জীবনবদলের কারিগরেরা-৩

কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের একসময়ের গণিতের শিক্ষক মোহাম্মদ আখতার হোসেন
ছবি: সংগৃহীত

পিতা–মাতা একজন সন্তানকে জন্ম দেন। কিন্তু তাকে প্রকৃত মানুষরূপে গড়ে তোলেন আমাদের শিক্ষকেরা। আমাদের যুগে শিক্ষকের অবস্থান ছিল পিতা–মাতার ঠিক পরেই। মা–বাবাকে আমরা যতটা ভালোবাসি, শিক্ষকদেরকেও আমরা ঠিক ততটাই ভালোবাসি। তবে এ ভালোবাসার সঙ্গে মেশানো থাকে অকুণ্ঠ সম্মান। আমাদের মা–বাবারা আমাদের শিক্ষকদের কাছে পাঠিয়ে নির্ভার থাকতেন। কারণ, তাঁরা জানতেন তাঁদের সন্তান বিপথে যেতে গেলে শিক্ষকেরাই অভিভাবকরূপে আবির্ভূত হবেন এবং তাদের সঠিক পথে ফিরিয়ে নিয়ে আসবেন। তার জন্য যদি বকুনি দেওয়ার দরকার হয়, সেটাও শিক্ষকেরা দিতে পিছপা হবেন না। আসলে আমরা ছিলাম আমাদের শিক্ষকদের কাছে নিজের সন্তানের মতোই আদরনীয়।

প্রাথমিক এবং মাধ্যমিকের ধাপ পেরিয়ে আমরা একসময় হাজির হলাম কলেজ নামক দরজার সামনে। এ কথাটা বলেছিলেন আমাদের কলেজের একজন শিক্ষক। কলেজের নাম ‘কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ’। বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ হওয়াতে আমাদের কখনো নিয়মিত ক্লাস হতো না, তাই অবধারিতভাবেই আমাদের স্যারদের কাছে প্রাইভেট পড়ে সিলেবাস শেষ করতে হতো। আমাদের সময় মাধ্যমিক এবং কলেজের বিজ্ঞানের বিষয়গুলোর সিলেবাসের মধ্যে ছিল আকাশ–পাতাল তফাৎ।

কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের একসময়ের গণিতের শিক্ষক সিরাজুল ইসলাম
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশসহ বিশ্বের শতাধিক দেশে ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালন করা হয়। জ্ঞানের ফেরিওয়ালাদের নিয়ে লেখা প্রকাশিত হচ্ছে ‘দূর পরবাস’-এ।

কলেজজীবনের স্থায়িত্ব ছিল সময়ের হিসেবে সবচেয়ে কম, কিন্তু তার প্রভাব আছে আমাদের বাকি জীবনজুড়ে। কারণ, কলেজজীবনের ফলাফলই অনেকটা নির্ধারণ করে দিয়েছিল আমাদের ভবিষ্যৎ জীবনের অংক। আর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতিও একইসঙ্গে নেওয়া হয়ে যেত। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় পাস করে বিভিন্ন জনের বিভিন্ন পেশায় যোগদান, বিয়ে, সংসার—সবকিছুই যেন ছিল কলেজজীবনের পড়াশোনার দীর্ঘমেয়াদী ফলাফল। তাই জীবনের সবচেয়ে ক্ষণস্থায়ী অধ্যায়ের কারিগর আমাদের শিক্ষকদের আমরা এখনো ভুলিনি। আজকে তেমনি কয়েকজন জীবন বদলের কারিগরের স্মৃতিচারণা করব।

কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের প্রশাসনিক ভবন
ছবি: লেখক

পদার্থবিজ্ঞানের পর আসে গণিত। মাধ্যমিকে গণিতে আমার ফলাফল ছিল অভাবনীয়। মফস্বলের একটা অখ্যাত স্কুল থেকে সাধারণ এবং উচ্চতর গণিতে ফলাফল ছিল আশাতীত। কলেজে ভর্তি হওয়ার পর স্যারদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে দেরি হয়ে গেল। তাই প্রথম বছরটা কোনো স্যারের কাছে না পড়েই পার করে দিলাম। অবশেষে দ্বিতীয় বছর এসে সিরাজ স্যারের কাছে গণিত পড়তে শুরু করলাম। প্রথম দিনই স্যারকে বেতন না দিতে পারার অপারগতার কথা জানালাম। স্যার তাঁর চিরাচরিত অভ্যাসবশত থুতনির নিচে হালকা করে ধরে বললেন, কেন আব্বা? আমি উত্তর দিলাম। বিষয়টা সেখানেই শেষ। সিরাজ স্যারের পড়ানোর ধরনটা ছিল অদ্ভুত। স্যার প্রতি অধ্যায়ের কয়েকটা করে অংক বুঝিয়ে সমাধান করে দিতেন। তারপর বাকি অনেকগুলোসহ সব অংক পাঁচবার করে সমাধান করে আনতে বলতেন। তখন নিউজপ্রিন্ট কাগজের দাম ছিল দিস্তাপ্রতি দুই টাকা। আমাদের গণিত করার জন্য প্রতিদিনই এক দিস্তা করে নিউজপ্রিন্ট কাগজ কিনতে হতো। এভাবেই আমরা একেকজন অংকের জাহাজ–স্পিডবোট হয়ে উঠেছিলাম।

আরও পড়ুন

অংকের আরও একজন স্যার ছিলেন। নাম মোহাম্মদ আখতার হোসেন। আমরা বলতাম আখতার স্যার। উনার কাছে আমার গণিত পড়া হয়নি কিন্তু নামে উনাকে চিনতাম। পরে পরিচয় হলো উচ্চমাধ্যমিক ফাইনাল পরীক্ষার হলে। অংক পরীক্ষা চলছে। আমি একটা একটা করে অংক করে আশেপাশের সব বন্ধুদের দেখিয়ে দিচ্ছি কীভাবে করতে হবে। ওরা যতক্ষণ টুকে না নিচ্ছে ততক্ষণ আমি খাতা রিভাইস দেওয়ার ভান করছি। আখতার ব্যাপারটা লক্ষ্য করছিলেন। কিছুক্ষণ পরে আমাদের সারির পাশে এসে জোর গলায় বললেন, বাপুরা দেখাদেখি করছো ভালো কথা, কিন্তু মনে রেখো জীবনটা একটা প্রতিযোগিতা। এখানে একজন অন্যজনকে টপকিয়ে যাবার চেষ্টারত। এই পরীক্ষার নম্বর থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা সর্বোপরি বিয়ের বাজারেও কিন্তু প্রতিযোগিতা বিদ্যমান। তাই যা করবা ভেবেচিন্তে করবা। স্যারের কথা শুনে আমি অবজ্ঞার হাসি দিলাম এবং যা করতেছিলাম সেটাই চালিয়ে গেলাম। অবশ্য তার ফলাফলও হাতেনাতে পেয়েছিলাম। পরে আখতার স্যার হয়ে উঠেছিলেন আমার আরও একজন অভিভাবক, যাঁর স্নেহপূর্ণ ছায়া এখনো আমার মাথার ওপর বিদ্যমান।

লেখক
ছবি: সংগৃহীত

আমাদের শিক্ষকেরা প্রকৃত অর্থেই ছিলেন একেকজন জীবন গড়ার কারিগর। তাই আমাদের উচিৎ সারাজীবনই তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা। যদিও উনারা আমাদের সম্মান বা ভালোবাসার মুখাপেক্ষী নন। কারণ, এই দায়িত্বটা উনারা অন্তরের তাগিদ থেকেই পালন করেছিলেন। পরিশেষে আমাদের সব শিক্ষকের সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করছি।  প্রথম আলোকে ধন্যবাদ এমন একটি উদ্যোগ নেয়ার জন্য। শিক্ষক দিবসের অসিলায় স্যারদের সঙ্গে আবারও কথা হলো। কারণ, তাঁদের কারও ছবিই আমার সংগ্রহে ছিল না। কতশত স্মৃতিচারণা হলো সেই সঙ্গে। তুলনামূলক আলোচনা হলো তখনকার দিনের এবং এখনকার দিনের শিক্ষক-ছাত্রছাত্রী সম্পর্ক নিয়ে। এক অকৃত্রিম ভালোলাগায় মনটা ভরে গেল।

আরও পড়ুন