শিক্ষক দিবস-১০
জীবনবদলের কারিগরেরা-৪
বাংলাদেশসহ বিশ্বের শতাধিক দেশে ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালন করা হয়। জ্ঞানের ফেরিওয়ালাদের নিয়ে লেখা প্রকাশিত হচ্ছে ‘দূর পরবাস’-এ।
মা-বাবা সন্তানকে জন্ম দেন। কিন্তু তাকে প্রকৃত মানুষরূপে গড়ে তোলেন আমাদের শিক্ষকেরা। আমাদের যুগে শিক্ষকের অবস্থান ছিল মা-বাবার ঠিক পরেই। মা-বাবাকে আমরা যতটা ভালোবাসি, শিক্ষকদেরও ঠিক ততটাই ভালোবাসি। তবে এ ভালোবাসার সঙ্গে মেশানো থাকে অকুণ্ঠ সম্মান। বাবা-মায়েরা আমাদের শিক্ষকদের কাছে পাঠিয়ে নির্ভার থাকতেন। কারণ, তাঁরা জানতেন, তাঁদের সন্তান বিপথে যেতে গেলে শিক্ষকেরাই অভিভাবকরূপে আবির্ভূত হবেন এবং তাদের সঠিক পথে ফিরিয়ে আনবেন। তার জন্য যদি বকুনি দেওয়ার দরকার হয়, সেটাও শিক্ষকেরা দিতে পিছপা হবেন না। আসলে আমরা ছিলাম শিক্ষকদের কাছে নিজের সন্তানের মতোই আদরণীয়।
প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের ধাপ পেরিয়ে আমরা একসময় হাজির হলাম কলেজ নামক দরজার সামনে। এ কথা বলেছিলেন আমাদের কলেজের একজন শিক্ষক। আমাদের কলেজের নাম ‘কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ’। বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ হওয়ায় আমাদের কখনো নিয়মিত ক্লাস হতো না, তাই অবধারিতভাবেই আমাদের স্যারদের কাছে প্রাইভেট পড়ে শেষ করতে হতো সিলেবাস। আমাদের সময় মাধ্যমিক ও কলেজের বিজ্ঞানের বিষয়গুলোর সিলেবাসের মধ্যে ছিল আকাশ-পাতাল তফাত।
কলেজজীবনের স্থায়িত্ব ছিল সময়ের হিসাবে সবচেয়ে কম, কিন্তু তার প্রভাব আছে আমাদের বাকি জীবনজুড়ে। কারণ, কলেজজীবনের ফলাফলই অনেকটা নির্ধারণ করে দিয়েছিল আমাদের ভবিষ্যৎ জীবনের অঙ্ক। আর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতিও একই সঙ্গে নেওয়া হয়ে যেত। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় পাস করে বিভিন্নজনের বিভিন্ন পেশায় যোগদান, বিয়ে, সংসার—সবকিছুই যেন ছিল কলেজজীবনের পড়াশোনার দীর্ঘমেয়াদি ফলাফল। তাই জীবনের সবচেয়ে ক্ষণস্থায়ী অধ্যায়ের কারিগর আমাদের শিক্ষকদের আমরা এখনো ভুলিনি। আজ জীবনবদলের তেমনই কয়েকজন কারিগরকে নিয়ে স্মৃতিচারণা করব।
পদার্থবিজ্ঞান ও গণিতের পর আসে রসায়ন। আমি পড়েছিলাম আতিয়ার স্যারের কাছে। নওরোজ মোহাম্মদ সাইদ নামের রসায়নের আরেক স্যার ছিলেন। তাঁর কাছে আমার পড়া হয়নি, কিন্তু তাঁকে চিনতাম খুব ভালো করে। কারণ, স্যার রসায়নের পাশাপাশি বিভিন্ন সহশিক্ষা কার্যক্রমে ছিলেন অত্যন্ত করিতকর্মা। তখনকার দিনে কলেজে বিতর্ক, খেলাধুলা ও সংস্কৃতিচর্চা হতো নিয়মিত। বিজ্ঞান বিভাগের ফুটবল টিম গঠন করা হবে, তার কোচের দায়িত্ব নিতেন নওরোজ স্যার। বিতর্ক প্রতিযোগিতার জন্য টিম গঠন করা হবে, তারও সংগঠক নওরোজ স্যার। কলেজে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা থেকে নাটক—সবকিছুই হতো নওরোজ স্যারের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে।
এরপর স্যারের সঙ্গে সরাসরি পরিচয় হলো রসায়নের ব্যবহারিক পরীক্ষার সময়। এক্সটার্নাল স্যার সবে প্রশ্ন শুরু করেছেন। এমন সময় আতিয়ার স্যার এসে আমাকে দেখে স্যারকে বললেন, স্যার, প্রশ্ন করেন। এর একটু পর নওরোজ স্যার এসে প্রশ্নবোর্ডে যোগ দিলেন। কিছুক্ষণ পর আতিয়ার স্যারও ফিরে এলেন। এরপর আমার ওপর চলল ত্রিমুখী প্রশ্নবাণ। আমি কোনোমতে সব কটি প্রশ্ন ক্রিকেটীয় ভাষায় ঠেকিয়ে যাচ্ছিলাম। এভাবে কতক্ষণ পার হয়েছে, সেই হিসাব নেই। সবশেষে একটা প্রশ্ন করা হলো, যেটা সরাসরি আমাদের বইয়ে সিলেবাসে ছিল না। তাই আমি মনে মনে হিসাব করছিলাম।
দেরি দেখে স্যাররা বললেন, আচ্ছা যাও। আমি চেয়ার থেকে ওঠামাত্র উত্তরটা মাথায় এল। আমি বললাম, স্যার, উত্তরটা পেয়েছি। স্যাররা বললেন, আর লাগবে না। আমি সন্তুষ্টচিত্তে পরীক্ষা কক্ষের বাইরে চলে এলাম। বাইরে এসে সবে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় যোগ দিয়েছি, তখনই রসায়নের দপ্তরি এসে আমাকে বলল, স্যার আপনাকে ডাকছেন। এ কথা শুনে ভয়ে তো আমার আত্মারাম খাঁচাছাড়া। বন্ধুরাও ভয়ে ভয়ে আমার দিকে তাকাল। আমি মোটামুটি কাঁপতে কাঁপতে স্যারদের সামনে হাজির হলাম। তখন নওরোজ স্যার বললেন, ওইটা নিয়ে যাও। আমি স্যারের কথা না বুঝে ওনার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকলাম। স্যার তখন আবার পাশে রাখা প্লেটের দিকে নির্দেশ করে বললেন, শিঙাড়াটা নিয়ে যাও আর ভবিষ্যতে রসায়নের কোনো বিষয়ে পোড়ো। আমি কাঁপা কাঁপা হাতে শিঙাড়াটা নিয়ে ছুট দিলাম। এরপর পরীক্ষার ফলাফল হাতে এলে দেখলাম, রসায়ন বিষয়ের পাসের নম্বরগুলো সবচেয়ে উজ্জ্বল। অবশ্য ভবিষ্যতে আমি আর রসায়ন পড়িনি, কিন্তু এখনো রসায়নের অঙ্ক থেকে শুরু করে যেকোনো বিক্রিয়া চুম্বকের মতো আমাকে টানে।
চতুর্থ বিষয় হিসেবে আমি নিয়েছিলাম জীববিজ্ঞান। যদিও এটা আমার অপছন্দের বিষয় ছিল; তবুও ভবিষ্যতে মেডিকেলে পড়ার রাস্তাটা খোলা রাখার জন্য নেওয়া। জীববিজ্ঞান পড়েছিলাম কলেজের বাইরের এক স্যারের কাছে। ওনার নামটা আজ আর মনে নেই। জীববিজ্ঞান পড়েছিলাম শুধু পাস করার জন্য। তাই এই বিষয়ে তেমন পরিষ্কার কোনো ধারণাই ছিল না। তার ফলাফলও পেলাম এ বিষয়ের ব্যবহারিক পরীক্ষার সময়। এক্সটার্নাল স্যার আমাকে যে প্রশ্নই করেন, তার উত্তর আমি সরাসরি দিতে পারি না। অনেক ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে উত্তর দিলাম। অবশ্য প্রশ্নও পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারছিলাম না।
এভাবেই কোনোমতে মৌখিক পরীক্ষা পার করলাম। আর যেহেতু এটা চতুর্থ বিষয়, তাই নির্ভার থাকলাম।
পরবর্তী সময়ে ফলাফল হাতে পেয়ে দেখি জীববিজ্ঞান ব্যবহারিক পরীক্ষাতেও প্রায় পূর্ণ নম্বর পেয়েছি।
তখন আমার বান্ধবী জিনিয়া আমাকে বলল, এটা আমাদের কলেজের খালেক স্যারের কৃতিত্ব। আমি অবাক হয়ে গেলাম। আমি স্যারের কাছে তো পড়িইনি। এমনকি স্যারের সঙ্গে সরাসরি পরিচয় পর্যন্ত নেই আমার।
আমাদের শিক্ষকেরা প্রকৃত অর্থেই ছিলেন জীবন গড়ার একেকজন কারিগর। তাই আমাদের উচিত সারা জীবনই তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা; যদিও ওনারা আমাদের সম্মান বা ভালোবাসার মুখাপেক্ষী নন। কারণ, এ দায়িত্ব ওনারা অন্তরের তাগিদ থেকেই পালন করেছিলেন। পরিশেষে আমাদের সব শিক্ষকের সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করছি। প্রথম আলোকে ধন্যবাদ এমন একটি উদ্যোগ নেওয়ার জন্য। শিক্ষক দিবসের অছিলায় স্যারদের সঙ্গে আবারও কথা হলো। কারণ, ওনাদের কারও ছবিই আমার সংগ্রহে ছিল না। কতশত স্মৃতিচারণা হলো সেই সঙ্গে। তুলনামূলক আলোচনা হলো তখনকার দিনের এবং এখনকার দিনের শিক্ষক-ছাত্রছাত্রী সম্পর্ক নিয়ে। এক অকৃত্রিম ভালো লাগায় মনটা ভরে গেল।