যুক্তরাষ্ট্রে ডাকাত বা ছিনতাইকারীর খপ্পরে পড়লে আপনার করণীয় কী
যুক্তরাষ্ট্রে গত কয়েক দিনে দুজন বাংলাদেশি গুলিতে নিহত হয়েছেন। পুলিশ তদন্ত করে বের করার চেষ্টা করছে, ঘটনা কী। হতে পারে ছিনতাই, ডাকাতি, কিংবা অন্য কোনো মোটিভ ছিল পেছনে। সেটা তদন্ত করে কর্মকর্তারা বলুন; আমি বরং এ নিয়ে অতি গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা বলি। যাঁরা আমেরিকায় থাকেন বা আসবেন, তাঁদের জানা ভীষণ জরুরি।
দেশ থেকে এলে অনেকেই রিটেইলে কাজ করেন। মানে ধরেন কোনো গ্যাসস্টেশন, গ্রোসারি স্টোর, রিটেইল ব্যাংকিং ইত্যাদি। এখানে যেহেতু ক্যাশের কারবার চলে, কাজেই চোর–ডাকাতের নজরও থাকে এর ওপর। গ্যাসস্টেশনগুলো সারা রাত খোলা থাকে। অনেক রেস্তোরাঁও গভীর রাত পর্যন্ত খোলা থাকে। তখন লোকজনের ভিড় কম থাকে বলে এক বা দুজন কর্মচারী সেটা পরিচালনা করেন।
স্বাভাবিকভাবেই ডাকাতেরা এর ফায়দা তোলে। ওরা ক্রেতার ছদ্মবেশে ঢুকে দেখে নেয় ভেতরের পরিস্থিতি। তারপর হঠাৎ বন্দুক–পিস্তল বের করে ক্যাশের ড্রয়ার খালি করে দিতে বলে। ওয়ালমার্ট–জাতীয় বড় দোকানে চোরের দল আস্ত টিভি থেকে শুরু করে ছোটখাটো ইলেকট্রনিকসসামগ্রী মেরে দেওয়ার চেষ্টা করে।
এ ক্ষেত্রে কর্মচারী হিসেবে আপনার করণীয় কী?
ওয়ালমার্টে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় এই বলে যে এসব ব্যাপারে সঙ্গে সঙ্গে ম্যানেজারকে জানাতে। আপনি নিজে কনফ্রন্ট করতে যাবেন না। ম্যানেজার পুলিশ ডাকার পাশাপাশি ওদের অ্যাসেট প্রোটেকশন অফিসারকে (ছদ্মবেশী কর্মচারী, যিনি কাস্টমারের বেশেই ডিউটিরত থাকেন) জানাবেন। বিষয়টা প্রফেশনালি হ্যান্ডেল করা হবে।
আপনি যদি চোরকে সরাসরি ধরতে যান এবং চোর যদি ছুরি, চাকু বা পিস্তল চালিয়ে দেয়, বেহুদা আপনি বিপদে পড়বেন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে মরবেন। আর বেঁচে গেলে ওয়ালমার্টই আপনাকে ফায়ার করবে। আপনাকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল এসবে না জড়াতে, আপনি কেন কোম্পানির পলিসি লঙ্ঘন করলেন? একটি টিভির দাম কত? হাজার, দুই হাজার ডলার? আস্ত ক্যাশবাক্স লুটে নিলে কতই–বা নেবে? ১০ হাজার? আপনার প্রাণের চেয়ে কি সেটা বেশি মূল্যবান? হয়তো সেই সম্পদ ইনস্যুরেন্স থেকেই উঠে আসবে, আপনি কেন শুধু শুধু নিজের জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলবেন?
এখন ধরা যাক আপনি ওয়ালমার্টে না, গ্যাসস্টেশনে রাতের কর্মচারী। আপনি ছাড়া সেখানে আর কেউ কাজ করছেন না। এমন সময় আপনি ডাকাতির শিকার হলেন। কী করবেন? হাত ওপরে তুলে দোকান লুটে নিতে দেবেন। ওপরে সিসিটিভি ক্যামেরায় ডাকাতের ফুটেজ ধরা পড়বে। পুলিশ পরে অ্যানালাইসিস করে ঠিকই বের করে ফেলতে পারবে। আপনি মরে গেলে আপনার প্রাণ ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে না।
যে মালিকের জন্য নিজের জীবন দিয়ে দিতে যাচ্ছেন, তিনি কিন্তু আপনাকে চাকরিচ্যুত করার আগে দ্বিতীয়বার চিন্তা করবেন না। তিনি যদি দেখেন তাঁর ব্যবসায় কস্ট কাটিংয়ের প্রয়োজন, আপনাকে খেদিয়েই তিনি শুরু করবেন।
আপনি যদি নিজে মালিক হন, তখন? প্রথমেই নিশ্চিত করবেন আপনার দোকানে লাগানো সিসিটিভি ক্যামেরাগুলো ভালো রেজল্যুশনের, যাতে স্পষ্ট সব চেহারা ফুটে ওঠে। নিশ্চিত করবেন পুলিশের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখতে। ওদের জন্য ফ্রি সোডা/কফির ব্যবস্থা রাখবেন, যাতে ওরা নিয়মিতই আপনার দোকানে বেড়াতে আসে।
আপনার পার্কিং লটে ওদের গাড়িটাই যথেষ্ট, ডাকাতের দল আপনাকে ঘাঁটাবে না। নিরাপত্তার জন্য যা যা প্রয়োজন, সব ব্যবস্থা নেবেন। তারপরও যদি দেখেন ডাকাতির শিকার হয়েছেন, নিজেকে সিনেমার নায়ক ভেবে ওদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার চিন্তা বাদ দিয়ে প্র্যাকটিক্যালি চিন্তা করবেন। ওদের হাতে বন্দুক আছে, আপনার হাত খালি। কাজেই আপনি এমন কিছু করতে যাবেন না, যাতে ওরা গুলি করে বসে। তারপরও গুলি করে বসে অনেক ডাকাত। তখন কিছুই করার থাকে না। আপনি আপনার চেষ্টা করেছেন।
অনেককেই চিনি, যাঁরা গ্যাসস্টেশনে ডাকাতির শিকার হয়েছেন, গুলি খাননি, বেঁচে গিয়েছেন।
এমনও একজনকে চিনি, যাঁকে সাতটা গুলি করা হয়েছিল, বেচারা নিজে ৯১১ কল করে অ্যাম্বুলেন্স ডাকিয়ে হাসপাতালে গিয়ে বেঁচে গিয়েছেন।
এমনও অনেকেই আছেন, গুলিতে নিহত হয়েছেন। প্রতিটি পরিস্থিতি আলাদা। তবে নিয়ম একটাই, নিজেকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করবেন।
আমাদের এক মামা দেশে থাকতে অ্যাথলেট ছিলেন। আশির দশকের কথা। তিনি লস অ্যাঞ্জেলেসে এসেছেন। পাবলিক ফোন থেকে দেশে কল করে বেরিয়ে দেখেন একদল ছিনতাইকারী তাঁকে ঘিরে ধরেছে। ইয়া মস্ত চেহারা, বিশাল সাইজের শরীর! তিনি জানেন, ওদের সঙ্গে লড়ে সুবিধা করতে পারবেন না। তিনি ফাঁক গলে দিলেন দৌড়। ওরাও তাঁর পেছনে দৌড়াল। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা হাঁপিয়ে উঠল। তাঁর যেহেতু অভ্যাস ছিল, তিনি দৌড়ে কয়েক ব্লক পেরিয়ে নিরাপদ না হওয়া পর্যন্ত থামেননি। বেঁচে গিয়েছেন এবং সে কাহিনি এখনো গর্বের সঙ্গেই সবাইকে বলেন, যাতে সবাই বোঝে কী করতে হবে।
আমার এক কাছের বন্ধু একবার নিজের ফোন বাঁচাতে গিয়ে তেমনই এক সন্ত্রাসীর হাতে মরতে গিয়েছিল। ভাগ্য ভালো, দু–চারটা থাপ্পড়ের ওপর দিয়ে গেছে। ওটা খুবই বোকার মতো কাজ ছিল। ফোন নিতে চাইলে সানন্দে দিয়ে দিন। প্রথম ওই ফোনে ইনস্যুরেন্স থাকলে আপনার মোটামুটি খুবই অল্পের ওপর দিয়ে যাবে। তার চেয়ে বড় কথা, পুলিশ সহজেই ট্রেস করে ধরে ফেলবে চোরদের। আর লকড ফোন তো সে খুলে ব্যবহারই করতে পারবে না। ফোন ছিনতাই এখন হতেই শুনি না।
যাহোক, আবারও বলি, যুক্তরাষ্ট্রে এলে প্রথমেই ধরে নেবেন এ দেশের প্রত্যেকের হাতেই পিস্তল থাকে। কাজেই নিজেকে হিরো প্রমাণ করতে যাবেন না। নিজের জীবন বাঁচানো ফরজ। আপনার পরিবার, আপনার সন্তানদের কাছে আপনার চেয়ে মূল্যবান কিছুই নেই।