জীবনবদলের কারিগরেরা–২

বাংলাদেশসহ বিশ্বের শতাধিক দেশে ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালন করা হয়। জ্ঞানের ফেরিওয়ালাদের নিয়ে লেখা প্রকাশিত হচ্ছে ‘দূর পরবাস’-এ।

কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক আবদুস সাত্তার
ছবি: সংগৃহীত

পিতা–মাতা একজন সন্তানকে জন্ম দেন। কিন্তু তাকে প্রকৃত মানুষরূপে গড়ে তোলেন আমাদের শিক্ষকেরা। আমাদের যুগে শিক্ষকের অবস্থান ছিল পিতা–মাতার ঠিক পরেই। মা–বাবাকে আমরা যতটা ভালোবাসি, শিক্ষকদেরও আমরা ঠিক ততটাই ভালোবাসি। তবে এই ভালোবাসার সঙ্গে মেশানো থাকে অকুণ্ঠ সম্মান। আমাদের বাবা–মায়েরা আমাদের শিক্ষকদের কাছে পাঠিয়ে নির্ভার থাকতেন। কারণ, তাঁরা জানতেন তাঁদের সন্তান বিপথে যেতে গেলে শিক্ষকেরাই অভিভাবকরূপে আবির্ভূত হবেন এবং তাদের সঠিক পথে ফিরিয়ে নিয়ে আসবেন। তার জন্য যদি বকুনি দেওয়ার দরকার হয়, সেটাও শিক্ষকেরা দিতে পিছপা হবেন না। আসলে আমরা ছিলাম আমাদের শিক্ষকদের কাছে নিজের সন্তানের মতোই আদরণীয়।

প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের ধাপ পেরিয়ে আমরা একসময় হাজির হলাম কলেজ নামক দরজার সামনে। এ কথাটা বলেছিলেন আমাদের কলেজের একজন শিক্ষক। আমাদের কলেজের নাম ‘কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ।’ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ হওয়াতে আমাদের কখনো নিয়মিত ক্লাস হতো না। এ ছাড়া ছিল ছাত্রসংগঠনগুলোর দৌরাত্ম্য। তাই প্রায় সব বিষয়ই স্যারদের কাছে পড়ে সিলেবাস শেষ করতে হতো। কলেজজীবনের স্থায়িত্ব ছিল সময়ের হিসাবে সবচেয়ে কম কিন্তু তার প্রভাব আছে আমাদের বাকি জীবনজুড়ে।
কারণ, কলেজজীবনের ফলাফলই অনেকটা নির্ধারণ করে দিয়েছিল আমাদের ভবিষ্যৎ জীবনের অঙ্ক। আর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতিও একই সঙ্গে নেওয়া হয়ে যেত। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় পাস করে বিভিন্নজনের বিভিন্ন পেশায় যোগদান, বিয়ে–সংসার সবকিছুই যেন ছিল কলেজজীবনের পড়াশোনার দীর্ঘমেয়াদি ফলাফল।

তাই জীবনের সবচেয়ে ক্ষণস্থায়ী অধ্যায়ের কারিগর আমাদের শিক্ষকদের আমরা এখনো ভুলিনি। আজকে তেমনি কয়েকজন জীবনবদলের কারিগরদের স্মৃতিচারণা করব। এর আগে প্রথম আলোর ২৪ বছর পূর্তি উপলক্ষে ‘জীবনবদলের কারিগরেরা’ শিরোনামে একটা লেখা লিখেছিলাম। এই লেখাটাকে তার দ্বিতীয় খণ্ডও বলা যেতে পারে।

বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র হওয়ায় বিজ্ঞানের বিষয়গুলো তাই অবধারিতভাবেই আমাদের স্যারদের কাছে প্রাইভেট পড়ে শেষ করতে হতো। আমাদের সময় মাধ্যমিক ও কলেজের বিজ্ঞানের বিষয়গুলোর সিলেবাসের মধ্যে ছিল আকাশ–পাতাল তফাত। আমি বলতাম একটা মাধ্যমিকের রিকশা ভ্যানে চড়ে যেন আমরা কলেজের ট্রেনের সামনে এসে হাজির হলাম। তাই স্বভাবতই আমাদের পানিতে অক্সিজেনের অভাবে মাছের খাবি খাওয়ার দশা হলো। যেহেতু কলেজে আমাদের ক্লাস হয় না, তাই আমরা বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকদের খোঁজ নিতে শুরু করলাম।

কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের প্রশাসনিক ভবন
ছবি: সংগৃহীত

শুরুতেই আসি পদার্থবিজ্ঞানের কথায়। আমি যেহেতু শহরতল ছেলে, তাই জানতাম না ইতিমধ্যে সব স্যারের কাছে ব্যাচ শুরু হয়ে গেছে। অবশেষে পদার্থবিজ্ঞানের জন্য খবর পেলাম কালীপদ স্যারের। যত দূর মনে পড়ে, কালীপদ স্যার তখন কোনো একটা কলেজের প্রিন্সিপাল হিসেবে অবসর নিয়েছেন কিন্তু ব্যাচে ছাত্রদের পদার্থবিজ্ঞান পড়ান। এখানে স্মৃতি থেকে স্যারের চেহারার একটু বর্ণনা দিয়ে রাখি। স্যারের বয়স হয়েছিল কিন্তু শরীরের চামড়ায় ভাঁজ পড়েনি। স্যারের মাথার চারপাশে চুল থাকলেও মাঝখানটা ছিল গড়ের মাঠ। শিক্ষকদের নিয়ে সব সময়ই আমাদের মনের মধ্যে একধরনের সম্ভ্রমমিশ্রিত সম্মান কাজ করত। তাই স্যারদের দিকে মাথা তুলে তাকানোর সাহস করতাম না। কিন্তু প্রথম দিন পড়তে যেয়েই আমাদের ভয়টা কেটে গেল।

স্যার পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে পদার্থবিদ্যার অনেক বিষয়ে আলাপ করতেন আর নিজে থেকেই শিশুর মতো সারল্যে হেসে উঠতেন। এরপর আর ওনার মুখের দিকে তাকাতে ভয় করেনি। এরপর কোনো বিষয়ে বিভ্রান্তি থাকলে প্রশ্নও করতাম। আর আমার যেহেতু সামর্থ্য ছিল না স্যারের বেতন দেওয়ার, সেই কথাটা প্রথম দিনেই জানিয়ে দিয়েছিলাম। স্যার শুধু একবারই শুনেছিলেন। এরপর দুই বছর স্যার আর এই প্রসঙ্গে একটা কথাও জিজ্ঞেস করেননি বরং আমি বুঝতে পারতাম স্যার অন্যদের তুলনায় আমাকে যেন একটু বেশিই প্রশ্রয় দিতেন।

মানুষের ভালোবাসা আসলে এমন একটা বিষয় যে সেটা অনুভব করা যায়। আমিও মনে মনে স্যারকে ভীষণ শ্রদ্ধা করতাম এবং এখনো করি। স্যার আমাদের থিয়োরি পড়াতেন একজন লেখকের বই থেকে কিন্তু অঙ্ক করতে বলতে অন্য লেখকের বই থেকে। কারণ, সেই বইয়ে অঙ্ক বিষয়ে বিস্তারিত আলাপ করা হতো। আমার যেহেতু একই সঙ্গে দুটো বই কেনার সামর্থ্য নেই, সেই অপারগতার কথাও স্যারকে জানালাম। স্যার বললেন, ‘আমার কাছে এক কপি ছিল কিন্তু একজনকে দিয়ে দিয়েছি। তুই এক কাজ কর, তোদের কলেজের সাত্তার স্যারের কাছে যেয়ে চা, উনি দিয়ে দিবেন।’

এবার আসি সাত্তার স্যারের কথায়। কলেজে সাত্তার স্যার আমাদের পড়াতেন পদার্থবিজ্ঞান। কলেজে ক্লাস শুরু হয়েছে। কিশোর মনে একটু একটু করে রং লাগতে শুরু করেছে। একদিন সাত্তার স্যার ক্লাসে এসে বলেছিলেন, ‘তোমরা প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের ধাপ পেরিয়ে এখন কলেজ নামক দরজার সামনে উপস্থিত হয়েছ। এখন তোমাদের ঠিক করতে হবে তোমরা কোন দরজা দিয়ে যেতে চাও।’ আমি সারা জীবন স্যারের এই কথাটা কখনো ভুলব না। স্যারের গায়ের রং ফর্সা আর মাথাভর্তি কোঁকড়া চুল। স্যার অনবরত পান খান তাই ঠোঁট টকটকে লাল হয়ে থাকে। স্যারের চেহারা অতি সাধারণ হলেও ব্যক্তিত্বে এমন কিছু একটা ছিল, যাতে আমরা স্যারকে যমের মতো ভয় করতাম।

আমরা চেষ্টা করতাম স্যারের সামনে না পড়ার; কিন্তু স্যারের এমন কোনো রেকর্ডও নেই যে স্যার কারও সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছেন। সংগত কারণেই তাই কালীপদ স্যারের কথা শুনে প্রমাদ গুনেছিলাম এবং সাত্তার স্যারকে নিয়ে ভয়ের কথা জানিয়েছিলাম। তখন কালীপদ স্যার বললেন, ‘তোরা শুধু ওনার বাইরের খোলসটা দেখেছিস কিন্তু ভেতরের মোমের মতো নরম মনটার সন্ধান করিসনি।’ তবু ভয়টা কাটল না; কিন্তু বইটা আমার লাগবে। তাই একদিন সাত্তার স্যারকে গিয়ে বিষয়টা বললাম। স্যার সঙ্গে সঙ্গে ঘরের ভেতর গিয়ে একটা বই নিয়ে এসে আমাকে দিয়ে দিলেন। আমি যারপরনাই অবাক হয়ে গেলাম যে এই মানুষটাকেই আমরা এত ভয় পাই। এভাবেই কলেজের দুটি বছর কেটে গেল। উচ্চমাধ্যমিকের মূল পরীক্ষা শেষ হয়েছে। এরপর শুরু হয়েছে বিষয়ভিত্তিক ব্যবহারিক পরীক্ষা। অন্য কলেজের একজন স্যার এসে সেই পরীক্ষা পরিচালনা করেন।

লেখক
ছবি: সংগৃহীত

পদার্থবিজ্ঞানের ব্যবহারিক পরীক্ষা চলছে। শুরুতেই একটা ব্যবহারিক পরীক্ষা করতে হয়। এরপর শুরু হয় মৌখিক পরীক্ষা। আমি স্লাইড ক্যালিপার্স দিয়ে একটা বস্তুর দৈর্ঘ্য প্রস্থের পাঠ নিতে ব্যস্ত। হঠাৎ আমার কানের কাছে একজন মানুষ অত্যন্ত কোমল স্বরে বলে উঠল, ‘বাবু তোমার নাম কী?’ প্রশ্ন শুনেই মুখ ঘুরিয়ে প্রশ্নকর্তাকে দেখে আমি ফ্রিজ হয়ে গেলাম। আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন সাত্তার স্যার। আমি কোনোমতে তোতলানো স্বরে নিজের নামটা বললাম। স্যার নামটা শুনেই কিছু না বলে চলে গেলেন। এরপর আমার মনের মধ্যে হাজারো প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে, আমি কি কোনো ভুল করেছি। যা–ই হোক, দুরুদুরু বুকে পরীক্ষাটা শেষ করে একসময় মৌখিক পরীক্ষা দেওয়ার জন্য এক্সটারনাল স্যারের সামনে হাজির হলাম। স্যার শুরুতেই হাজিরা খাতাটা আমার দিকে মেলে ধরে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম লাল কালিতে লেখা কেন? আমি তো রীতিমতো আকাশ থেকে পড়লাম। এরপর স্যার জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি কোনো স্যারের আত্মীয় হও? আমি বললাম, না স্যার। এরপর স্যার জিজ্ঞেস করলেন, তাহলে তোমার নাম কেন এভাবে লেখা?

আরও পড়ুন

তখন হঠাৎই মনে পড়ে গেল সাত্তার স্যার আমার নামটা জানতে চেয়েছিলেন। আমি তখন বললাম, স্যার মনে হয় আমি যেহেতু কলেজের নির্বাচনী পরীক্ষার ফলাফলে প্রথম দশজনের মধ্যে আছি, তাই হয়তোবা আমার নামটা আলাদাভাবে লেখা। স্যার বললেন, ‘তাই নাকি? তা তুমি উচ্চমাধ্যমিকের পর কী পড়তে চাও?’ আমি বললাম, আমার ইচ্ছা বুয়েটে পড়ার। স্যার বললেন, তাই নাকি? আমার এক বন্ধু আছে সে বুয়েটে পড়েছিল। এভাবে এক্সটারনাল স্যার আমার সঙ্গে প্রায় আধা ঘণ্টা গল্প করলেন কিন্তু পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে একটা প্রশ্নও করলেন না। উচ্চমাধ্যমিকের ফলাফল হাতে আসার পর দেখলাম পদার্থবিজ্ঞান ব্যবহারিক পরীক্ষার দুই পত্রেই আমি পূর্ণ নম্বর পেয়েছি। আর এটা সম্ভব হয়েছিল সাত্তার স্যারের কারণে; যদিও আমি স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়িনি। আমাদের স্যারেরা ছিলেন এমনই নিঃস্বার্থ।

আমাদের শিক্ষকেরা প্রকৃত অর্থেই ছিলেন এক একজন জীবন গড়ার কারিগর। তাই আমাদের উচিৎ সারাজীবনই তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা। যদিও উনারা আমাদের সম্মান বা ভালোবাসার মুখাপেক্ষি নন। কারণ এ দায়িত্বটা উনারা অন্তরের তাগিদ থেকেই পালন করেছিলেন। পরবর্তী কোনো লেখায় আমার আরও শিক্ষকদের নিয়ে লেখার আশাবাদ ব্যক্ত করছি। পরিশেষে আমাদের সকল শিক্ষকদের সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করছি।