১.
দেবু যখন ‘পোর্ট অথরিটি’ থেকে বাস নেওয়ার কথা বললেন—আমার মাথায় তখন রীতিমতো একটা নৌ–বন্দরের ছবি ভেসে উঠেছিল। নিউইয়র্ক থেকে কানেটিকাট যাওয়া কতটা সহজ হবে, আমরা পেরে উঠব কি না—এসব নিয়ে দেবুর উদ্বেগের শেষ নেই যেন। দেবু যতই উদ্বেগ দেখান, আমি ততই কল্পনায় বন্দরের দৃশ্য দেখতে থাকি। তখন পর্যন্ত আমার ধারণায় ছিল, বাস টার্মিনালটা আসলে বন্দর কর্তৃপক্ষের কোনো স্থাপনায় বা বন্দর এলাকায়।
দেবু নিউইয়র্ক শহর থেকে বেশ খানিকটা দূরে থাকেন, কিন্তু শহরের রাস্তাঘাট, অলিগলি তাঁর চেনা। ফলে আমাদের ভ্রমণটা যাতে নির্বিঘ্ন হয়, সে ব্যাপারে যতটা সম্ভব মনোযোগ দিচ্ছেন তিনি। দেবু মানে দেবাশীষ রায়, ঢাকায় ৭১ টিভির প্রডিউসার ছিলেন। আমি তাঁর সঙ্গে কাজ করেছি একুশে টেলিভিশনে। অনেক দিন হয় নিউইয়র্কে থিতু হয়েছেন।
উবারওয়ালা আহাম্মদ যে মোড়টায় নামিয়ে দিয়ে গেল, সেটা অনেকটা ঢাকার ফার্মগেটের মোড়ের মতো ব্যস্ততম একটা জায়গা। বন্দর–টন্দরের চিহ্ন পর্যন্ত কোথাও চোখে পড়ল না। কোত্থেকে বাস ধরব—এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতেই হঠাৎ একটা বড়সড় ভবনের গায়ে লেখা ‘পোর্ট অথরিটি বাস টার্মিনাল’ সাইনটা চোখে পড়ল।
২.
পোর্ট অথরিটি বাস টার্মিনালে আমাদের প্রথম কাজ কানেটিকাটের বাস খুঁজে টিকিট কাটা। দূরপাল্লার বাস সার্ভিসের গ্রে হাউন্ডের নামটাই সবার আগে আসে। গোলাপ অবশ্য ‘পিটার প্যান’–এর খোঁজ নিয়ে এসেছিল। পিটার প্যানের কাউন্টারে গিয়ে টিকিট পাওয়া গেল, কিন্তু বাস যাবে আরও তিন ঘণ্টা পর। উত্তেজনায় কিংবা নতুন জায়গার অনভ্যস্ততায় ঠিক সেই মুহূর্তে মনে পড়েনি—অন্য কোনো বাস তার আগে যাবে কি না। টিকিট কাটার পর অপেক্ষায় থাকা সময়ে অবশ্য জানা গেল গ্রে হাউন্ডের বাসটা আরও এক ঘণ্টা আগে ছাড়বে। তার মানে একটু খোঁজ করলে কিংবা শান্তভাবে ভেবে সিদ্ধান্ত নিলে আমরা এক ঘণ্টা আগেই কানেটিকাটে পৌঁছতে পারতাম। ভ্রমণের প্রতিটি ঘটনাই একেকটি শিক্ষা—নিজেকে এভাবে সান্ত্বনা দিয়ে বাসের সময়ের জন্যে অপেক্ষায় থাকি।
বিশ্বের রাজধানীখ্যাত নিউইয়র্ক শহরের প্রাণকেন্দ্র-ম্যানহাটানের অবস্থান। কেবল ম্যানহাটানেই আশপাশের শহর থেকে কত লোক প্রতিদিন আসে—সেই হিসাব করলেই তো এই বাস টার্মিনালটির ব্যস্ততার হিসাব পাওয়া যায়। তার মধ্যে এখান থেকে নানা রাজ্যের নানা শহরে দূরপাল্লার বাসও যায়।
৩.
কাউন্টারের লোকটা জানিয়ে দিয়েছিল আমাদের আরও এক লেভেল নিচে নেমে বাসের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। গ্রাউন্ড লেভেলটায় দূরপাল্লার বিভিন্ন বাসের টিকিট কাউন্টার কাম অফিস। যাত্রীদের তথ্য–উপাত্ত দেওয়ার জন্য ইনফরমেশন বুথ আছে এই ফ্লোরেই মাঝামাঝি একটা জায়গায়। একপাশে সাবওয়ের একটা সাইন চোখে পড়ল, সাবওয়ে মানেই তো পাবলিক ট্রান্সপোর্টে শহরের এ–মাথা থেকে ও–মাথা পর্যন্ত যোগাযোগ। এক লেভেল নিচে যেখান থেকে বাস ছাড়বে সেখানে এসে দেখি আরও লোক অপেক্ষায় আছে। একপাশে রাখা বেঞ্চে বসে যাই আমরা। অপেক্ষায় কয়েক ঘণ্টা কাটিয়ে দিতে হবে। কী আর করা!
পোর্ট অথরিটি বাস টার্মিনাল নাকি বিশ্বের ব্যস্ততম বাস টার্মিনাল। কিন্তু বাইরে উবারওয়ালা যেখানে নামিয়ে দিয়ে গেল সেখান থেকে ঠিক আন্দাজ করা যাচ্ছিল না কিছুতেই। আমরা অন্তত চট করে ঠাওর করতে পারছিলাম না কোনটা বাস টার্মিনাল। তথ্য বলছে, ওয়ার্কিং–ডে–গুলোতে গড়ে ৮ হাজার বাস এই টার্মিনাল থেকে আসা–যাওয়া করে, যাত্রী আসা–যাওয়া করে ২ লাখ ২৫ হাজারের বেশি। বছরে ৬৫ মিলিয়নের বেশি যাত্রী এই বাস টার্মিনাল দিয়ে চলাচল করে বলে জানা যায়। বাস টার্মিনালটা যে এতটা গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যস্ততম, সেটা বাসের জন্য টার্মিনালে অপেক্ষায় থেকে ঠাওর করা যায় না। গাড়ি ছাড়ার টাইমিং, সিস্টেম এমন যে টার্মিনালে গিজ গিজ করা ভিড় লেগে যায় না। অবশ্য টার্মিনালটার অবস্থান ও আমেরিকার মতো বড় একটি দেশের বিভিন্ন রাজ্যের সঙ্গে যোগাযোগের নেটওয়ার্ক দেখলেই তখন আর এ নিয়ে কোনো সংশয় থাকে না।
বিশ্বের রাজধানীখ্যাত নিউইয়র্ক শহরের প্রাণকেন্দ্র ম্যানহাটানে এর অবস্থান। আর ম্যানহাটান তো আসলে গল্পেরও শহর—ম্যানহাটান ঘুমায় না, ম্যানহাটন না গেলে নাকি আমেরিকা দেখাই অপূর্ণ থেকে যায়—এসব কথা তো কতবার শুনলাম। কেবল ম্যানহাটানেই আশপাশের শহর থেকে কত লোক প্রতিদিন আসে—সেই হিসাব করলেই তো এই বাস টার্মিনালের ব্যস্ততার হিসাব পাওয়া যায়। তার মধ্যে এখান থেকে নানা রাজ্যের নানা শহরে দূরপাল্লার বাসও যায়।
৪.
ব্যস্ততম ম্যানহাটানের বিখ্যাত টাইম স্কয়ারের মাত্র ব্লকখানি দূরত্বে 40th ও 41st স্ট্রিটের মধ্যে এইটথ অ্যাভিনিউতে টার্মিনালটির অবস্থান। কিন্তু টার্মিনালটির নাম ম্যানহাটান বাস টার্মিনাল বা এইটথ অ্যাভিনিউ বাস টার্মিনাল না হয়ে পোর্ট অথরিটি বাস টার্মিনাল হলো কেন? সেই তথ্যে যাওয়ার আগে বরং খানিকটা ইতিহাস চর্চা করি।
সেটা এখন থেকে প্রায় ৮০ থেকে ৯০ বছর আগের কথা। মিডটাউনের ৭–৮টা জায়গা থেকে বাস ছেড়ে যেত তখন। ব্যক্তিমালিকানার এতগুলো বাসস্ট্যান্ড থেকে বাস চলাচল করতে গিয়ে পুরো মিডটাউনটাই যানজটে লেজেগোবরে অবস্থায় পড়ে যায়। সিটি কর্তৃপক্ষ এই পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পেতে কেন্দ্রীভূত একটি টার্মিনাল করার সিদ্ধান্ত নেয়। সেই টার্মিনাল নির্মাণের দায়িত্ব পড়ে পোর্ট অথরিটি অব নিউইয়র্ক ও নিউজার্সির ওপর।
পোর্ট অথরিটি মূলত নিউইয়র্ক ও নিউজার্সির প্রথম আন্তরাজ্য সরকারি প্রতিষ্ঠান। এই অঞ্চলের পরিবহনবিষয়ক যেকোনো স্থাপনা সেটি সড়ক, নৌ কিংবা আকাশপথ, টার্মিনাল, ট্যানেল যাই হোক না কেন, নির্মাণ, দেখভাল করা তাদের কাজ। প্রতিষ্ঠানটি পরিচালিত হয় দুই রাজ্যের গভর্নরদের মনোনীত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে। মূলত ব্যবসা–বাণিজ্যের বিকাশ ও বিস্তার মাথায় রেখে ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠানটি গড়ে উঠেছিল। পোর্ট অথরিটি দেখভাল করে বলেই টার্মিনালটির নাম পোর্ট অথরিটি বাস টার্মিনাল।
দূর পরবাস-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
৫.
‘পিটার প্যান’–এর সামনের লাইনটা বেশ দীর্ঘ হয়ে গেছে এরই মধ্যে। তার মানে বাস ছাড়ার সময় ঘনিয়ে এসেছে। আশ্চর্য! কখন, কীভাবে সময় পেরিয়ে গেছে একটুও টের পেলাম না যেন। যেকোনো অপেক্ষাই ক্লান্তিকর, বাসস্ট্যান্ডের অপেক্ষা তো আরও বেশি। কিন্তু আমাদের অপেক্ষার সময়টা যে কখন পার হয়ে গেল, টের পেলাম না। আমরাও গিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে গেলাম।
বাস কোম্পানির একজন লোক এসে প্রত্যেকের টিকিট চেক করে ভেতরে পাঠিয়ে দিলেন। দীর্ঘ বাসের নিচের দিকে লাগেজ রাখার নির্দিষ্ট স্থানে ব্যাগ রেখে আমরাও সিটে গিয়ে বসলাম। একজন কৃষ্ণাঙ্গ নারী আমাদের সম্ভাষণ জানালেন। জানালেন এই শিফটে তিনিই এই গাড়ির চালক। কানেটিকাটের প্রধান বাস টার্মিনাল হার্টফোর্টে সাজু এবং তাঁর হাজব্যান্ড স্বপন ভাই আমাদের জন্য অপেক্ষায় থাকবেন।