া বিমানবন্দর একটি দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যের দর্শনীয় স্থান। বিশেষ করে দীর্ঘ সংস্কারের মাধ্যমে বিমানবন্দরটি অপরূপ সাজে সাজানো হয়েছে।
বিমান থেকে নেমে লাগেজ সংগ্রহ করতে গিয়ে দেখি, সেখানে গোলাপ দাঁড়িয়ে। সারা মুখবিস্তৃত হাসি ছড়িয়ে দিয়ে তার জবাব,‘ আপনারা এখান থেকে যেতে পারতেন না তো মামা, হারিয়ে যেতেন।’ নিউইয়র্কে যাতে হারিয়ে না যাই, সে জন্য গোলাপের উৎকণ্ঠা আর আন্তরিকতা তাকে লাগোয়ার্ডিয়া বিমানবন্দরে নিয়ে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল। এক সপ্তাহের বেশি সময় নিউইয়র্কে অবস্থানের পুরোটা সময়ই গোলাপের সতর্ক লক্ষ ছিল, আমরা যেন ‘কোথাও হারিয়ে না যাই’।
৬.
গাড়ির লাগাতার হর্নে ভাবনায় ছেদ পড়ে। এবার কেবল আহাম্মদই নয়, টের পাই, রাস্তায় আরও অনেক ড্রাইভারই সমানে হর্ন দিচ্ছেন। বাইরে তাকিয়ে দেখি, গাড়ি আসলে হেঁটে হেঁটে চলছে। সেরীন যে বলেছিল, ‘এ তো দেখি ঢাকা আইস্যা পড়লাম’, শহরটা যেন জ্যামের শহর, ভিড়ের শহর, মানুষের শহর, যেখানে আবার যখন–তখন গাড়ির হর্ন টেপাটেপিও আছে। প্রচণ্ড রকমের জ্যাম, আর হর্নের শব্দের ভেতর দিয়ে গাড়ি ঠেলতে ঠেলতে আহাম্মদ আমাদের পোর্ট অথরিটি বাস টার্মিনালের মোড়ে নামিয়ে দেয়।