ভূত

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

ফরিদের বুক ধড়ফড় করছে ঠিকমতো নিশ্বাস নিতে পারছে না। হড়বড় করে অনেক কথা বলতে চাচ্ছে, কিন্তু জিহ্বায় জড়িয়ে যাচ্ছে, যা বলছে এর কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। অবশ্য সে যা বলতে চাচ্ছে, সেটা স্পষ্ট করে বললেও যে সবাই বুঝতে পারবে, এমনও নয়।

ঘটনা ঘটেছে গত রাতে। রাত ছিল গভীর। পুরো শহরের মতো ফরিদও ক্লান্ত ছিল। বিদ্যুতের সমস্যা চলছে বলে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার চারদিক। আকাশ মেঘে ঢাকা, চাঁদ-নক্ষত্রের আলোও তখন অনুপস্থিত।

ফরিদ অন্ধকার ঘরে শুয়ে ছিল। ঘুম আসছে না, মুঠোফোন ঘাঁটাঘাঁটি করছিল, এমন সময়ে হঠাৎ কেউ ফ্যাসফ্যাসে স্বরে বলে উঠল ‘ভাই, ভালো আছেন?’

ফরিদের পিলে চমকে উঠল। সে স্পষ্ট শুনেছে, শব্দটা এসেছে তার ঘরের ভেতর থেকেই। অথচ ঘরে সে ছাড়া আর কেউ নেই।

সে চিৎকার করে বলতে চাইল, কে কে? কিন্তু তার গলা দিয়ে স্বর বেরুল না।

তার মনে হচ্ছে তার বুকের ভেতর হৃৎপিণ্ডটা লাফাতে লাফাতে মুখের ফুটো দিয়ে বেরিয়ে আসবে।
‘ভাই কি ভয় পেয়েছেন?’
ফরিদ এবারও বলতে চাইল ‘কে? কে কথা বলে?’
এইবারও মুখ দিয়ে শব্দগুলো বেরুল না। কেবল ‘আ আ’ জাতীয় একটা আর্তনাদ বেরুল।

‘ভয় পাবেন না ভাই। আমি আপনার কোনো ক্ষতি করতে আসিনি।’

‘কে? কে কথা কয়?’ শেষ পর্যন্ত শব্দগুলো উচ্চারণ করতে পারল ফরিদ। গলায় জোর ফিরলেও হৃৎপিণ্ডের লাফালাফি বন্ধ হয়নি।

ফ্যাসফ্যাসে স্বর প্রশ্নের জবাব দিল, ‘আপনি যা ভাবছেন, আমি সেই।’
‘ক কে কে আপনে?’ ফরিদ তোতলাতে শুরু করল। ‘আপনে কে?’
‘ভূত!’ ফ্যাসফ্যাসে স্বরে বলল। ‘ভাই, আমি একজন ভূত!’

জবাব শুনে ফরিদ যেন মরেই গেল। একবারের জন্য মনে হলো কেউ কি ফাজলামি করছে? একটু সামলে নিক, তারপরে হারামজাদার ফাইজলামি সে ছুটায়ে ছাড়বে।

‘উত্তেজিত হবেন না ভাই। আমি ক্ষতি করতে আসিনি। যদি করতে আসতাম, তাহলে এতক্ষণে আপনি ওপারে চলে যেতেন।’

ফরিদ বুঝতে পারছে না ওর কি এতে আশ্বস্ত হওয়া উচিত কি না। একটা ভূত ওর সামনে ওর ঘরে বসে আছে, ওর সঙ্গে কথাবার্তা বলছে। বিষয়টা ওর ঠিক হজম হচ্ছে না। আবার মানুষ হওয়াও সম্ভাবনা নেই। ছোট্ট এক কামরার ঘরে সে থাকে। আসবাবপত্র বলতে একটি পুরোনো টেবিল, এবং একটা চৌকি পাতা। সেটাই ওর চেয়ার, সেটাই ওর বিছানা। শোবার আগে ভালো করে নিশ্চিত হয়েছিল দরজা ঠিক মতো লাগানো হয়েছে। এরপর কেউ ওর ঘরে ঢুকতে পারার কথা নয়। এবং আগে থেকেও ঘরে কেউ লুকিয়ে থাকা সম্ভব নয়।

ফরিদের বয়স ৩৫ থেকে ৪০ এর ভেতরে কিছু একটা হবে। সঠিক হিসাব ও নিজেও জানে না। এতিম। জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই সে রাস্তায় রাস্তায় বড় হয়েছে। শৈশব থেকেই টুকটাক নানা কাজ করে জীবন চালিয়ে আজকে এই পর্যন্ত সে পৌঁছেছে। কখনো টোকাই, কখনো বুটপলিশ, কখনো চা, পান, বিড়ি সিগারেট বিক্রি করে পেট ভরেছে। গত ১০–১২ বছর ধরে দারোয়ানিকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছে। শহরের এক বড় ব্যবসায়ীর বাড়ির গেটে সে দিন রাত ২৪ ঘণ্টা ডিউটি দেয়। মোটামুটি বেতনের পাশাপাশি সেই বাড়িতেই এক কামরার একটি ঘরে সে থাকার সুযোগ পেয়েছে। সঙ্গে দুপুর ও রাতের খাবার ফ্রি। ওর জীবনে এখন পর্যন্ত এটিই সর্বোচ্চ সাফল্য। এখনো বিয়েশাদি করেনি, আগে পিছে কেউ নেইও। বেতন যা পায়, পুরোটাই জমা হচ্ছে। ওর চেয়ে সুখী আর কে আছে?

তারপরেও তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হচ্ছে ড্রাইভিং শিখে ড্রাইভারির চাকরি নেওয়া। দারোয়ান থেকে ড্রাইভারের ইজ্জত বেশি। এ নিয়ে সে বেশ কিছু ড্রাইভিং স্কুলের সঙ্গে কথাবার্তা বলেছে। সবাই মোটা অঙ্কর টাকা চার্জ করে। সে সন্ধানে আছে মোটামুটি সস্তায় যদি কোনো ওস্তাদ পাওয়া যায়, তাহলেই সে শুরু করে দেবে।

এ বাড়ির চালকের বরকতের কাছ থেকে শিখতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু হারামজাদাটা একটু ঘাড়ত্যাড়া। মালিকের গাড়িতে মালিকের অনুমতি ছাড়া সে কাউকে শেখাবে না। এতে নাকি আমানত খেয়ানত হয়ে যাবে! মানুষের চালকেরা নিজেদের ভাই ব্রাদারদের শুধু ড্রাইভিং শেখানোই নয়, নিয়মিত ভাড়ার বিনিময়ে যাত্রী ট্রিপ দেওয়া, গাড়ির তেল, টায়ার, পার্টস বিক্রি করে দেওয়া থেকে শুরু করে সম্ভব যা কিছু, সবকিছুই করে দুই চার পয়সা বাড়তি কামাচ্ছে, কিন্তু এই বেকুবটাকে কে বুঝাবে সেসব কথা? যদি সে রাজি হতো, তাহলে ওর তার দুজনেরই লাভ হতো।

যা–ই হোক, রিজিকের মালিক আল্লাহ। ওর ভাগ্যে অন্য কোনো ওস্তাদ লিখে রেখেছেন নিশ্চই, সে জন্য শুধু অপেক্ষা করতে হবে।

ফ্যাসফ্যাসে স্বর বলল, ‘আমি কেবল আপনাকে ধন্যবাদ দিতে এসেছি ভাই।’

ফরিদের আতঙ্ক এখনো কাটছে না। কাটার কথাও নয়। এত দিন জ্বিন ভূতের নামই শুনে এসেছে, গল্প শুনেছে অমুককে জ্বিনে ধরেছে, তমুককে পরী তুলে নিয়ে গেছে, আর আজকে কি না তার সামনেই দাঁড়িয়ে (নাকি বসে?) আছে একটা ভূত!

সে ভয়ে কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল, ‘ধন....ধন্যবাদ? কিসের ধন্যবাদ?’
‘আপনি আমাদের একটা অনেক বড় উপকার করেছেন, সে জন্য ধন্যবাদ দিতে এসেছি।’

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

ফরিদ কোনোভাবেই বুঝতে পারছে না, সে কার কী উপকার করেছে।

‘আপনার ভয় কেটেছে? যদি বলেন তো এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিই?’

ফরিদ মনে মনে লাইটের সুইচ খুঁজছিল। যেই মুহূর্তে সে নাগাল পেল, ফস করে জ্বালিয়ে দিল। ষাট ওয়াটের বাল্বের আলোয় ঘর ঝলমল করে উঠল, ঘরে সে ছাড়া আর কেউ নেই। তাহলে কথা বলছে কে? বাতি জ্বালানোর ফলে আতংক আরও বেড়ে গেল। আমরা অদেখা বস্তুকেই বেশি ভয় পাই।

বিস্ফোরিত নেত্রে সে দেখল মেঝের এক কোণে রাখা তার প্লাস্টিকের জগ আপনাতেই শূন্যে ভেসে কাঁচের গ্লাসে পানি ঢেলে আবার আগের জায়গায় নেমে গেল। তারপরে শূন্যে ভাসতে ভাসতে গ্লাস তার দিকে এগিয়ে এসে এক হাত দূরে স্থির হয়ে ভেসে রইল।

‘ভাই পানি খান, ভয় কাটান এবং যদি কিছু মনে না করেন তাহলে বাতিটা নিভিয়ে দিন। আলোতে আমাদের অস্বস্তি হয়।’

ফরিদ পানি নিতে নিতে ভয়ার্ত স্বরে বলল, ‘অস্বস্তি হয় মানে? আপনেরা আলো সইহ্য কইরতে পারেন না?’

‘আপনারা যেমন পানিতে গিয়ে বেশিক্ষণ ডুবে থাকতে পারেন না, আমাদের ব্যাপারটাও তাই ভাই। আমাদের দম বন্ধ হয়ে আসে।’

ফরিদ ঢক ঢক করে পানি গিলল। বাতি নিভিয়ে বলল, ‘এখন ঠিক আছে ভাই?’
‘জি ভাই। ধন্যবাদ।’

ফরিদ বুঝতে পারছে না, ঘটনা কী ঘটছে। একটা ভূত ওর সঙ্গে কথাবার্তা বলছে, ওকে পানি খাওয়াচ্ছে—এসব তো অসম্ভব ব্যাপার! লোকে শুনলে ওকে পাগলা গারদে পাঠাবে! কিন্তু চোখের সামনে যা ঘটছে, সেটাকেই বা অস্বীকার করবে কীভাবে? স্বপ্ন নয় এইটা বোঝা যায়। এই যে পানি খেল, কলিজা খানিকটা শীতল হলো, সেটা স্বপ্নে সম্ভব হতো না।

‘আপনি যে রাস্তার ল্যাম্পপোস্ট থেকে বাতি সরিয়ে ফেলেছেন, সেটার জন্য আমার পরিবার আপনার কাছে কৃতজ্ঞ। সেই কৃতজ্ঞতাবোধ থেকেই আপনার কাছে উপস্থিত হয়েছি।’

ফরিদের ঘরের বাতি ফিউজ হয়ে গিয়েছিল। বাড়ির ম্যানেজার মতিন আলীকে সে বলেছিল বাল্ব পাল্টে দিতে। ফাজিলটা মুখ ব্যঙ্গ করে বলেছিল, ‘নিজের পয়সায় কিনে এনে লাগাও। তোমার খরচটা কি? খাওয়াদাওয়া পায়খানা সবই তো এই ঘরেই হয়। দুই দিন পরপর কইবা বাত্তি ফিউজ, বাত্তি ফিউজ, তাইলে হইব? নিজের পয়সায় লাগাইবা, দেখব এক বছরেও বাত্তির কোনো ক্ষতি হয় নাইক্কা।’

ফরিদের মেজাজ খুব খারাপ হলো। সে মোটেই দুই দিন পরপর বাল্ব বদলাতে বলে না। ম্যানেজার মতিন আলীর স্বভাবটাই এমন, সে কাউকেই বিশ্বাসের চোখে দেখতে পারে না। সবসময়েই সন্দেহ! এবং এমনভাবে কথা শোনাবে যেন ওর বাপের সিন্দুক খুলে এনে দিচ্ছে। অথচ ফরিদ খুব ভালো করেই জানে যে মতিন আলী স্যারের কাছে ঠিকই বিল ধরিয়ে দিবে যে বাল্ব বদল করতে এত টাকা খরচ হয়েছে। সেই টাকাটা সে মেরে দেবে। ছিঁচকা চোর একটা!

ফরিদ ভাবলো একটি বাল্ব কিনতে কেন শুধু শুধু নিজের পকেটের টাকা নষ্ট করবে? বরং স্ট্রিট ল্যাম্পের থেকে খুলে আনলেই চলে। সেই উদ্দেশ্যেই সে খুলে এনেছিল। এখন দেখা যাচ্ছে খাল কেটে কুমির এনে ফেলেছে।

‘ইয়ে মানে, ‘এতক্ষণে ওর বুকে অনেক সাহস চলে এসেছে, গলা দিয়ে স্বর বেরুচ্ছে, ‘বাল্ব আনার লগে আপনে গো উপকারের সম্পর্ক বুঝলাম না।’

অদৃশ্য ফ্যাসফ্যাসে শব্দ খানিকটা কাছে এগিয়ে এল। ফরিদের গা আবারও ছমছম করে উঠল।  

‘আর বলবেন না ভাই। স্ট্রিট ল্যাম্পের ধারে যে ভাঙা পরিত্যক্ত দালানটা আছে, যেখানে পাড়ার বখাটে ছেলেরা নেশাটেশা করে, সেখানেই আমাদের সংসার।’

‘কও কি! তোমাগো থুক্কু, ‘তুমি’ কইয়া ফেললাম।’

‘অসুবিধা নাই ভাই। ওসব আপনি তুমি তুই নিয়ে আপনাদের সমাজে যেমন অনেক মারামারি কাটাকাটি হয়, আমাদের সমাজে এসবের বালাই নেই। আপনার যেমনটা সুবিধা হয়, সেভাবেই কথা বলুন।’

‘মানে, কইতে চাইছিলাম, আপনাগো সংসার আছে সেখানে, পাড়ার ছেলেরাও নেশাটেশা করত, তা ওরা ভয় পাইত না?’

‘ভয় দেখালে অবশ্যই ভয় পেত। কিন্তু কথা হচ্ছে, আমরা শুধু শুধু ওদের ভয় দেখাতে যাব কেন? আমাদেরও তো বউ–বাচ্চা পালতে হয়, আমাদেরও অনেক জাগতিক টেনশন আছে, সব ফেলে মানুষকে ভয় দেখিয়ে বেড়ানোর মতো সময় আমাদের নেই। তবে হ্যাঁ, আমাদের মধ্যে যারা শিশু, ওদের একটা খেলা আছে, ‘হ্রিংবাংছো,’ ওই খেলায় মানুষকে ভয় দেখিয়ে শিশু ভূতেরা আনন্দ পায়। যে যত বেশি ভয় দেখাতে পারবে, সে জিতবে। আবার ভয়ে যদি মানুষটা মারা যায়, তাহলে এই খেলা সেই শিশুভূত আর জীবনেও খেলতে পারবে না। ওর বাবা মাকেও অনেক জরিমানা দিতে হয়। শুধু শুধু প্রাণ নিধন আমাদের সমাজে নিষেধ।’

‘কন কী! আমরা তো জানি আপনারা সুযোগ পাইলেই মাইনষের ঘাড় মটকায়া দেন!’

অদৃশ্য স্বর হেসে বলল, ‘না ভাই! আমরা সাধারণ ভূতেরা বেশির ভাগই শান্তি প্রিয়। হ্যাঁ, আমাদের মাঝে যাদের মস্তিষ্ক বিকৃতি রোগ ঘটে, ওরা মাঝে মাঝে এমনটা করে।’

‘আপনাগো ব্যাপারে যতই জানতাছি, ততই অবাক মানতেছি।’
‘আপনাকে অবাক করতে পারছি ভেবে আমিও আনন্দিত হচ্ছি ভাই।’
‘তা ভাই, লোকে যে ভাবে, মানে মাইনষের কথা কইতাছি, আমরা মইরা গেলে পরে ভূত হইয়া যাই, ঘটনা কি সত্যি?’

ফ্যাসফ্যাসে স্বর এইবার হেসে উঠল, ‘হা হা হা, কত আজগুবি ধারণা যে আপনাদের মানুষের মাঝে আছে! ভাই, আপনিই বলেন, একটা বিড়াল মরে গিয়ে কি কুকুর হয়ে যায়? বা কুকুর মরে গিয়ে হাতি? মানুষ মরে গেলে মরেই যায়, ও ভূত হবে কেন? আমরা পুরাই ভিন্ন জাতি।’

‘অদ্ভুত! জাইনা খুশি হইলাম ভাই!’

‘আপনারা মানুষরা মনে করেন আমরা ইচ্ছা করলেই যে কোনো রূপ নিতে পারি। এইটাও ফালতু কথা। আপনারা চাইলেই অদৃশ্য হতে পারেন? না। তেমনই আমরাও চাইলেই দৃশ্যমান হতে পারি না। এই যে আমি আপনার ঘরে আছি, আপনি আমি দুজন চাইলেও আপনি আমাকে দেখতে পারবেন না। অথচ আমাদের নামে আপনাদের সমাজে কত যে বদনাম আর মিথ্যা বানোয়াট কথা!’

‘ঠিক! ঠিক!’
‘ভাই, আমার বৌ কিছুদিন আগে কয়েকটা সন্তান প্রসব করেছে। আপনাদের যেমন ইচ্ছা করলেই প্রতিবছর বাচ্চা হয়, আমাদের জীবনে একবারই বাচ্চা জন্মে। এরপর আর একটাও হয় না। তাই সন্তানদের মূল্য আমাদের সমাজে অত্যধিক! ওই বাড়িতে আমরা এত বছর ধরে থাকি, কোন মানুষ নাই, তারচেয়ে বড় কথা কোন ইলেকট্রিসিটিও নাই, মাঝেমধ্যে কিছু মানুষ এসে বোতল খায়, গাঁজাটাজা টানে, আমাদের কোনো ডিস্টার্ব হয় না। কিন্তু এলাকার কমিশনার বদমাইশটা এ সব ছেলেদের তাড়াতে সেখানে স্ট্রিট ল্যাম্পের ব্যবস্থা করল। রাতে সেখানে বাতি জ্বললে দুষ্ট ছেলেরা ওখানে যাবে না, এই হচ্ছে ওর পরিকল্পনা। কিন্তু এর কারণে আমার ছোট ছোট বাচ্চাদের খুবই অসুবিধায় পড়তে হয়েছিল। ওরা তো শিশু, এখনো আলোতে টিকে থাকার কৌশল শিখেনি। অসুস্থ হয়ে যাচ্ছিল। আপনি বাল্ব সরিয়ে ফেলায় অনেক উপকার হলো!’

ফরিদ এখন বুঝলে পারল ঘটনা। যাক! চুরি করেও কারোর তো উপকার করা হয়েছে! সে সব যুবকেরা মনের সুখে নেশা করতে পারবে। ভূতেরাও শান্তিতে সংসার করতে পারবে। মানুষের পাশাপাশি ভূতেরও দোয়া সে পেল। এতে চুরির পাপ কাটা গিয়ে নেকির খাতায় আরও কিছু পুণ্য জমা হবে। এমন সৌভাগ্য কয়জনের হয়?

সে কৌতূহলি স্বরে বলল, ‘কিন্তু আপনা গো এত ক্ষমতা! সামাইন্য বাল্ব ভাঙতে বা সরাইতে পারলেন না?’

ভূত বলল, ‘সেটা নিয়েও আমাদের অনেক ঝামেলা আছে। আপনাদের যেমন সিটি করপোরেশন, জাতীয় সংসদ, আদালত ইত্যাদি আছে, আমাদের সমাজেও তেমনই অনেক প্রতিষ্ঠান আছে। মানুষের সরকারি সম্পত্তির ক্ষতি করতে চাইলে আগে লিখিত পত্র পেশ করতে হয়, তারপরে সেটা নিয়ে অনেক বাছবিচার, আলোচনা সমালোচনা, পর্যবেক্ষণ, ভোটাভুটি ইত্যাদি শেষে রায় শোনানো হয়। তত দিনে বহু সময় পেরিয়ে যায়। ওদেরও দোষ নেই। যেই হারে শহরে মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, আমাদের বসবাসযোগ্য স্থানের সংখ্যা আশংকাজনকহারে কমছে। মানুষের কাজে আমাদের হস্তক্ষেপ খুবই স্পর্শকাতর বিষয়। এই যে আপনি কাজটা করে দিলেন, আমার এসব ঝামেলার মধ্য দিয়ে যেতে হলো না। ধন্যবাদ ভাই!’

‘আইচ্ছা আইচ্ছা। ভালোই তো!’
‘শুধু ধন্যবাদ নয়, আমার বউ বলে দিয়েছে আপনাকে খুশি করে দিতে হবে। এখন আপনি বলেন, আপনার একটা ইচ্ছা যদি পূরণ করতে বলেন, তাহলে আমি কি করতে পারি?’

ফরিদের বুক আনন্দে লাফিয়ে উঠল। সে কি আলাদিনের চ্যারাগের মতো একটা ইচ্ছাপূরণকারী দৈত্য পেয়ে গেছে? বাহ্! তার মানে ওর দুঃখের দিন শেষ! সুখের দিন চালু!

প্রথমেই যে কথাটা ওর মাথায় এলো, সে সঙ্গে সঙ্গে সেটাই বলল, ‘আমার মালিকের মাইয়াটারে আমার খুব পছন্দ। আমার সঙ্গে ওর বিয়া দিয়া দাও!’

ভূত হো হো করে হেসে উঠল। নিশিরাতের অন্ধকার ঘরে সেই হাসি হৃৎপিণ্ড কাঁপিয়ে দেয়। বহু কষ্টে সে হাসি থামিয়ে বলল, ‘ভাই! নিজের অওকাদ বুঝে ইচ্ছা পোষণ করেন! আমরা অলৌকিক জগতের প্রাণী হলেও এই ইচ্ছাপূরণ আমাদের জন্যও অলৌকিক! হা হা হা।’

‘আপনিই তো কইলেন যা মনে চাইছে তাই কইতে!’
‘হ্যাঁ, কিন্তু সেটারও তো একটা সীমা থাকা দরকার, নাকি? এখন আপনি চাইলেই আমি আপনাকে দেশের প্রধানমন্ত্রী বানায়ে দিতে পারব না। আমাদেরও ক্ষমতা সীমিত।’

ফরিদ মনে মনে বলল, ‘ঘোড়ার ডিমের ভূত তুই! কচু পারোস তুই আমার!’ (বাস্তবেই যা বলেছিল, সেটা ছাপার অযোগ্য এবং অনলাইনে লিখলে ফেসবুক আমাকে এক মাসের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করবে। আপনারাই নোংরা থেকে নোংরা কোন গালি কল্পনা করে নিন, এবং বুঝে নিন এর গালিটা সেটা থেকেও ভয়াবহ।)

মুখে আর খারাপ আচরণ করল না। যদিও ভূত দাবি করছে ওরা মানুষের ক্ষতি করে না, কিন্তু ওদেরই বা কীভাবে ভরসা করবে? যদি রেগে গিয়ে ঘাড় মটকে দেয়?

‘ইয়ে, তাইলে আমার মালিকের যত ট্যাকা আছে, এমন কোনো ব্যবস্থা করেন যাতে সেগুলো আমার হয়া যায়।’

‘এইটা ভালো বলেছেন। এইটা আমি করে দিতে পারি।’
‘সত্যিই?’
‘জি।’

ফরিদের মন চনমন করে উঠল। মালিকের টাকাপয়সার মালিক সে হয়ে গেলে জীবনে আর কোনো কিছু নিয়েই ভাবতে হবে না। যেকোনো মেয়েকেই সে চাইলে বিয়ে করতে পারবে, যেখানে ইচ্ছা সে খেতে পারবে, ঘুরতে পারবে। সে কল্পনা করে নিচ্ছে এই টাকা পেয়ে সে কী করবে! প্রথমেই মতিন আলীর চাকরি খাবে। ফাজিলের ফাজিল! চোরের ঘরের চোর! কিন্তু ড্রাইভার হিসেবে সে বরকতকেই রাখবে। বিশ্বস্ত ড্রাইভার সব মালিকই চায়।

‘তাহলে সেটাই ঠিক রইল ভাই। আপনি আপনার মালিকের যাবতীয় ক্যাশ টাকার মালিক হবেন। আমি এখন তাহলে বিদায় নিচ্ছি। সকালের আগেই আপনি ধনী হয়ে যাবেন! অভিনন্দন!’

ফরিদের মন ততক্ষণে আনন্দে টইটম্বুর। সে আপাতত প্ল্যান করছে এত টাকা দিয়ে সে আর কি কি করবে! প্রথমেই সে পুরান ঢাকায় গিয়ে পেট ভরে কাচ্চি খাবে। তারপরে খাবে শিক কাবাব। আস্ত খাসির রোস্ট খাবার শখ তার বহু দিনের। সেটাও সে এক বসাতেই খেয়ে ফেলতে পারবে! তারপরে যাবে দামি কোন মার্কেটে। দামি দামি জামা কাপড়ের দোকান থেকে দামি দামি জামা কাপড় কিনবে। সিনেমার নায়কেরা, মডেলরা যেসব কাপড় পরে, সেগুলো। পয়সা কোনো বিষয়ই না।

সে ভূতকে বলল, ‘কোনোই সমস্যা নাই! আপনার লগে কথা বইলা খুবই আনন্দ পাইলাম। ভবিষ্যতে যদি ল্যাম্প পোস্ট সরায়ে ফেলতে কন, সেই ব্যবস্থাও করব। করাত দিয়া কাইটা মাটিত ফালায়ে দিমু।’

‘ভাই শুকরিয়া! এখন ঘুমান তাহলে। আমি আমার কাজে বেরিয়ে পড়ি। ঘুম থেকে জেগে উঠেই আপনি ধনী হয়ে যাবেন।’

ফরিদ শুকরিয়া বলারও সুযোগ পেল না। ধপাস করে বিছানায় তার ভারী দেহ আছড়ে পড়ল।  

সকালে যখন ঘুম ভাঙল, তখন সে হতভম্ভ। ঘরময় ক্যাশ টাকা, গয়না, দলিলপত্র ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে। সব একশ, পাঁচশ আর হাজার টাকার বান্ডিল। কোটি কোটি টাকার সম্পত্তির স্তূপ। আর সেই সঙ্গে উপস্থিত আছে পুলিশের পোশাক পরা দুজন কনস্টেবল এবং একজন ওসি। দরজার ওপাশেই জলদগম্ভীর চেহারায় শওকত চৌধুরী। মালিক! দেখেই বোঝা যাচ্ছে তিনি এই মুহূর্তে একটি খুন করার ইচ্ছা মনে রাখেন।

ওসি সাহেব বললেন, ‘সাহেবের ঘুম ভেঙেছে?’

ফরিদ ধড়মড় করে উঠল। ‘জি স্যার, মানে, আপনেরা....আর এই ট্যাকা!’

সে কিছুই বুঝতে পারছে না। ভূত বেকুবটা কি সব টাকা এখানে এমনিই ফেলে চলে গেছে? কত্ত বড় বেয়াক্কেল! এ তো মহাবিপদে পড়া গেল!

ওসি সাহেব বললেন, ‘সেটাই তো আমাদের প্রশ্ন। এত টাকা চুরি করে তুই কি ভেবেছিলি যে তোকে আমরা ধরতে পারব না? পালিয়ে না গিয়ে ঘরেই লুকিয়ে রেখেছিলি, ভেবেছিলি আমরা তো বাইরে খুঁজব, ভেতরে নিশ্চই খুঁজব না। ঠিক না?’

ফরিদ আমতা আমতা করতে লাগল। সে কি বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না।

‘সারা রাত ধরে চুরি করে সারাদিন ঘুমাবি, তারপরে সুযোগ বুঝেই টাকা সরিয়ে ফেলবি, কি ভাবিস আমাদের? চল হারামজাদা! থানায় গিয়ে তোর চুরির সাধ মিটাচ্ছি!’

ফরিদের বুক ধড়ফড় করছে ঠিকমতো নিশ্বাস নিতে পারছে না। হড়বড় করে অনেক কথা বলতে চাচ্ছে, কিন্তু জিহ্বায় জড়িয়ে যাচ্ছে, যা বলছে এর কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। অবশ্য সে যা বলতে চাচ্ছে, সেটা স্পষ্ট করে বললেও যে সবাই বুঝতে পারবে, এমনও নয়।

তারপরও সে বলল, ‘স্যার স্যার! আমার দুটি কথা শুনেন! স্যার, আল্লাহর দোহাই লাগে!’

ওসি সাহেব কি মনে করে যেন আবার বসলেন। বললেন, ‘ঠিক আছে, শুনি কি বলতে চাস!’

ফরিদ হড়বড় করে গত রাতের পুরো ঘটনা খুলে বলল। ওসি সাহেব মন দিয়ে পুরোটা শুনলেন। তারপরে কনস্টেবল দেলোয়ারকে ডেকে বললেন, ‘দেখো তো আশেপাশে কোন আয়না আছে কিনা।’

দেলোয়ার অবাক গলায় বলল, ‘আয়না লাগবে কেন স্যার?’

ওসি সাহেব বললেন, ‘আমি দেখতে চাই আমার চেহারার সঙ্গে কি গাধার চেহারার কোনো মিল আছে কি না। নাহলে এই লোকটা আমাকে গাধা ভাবছে কেন!’

দেলোয়ার এবং তাঁর সঙ্গী কনস্টেবল হো হো করে হেসে উঠল। ওসি সাহেবের রসবোধের সঙ্গে তাঁরা যত পরিচিত হচ্ছে, তত মুগ্ধ হচ্ছে।

ওসি সাহেব হুংকার দিয়ে উঠলেন, ‘হাতকড়া পরায়ে কানে ধরে ওকে হাজতে নিয়ে যাও! আর হারামজাদাটা আমাকে গাধা ভেবেছে বলে দুইটা থাপ্পড় আমার তরফ থেকে বোনাস হিসাবে দাও।’ কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দেলোয়ার এসে ঠাস ঠাস করে ফরিদের গালে দুটি চড় বসিয়ে দিল। আগে মাইর, তারপরে কথা।

সেই রাতে ওসি সাহেবের বাড়িতে তিনি নিজের বিছানায় শুয়ে ছিলেন। পাশে তাঁর স্ত্রী গভীর নিদ্রায় মগ্ন। তাঁর ভারী নিশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে। নানা টেনশনে তাঁর ঘুম আসছে না। তাঁর উচ্চ রক্তচাপ আছে। নিয়মিত ওষুধ সেবন করতে হয়। গভীর নিদ্রা তাঁর সুস্থতার জন্য আবশ্যক। ঘুম আসছে না, এই দুশ্চিন্তাতেই তাঁর ঘুম পালিয়ে যাচ্ছে। এ এক অদ্ভুত যন্ত্রণা! ঘুমের ওষুধ খেলেই ঝামেলা মিটে যাবার কথা। কিন্তু তিনি ঘুমের ওষুধের ওপর নির্ভরশীল হতে চান না।

হঠাৎ ঘরের ভেতর ঠুক করে শব্দ হলো। ওসি সাহেবের ঘুম চটে গেল। তাঁর কান সতর্ক হয়ে উঠল। শব্দটা আবার হলো। কেউ ইচ্ছা করেই চেয়ার সরিয়েছে। ইঁদুর বেড়ালের কাজ নয়। মানুষের আওয়াজ। তিনি ঘুমের ভান করে পড়ে রইলেন। হাত চলে যাচ্ছে সাইড টেবলের ড্রয়ারে। সেখানে তাঁর পিস্তল রাখা আছে।

ঘরের ভেতর কেউ ফ্যাসফ্যাসে স্বরে বলে উঠল, ‘ভাই ভালো আছেন? ভয় পাবেন না। আমি ভূত!’
**দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস [email protected]