সুইডেনের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় সেবা যেভাবে মেলে
সুইডেনের স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা বিশ্বের অন্যতম সেরা ও উন্নত ব্যবস্থাগুলোর একটি হিসেবে বিবেচিত হয়। এটি সর্বজনীন, ন্যায্য এবং করভিত্তিক (tax-funded) একটি সেবাব্যবস্থা, যা দেশের প্রতিটি নাগরিকের জন্য সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী। সুইডেনের নাগরিকেরা সরকার পরিচালিত স্বাস্থ্যসেবা লাভ করেন নামমাত্র খরচে। দেশের ২১টি কাউন্টি কাউন্সিল ও অঞ্চল এই সেবা পরিচালনা করে। প্রধান সেবা যেমন হাসপাতাল, প্রাথমিক চিকিৎসাকেন্দ্র ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসাসেবাগুলো সরকারি খাতে ব্যবস্থা করা হয়। এ ছাড়া কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও সরকারের সঙ্গে চুক্তিভিত্তিক সেবা দেয়। শিশু ও গর্ভবতী নারীদের জন্য অধিকাংশ সেবা সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে।
অর্থাৎ, সুইডেনে স্বাস্থ্যসেবা সবার জন্য সহজলভ্য, ন্যায্য এবং মানসম্পন্ন। সুইডেনের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবসা নয়, একটি সেবা।
১. সর্বজনীন সেবা
সুইডেনে বসবাসকারী সব ব্যক্তি, নাগরিক হোক বা দীর্ঘমেয়াদি বাসিন্দা, তাঁরা এই স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার অধীনে সেবা পাওয়ার অধিকার রাখেন। এটি একটি নির্বাচনী অধিকার নয় বরং মৌলিক অধিকার হিসেবে বিবেচিত।
২. অর্থায়ন ও প্রশাসন
স্বাস্থ্যসেবার মূল অর্থ সরকার সরবরাহ করে, যা মূলত জনগণের পরিশোধ করা কর থেকে আসে। সুইডেনের ২১টি কাউন্টি কাউন্সিল বা রিজিওন এই সেবার তদারকি ও পরিচালনার দায়িত্বে থাকে। তারা হাসপাতাল, ক্লিনিক, স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসাসেবা প্রদান করে থাকে।
৩. প্রাথমিক ও বিশেষজ্ঞ সেবা
প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা সাধারণ রোগব্যাধির জন্য পরিবারিক চিকিৎসক বা জিপির (জেনারেল প্র্যাকটিশনার) মাধ্যমে রোগী প্রথমে সেবা পান। প্রয়োজনে রোগীদের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে রেফার করা হয়। হাসপাতালে ভর্তি, অস্ত্রোপচার বা জটিল রোগের চিকিৎসা সরকার নির্ধারিত খরচে পাওয়া যায়।
৪. সেবার খরচ
সুইডেনে স্বাস্থ্যসেবা সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে নয়, তবে খুবই কম খরচে পাওয়া যায়। রোগীকে সাধারণত একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ সহনীয় ফি, রোগীর ফি (কো–প্যামেন্ট) দিতে হয়। তবে এক বছরের মধ্যে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা ব্যয় হলে (যেমন প্রায় সেক ১৩০০ পর্যন্ত), তারপর পরবর্তী সেবাগুলো ফ্রি হয়ে যায়। শিশু ও ২০ বছরের নিচের ব্যক্তিদের জন্য অধিকাংশ সেবা সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে।
৫. বেসরকারি খাত
সুইডেনে কিছু বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক থাকলেও তাদের অধিকাংশই সরকার অনুমোদিত এবং সরকারি অর্থায়নে চলে। অর্থাৎ রোগীরা সরকার-নির্ধারিত ফি দিয়েই সেসব প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসা পেতে পারেন।
৬. চিকিৎসা মান ও প্রযুক্তি
সুইডেনের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা আধুনিক প্রযুক্তি ও দক্ষ জনবল দ্বারা পরিচালিত হয়। রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা, পুনর্বাসন ও স্বাস্থ্য সচেতনতায় সুইডেন অনেক দূর এগিয়ে আছে।
৭. প্রসূতিসেবা
সুইডেনের প্রসূতিসেবা অত্যন্ত উন্নত, নিরাপদ ও কাঠামোবদ্ধ। গর্ভবতী মা ও নবজাতক শিশুর যত্নে এই দেশ একটি আন্তর্জাতিক মডেল।
*মূল বৈশিষ্ট্যগুলো
বিনা মূল্যে সেবা: গর্ভাবস্থায় নারীরা প্রসূতিসেবা পুরোপুরি বিনা মূল্যে পান। এর মধ্যে রয়েছে স্বাস্থ্য পরীক্ষা, আলট্রাসাউন্ড, পরামর্শ ও প্রসবকালীন চিকিৎসা।
মিউওয়াইফ: গর্ভাবস্থায় নারীদের মূলভাবে পরিচর্যা করেন একজন প্রশিক্ষিত মিডওয়াইফ, যিনি মা ও শিশুর স্বাস্থ্যের নিয়মিত মূল্যায়ন করেন।
রুটিন চেকআপ: গর্ভাবস্থায় প্রায় ৮ থেকে ১০ বার চেকআপ হয়, যার মধ্যে অন্তত একবার আলট্রাসাউন্ড করা বাধ্যতামূলক।
প্রসবসেবা: সন্তান জন্মদানের সময় মা একটি সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হন এবং সেখানে ডাক্তার ও মিডওয়াইফদের তত্ত্বাবধানে প্রসব সম্পন্ন হয়।
প্রসব–পরবর্তী সেবা: মা ও শিশুর জন্য সন্তান প্রসব-পরবর্তী যত্ন দেওয়া হয়। যেমন বুকের দুধ খাওয়ানোর পরামর্শ, শিশুর ওজন পরীক্ষা ও মানসিক সাপোর্ট।
পিতৃত্বকালীন ছুটি: মা ও বাবাকে পর্যাপ্ত ছুটি দেওয়া হয়। উভয়েই মোট ৪৮০ দিন পর্যন্ত বেতনসহ ছুটি পান।
৮. মানসিক স্বাস্থ্যসেবা
সুইডেন মানসিক স্বাস্থ্যকে শারীরিক স্বাস্থ্যের মতোই গুরুত্ব দিয়ে দেখে। অবসাদ, উদ্বেগ, আসক্তি বা শিশু-কিশোর মানসিক সমস্যা, সবকিছুর জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সেবা আছে।
*পরিষেবাসমূহ
প্রাথমিক সহায়তা: সাধারণত হালকা উদ্বেগ বা বিষণ্নতার জন্য জিপি বা প্রাথমিক চিকিৎসাকেন্দ্র থেকে শুরু হয় চিকিৎসা।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসা: গুরুতর মানসিক সমস্যার ক্ষেত্রে রেফার করা হয় সাইকিয়াট্রিস্ট বা ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টের কাছে।
থেরাপি ও কাউন্সেলিং: কগনিটিভ বিহ্যাভিওরাল থেরাপি (সিবিটি), সাইকোথেরাপি ও অন্যান্য থেরাপি সরকার-নির্ধারিত সহনীয় ফি-তে পাওয়া যায়।
শিশু ও কিশোর সেবা: শিশু-কিশোরদের জন্য আলাদা মানসিক স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ রয়েছে।
জরুরি মানসিক সেবা: মানসিক বিপর্যয় বা আত্মহত্যার ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিদের জন্য ২৪/৭ জরুরি সেবা পাওয়া যায়।
৯. ওষুধের খরচ
সুইডেন সরকার সাধারণ ওষুধের খরচ নিয়ন্ত্রণ করে এবং রোগীদের অর্থনৈতিক সুরক্ষা দেয়।
*High-cost protection: রোগীর এক বছরে মোট ওষুধের খরচ যদি প্রায় ২ হাজার ৬০০ সুইডিস ক্রোনার বেশি হয়, তাহলে বাকিটা সরকার বহন করে এবং রোগী পরবর্তী সময়ে বিনা মূল্যে ওষুধ পেতে থাকে।
ছাড় মূল্যে ওষুধ: বেশির ভাগ ওষুধ সরকার অনুমোদিত তালিকাভুক্ত ফার্মেসিতে ডিসকাউন্টে পাওয়া যায়।
ইলেকট্রনিক প্রেসক্রিপশন: ডাক্তারদের দেওয়া ইলেকট্রনিক প্রেসক্রিপশন সরাসরি ফার্মেসিতে পাঠানো হয়, রোগী শুধু পরিচয় দিয়ে ওষুধ সংগ্রহ করতে পারেন।
বয়স্ক ও শিশুদের জন্য সুবিধা: ১৮ বছরের নিচের শিশুদের জন্য সব প্রয়োজনীয় ওষুধ সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে প্রদান করা হয়। এ ছাড়া বয়স্ক ও দীর্ঘমেয়াদি রোগীদের জন্য অতিরিক্ত ছাড় দেওয়া হয়।
উপসংহার
সুইডেনে স্বাস্থ্যসেবার প্রতিটি দিক—প্রসূতি যত্ন, মানসিক স্বাস্থ্য এবং ওষুধ—এমনভাবে গঠিত যে সব নাগরিক স্বাস্থ্যগত ন্যায়বিচার ও নিরাপত্তা পায়। সরকার এসব সেবায় শুধু বিনিয়োগই করে না, বরং জনগণকে সচেতন, আত্মনির্ভর ও স্বাস্থ্যবান রাখতে কাজ করে। সুইডেনের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা এমনভাবে তৈরি হয়েছে যাতে প্রত্যেক নাগরিক সমানভাবে মানসম্পন্ন ও সহজলভ্য চিকিৎসাসেবা পেতে পারে। এটি স্বাস্থ্যক্ষেত্রে সমতা, ন্যায় এবং মানের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
*লেখক: কামরুল ইসলাম, অবসরপ্রাপ্ত সুইডিশ সরকারি নির্বাহী কর্মকর্তা; বর্তমানে শিক্ষকতা করছেন।
‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]