বাঙ্গাল এক টেক্সানের সূর্যগ্রহণ দর্শন
সূর্যগ্রহণ নিয়ে আমার প্রথম অভিজ্ঞতা ছিল স্কুলজীবনে, কয়েক যুগ আগে, যখন ক্লাস ফাইভে পড়ি। বাংলাদেশে তখন পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ ঘটেছিল, তবে সেটা দেখা গিয়েছিল সুন্দরবনের হিরণ পয়েন্ট থেকে। আমরা সিলেটে ছিলাম, কাজেই ১০০ শতাংশ সূর্যগ্রহণ দেখার অভিজ্ঞতা সেদিন হয়নি।
হালকা হালকা যেটুকু মনে আছে, তা হচ্ছে স্কুলের কিছু ছেলে বাড়ি থেকে কারও পুরোনো এক্স–রে রিপোর্ট কেটে এনেছিল। সেটা দিয়েই সূর্যগ্রহণ দেখা হয়েছিল। কারণ, গ্রহণের সময়ে সূর্যের দিকে তাকালে নাকি চোখ অন্ধ হয়ে যায়।
আর মনে আছে, নানান ‘গুরুত্বপূর্ণ তথ্য’ রটানো হয়েছিল। সবাই তখন এক্সপার্ট, সবাই তখন নাসার বিজ্ঞানী। যেমন গ্রহণ চলাকালে কিছু খাওয়া যাবে না। যদি কেউ খায় তাহলে নাকি পুরো জীবন পেটের অসুখে ভোগে। গ্রহণের সময়ে জিন–ভূতদের উৎসব শুরু হয়। প্রেতলোকের দরজা খুলে যায়। কালো জাদুকরেরা তন্ত্রসাধনায় মেতে ওঠে।
তখন একা একা বাইরে থাকলে ভূতগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। আরও অনেক গুজব এখানে–ওখানে উড়ছিল, যার কিছু কিছু আমাদের কানে ধরা পড়ছিল, এর কোনোটাই মনে নেই।
এরপরও জীবনে কয়েকটা সূর্যগ্রহণ দেখেছি। কোনোটাই পূর্ণগ্রাস ছিল না। কাজেই এ ব্যাপারে আহামরি কোনো আগ্রহও ছিল না। এমনো সময় গিয়েছে যে অফিসে কাজ করছি। দেখলাম বস, টিম মেট এবং বাকিরা সবাই হইহুল্লোড় করতে করতে বাইরে বেরিয়ে বিশেষ সানগ্লাসে সূর্যগ্রহণ দেখছে, আমি ওদের সঙ্গে যোগ দিয়েছি স্রেফ কাজে ফাঁকি দেওয়ার নিয়তেই।
তাই এবার যখন সূর্যগ্রহণের সংবাদ পেলাম এবং আমার বর্তমান অফিসকে অনেক আয়োজন করতে দেখলাম, তেমন কোনো উৎসাহ পেলাম না। ‘এ আর এমন কি?’
খানিকটা বিরক্তও হলাম। মাসের শুরুর দিকে আমার কাজে চাপ থাকে। আধা ঘণ্টা ফালতু সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয় না।
দিন এগোতে থাকে, চারদিকে উৎসাহও বাড়তে থাকে। মানবসম্পদ বিভাগ (এইচআর) ঘোষণা করে, ওই দিন জিনস টি-শার্ট পরে অফিসে আসা যাবে। কেউ গ্রহ–নক্ষত্র আঁকা জামা পরতে চাইলে স্বাগত! অফিস সেদিন বিশেষ কম্বল উপহার দেবে, যাতে আমরা ভবনের ছাদে শুয়ে শুয়ে উপভোগ করতে পারি। থাকবে গুডি ব্যাগ। সেখানে ‘সান-চিপস’, ‘মুন-কেক’, ‘মিল্কিওয়ে চকলেট বার’ ইত্যাদি সব নামওয়ালা চকলেট বিস্কুট থাকবে। সেই সঙ্গে থাকবে সূর্যগ্রহণের জন্য তৈরি বিশেষ চশমা।
বাচ্চাদের স্কুল প্রিন্সিপাল ই–মেইল পাঠালেন। এ নিয়ে তাঁদেরও ব্যাপক প্রস্তুতির কথা জানালেন। প্রত্যেক বাচ্চার জন্য চশমার আয়োজন করা হয়েছে। প্রত্যেক বাচ্চাকে স্কুলের মাঠে টিচারের তত্ত্বাবধানে এ বিশেষ ঘটনার সাক্ষী করা হবে। ওদের স্কুলেও এ নিয়ে নানান আয়োজন রাখা হয়েছে।
ছোট ছেলের ডে কেয়ার অবশ্য বেশ বিরস ছিল। ওদের কোনো আয়োজনের ব্যবস্থা ছিল না। ছোট শিশুদের চার দেয়ালের ভেতরেই রাখা হবে। ঠিক আমার স্কুলের মতো। মনে আছে, আমরা নিয়মিত ক্লাসই করছিলাম। শুধু টিফিনের বিরতিতেই ওই এক্স–রে রিপোর্ট দিয়ে আকাশের দিকে কিছুক্ষণ তাকানোর সৌভাগ্য হয়েছিল।
সিটি থেকে জানানো হলো, যেহেতু পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ দেখতে বাইরে থেকেও প্রচুর ট্যুরিস্ট শহরে আসছে, আমরা সবাই যেন সাবধান থাকি। ট্রাফিক জ্যাম বাড়বে, দুর্ঘটনা হবে, বাসাবাড়ির ছাদের সোলার প্যানেলগুলো কাজ করবে না, নানান জায়গায় নানান অপরাধের ঘটনাও ঘটবে ইত্যাদি নানা সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। আমি ভেবে পেলাম না, কী এমন ঘোড়ার আন্ডা ঘটতে চলেছে যে মানুষ পয়সা খরচ করে প্লেনে চেপে ফ্লাই করে আসছে?
কৌতূহল থেকেই খানিকটা ঘাঁটাঘাঁটি করে জানতে পারলাম, টেক্সাসে শেষ পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ ঘটেছিল ১৮৭৮ সালে এবং পরেরটা ঘটবে ২৩১৭ সালে। মানে হচ্ছে, আমাদের জীবিতাবস্থায় সেটা দেখার সম্ভাবনা শূন্য। আমেরিকায় পরবর্তী সূর্যগ্রহণ দেখা যাবে ২০৪৪ সালে, তবে সেটাও কানাডা থেকে ভালো দেখা যাবে। ২০ বছর পর। গ্যারান্টি কি যে সেটা দেখার জন্য বেঁচে থাকব?
সবচেয়ে কাছাকাছি যেটা ঘটবে, সেটাও ২০২৬ সালে এবং দেখা যাবে উত্তর স্পেন, গ্রিনল্যান্ড, আইসল্যান্ড এবং আর্কটিক অঞ্চলে। যদি না আমার প্রচুর টাকাপয়সা হয়ে যায়, এতটাই যে অতিরিক্ত টাকার টেনশনে রাতে ঘুম হয় না, তবেই কেবল ওটা দেখার জন্য আমি ক্রুজ শিপের টিকিট কেটে সূর্যগ্রহণের সময়ে সেই অঞ্চলে অবস্থান করব। এসব তথ্য জেনে খানিকটা আগ্রহ বোধ করলাম। এত মানুষ একটা বিষয় নিয়ে এত মাতামাতি করছে, কিছু একটা তো নিশ্চয়ই আছে।
ঘটনার দিন অফিসে এলাম। কিন্তু আকাশ মেঘলা। আমি ছাড়া মোটামুটি সবাইকে খুবই হতাশ হতে দেখলাম। এত বিপুল উৎসাহ, আগ্রহ, উত্তেজনা সব নষ্ট করে দেবে চৈত্রসংক্রান্তির কিছু বেরসিক মেঘ?
এদিকে সূর্যও যেন নিজের ভক্তদের হতাশ করতে রাজি নয়। সে সমানে যুদ্ধ করে যাচ্ছে।
আকাশে শুরু হলো ইন্দ্র ও সূর্যের লড়াই। এই মেঘ এই রোদ্দুর। মানুষের মনের অবস্থাও তখন তাই। যেই মুহূর্তে আকাশে মেঘ জমে, সবার চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে যায়, আবার যেই মুহূর্তে সূর্য হাসে, অমনি সবাই উল্লাস করে ওঠে।
আমি কাজে ডুবে রইলাম। যথা সময়ে আমাদের হাতে গুডি ব্যাগ, কম্বল তুলে দেওয়া হলো। দল বেঁধে ছাদের দিকে হণ্টন শুরু হলো। জমি দখলের লড়াই শুরু হওয়ার আগেই সেখানে নিজের অবস্থান পোক্ত করতে হবে।
সূর্যে গ্রহণ লাগা এরও দুই ঘণ্টা আগে শুরু হয়ে গেছে। মাঝেমধ্যে সানগ্লাস পরে আকাশের দিকে তাকাই। গোলাকার সূর্য ঈদের চাঁদের আকৃতি নিতে শুরু করে দিয়েছে। মেঘ তখনো হার মানতে নারাজ। আকাশে আলোর অবস্থাও স্বাভাবিক। আমরা সবাই তখন কাজের ফাঁকের আড্ডা উপভোগ করছি।
অবশেষে ১টা ৪০ মিনিটে যখন সূর্য পুরোপুরি ঢেকে গেল, তখন বুঝলাম কেন মানুষের মনে এত আগ্রহ, কেন মানুষ মহাজাগতিক ঘটনাকে উৎসব বানিয়ে ফেলেছে, কেন মানুষ পকেটের টাকা খরচ করে জরুরি সব কাজ ফেলে ছুটে আসছে দূর দেশে কেবল ঘটনার সাক্ষী হওয়ার উদ্দেশ্যে।
পরম করুণাময় ওপরওয়ালা আমাদের ওপর করুণা করলেন। পুরো দিনব্যাপী যে মেঘ ও সূর্যের লড়াই চলছিল, তার হস্তক্ষেপে মেঘ ওই চার মিনিটের জন্য পিছু হটল। আমরা মুগ্ধ হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলাম। মধ্যদুপুরেও গোটা শহর সান্ধ্য অন্ধকারে ঢেকে গেল। জ্বলে উঠল অটোম্যাটিক স্ট্রিট লাইট। প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই পোষা কুকুরের দল ডেকে উঠল। ওদের মাথায় কিছুতেই ঢুকছে না, হঠাৎ প্রবল প্রতাপশালী সুয্যি মামার কী হয়ে গেল? চাকতির ওপর চাকতি বসে আছে। নিখুঁত, গোলাকার সোনালি একটি আংটি তখন আকাশে জ্বলজ্বল করছে। একটু পরেই আংটির এক কোণে হীরার ঝলকানি দিয়ে উঠল। কী অবিশ্বাস্য সুন্দর!
ঘটনাটা মাত্র চার মিনিটের জন্য স্থায়ী ছিল। দুপুর বেলায় সন্ধ্যা তারা দেখার সৌভাগ্য এই প্রথম হলো। মোবাইল ফোনের ক্যামেরা বের করে প্রচুর ছবি তুললাম, কিন্তু সেই রূপকে ধারণ করে এমন ক্যামেরা কোথায়? মনে পড়ল পবিত্র কোরআনের সেই আয়াত, যেখানে আল্লাহ তাঁর রাসুলের মেরাজ ভ্রমণ নিয়ে বলেছেন।
আমরা অতিক্ষুদ্র সামান্য মানব, আমাদের জন্য পরলোক থেকে বোরাক আসে না, বেহেশত থেকে ফেরেশতা জিব্রাইল (আ.) নেমে মেরাজ ভ্রমণে নিয়ে যান না, তবে আমাদের জন্যও মাঝেমধ্যে আমাদের পালনকর্তা তাঁর মহান নিদর্শনাবলি অবলোকন করার সুযোগ দেন। না চাইতেও মহাজাগতিক এই বিস্ময়কর ঘটনা তিনি তাঁর অতি নগণ্য দাসকে অবলোকন করার সৌভাগ্য দিয়েছেন, তাঁর প্রতি তাই অশেষ কৃতজ্ঞতা।
**দূর পরবাস ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস [email protected]