সুইডিশ পাবলিক সার্ভিস: স্বাধীন ও জবাবদিহিমূলক গণমাধ্যমের বৈশ্বিক আদর্শ
বিশ্বব্যাপী যখন গণমাধ্যম স্বাধীনতা হুমকির মুখে, তখন সুইডেনের পাবলিক সার্ভিস সম্প্রচার প্রতিষ্ঠানগুলো—সুইডিশ টেলিভিশন (SVT), সুইডিশ রেডিও (SR) এবং শিক্ষামূলক রেডিও (UR)—একটি শক্তিশালী, স্বাধীন এবং গণতন্ত্র-সহায়ক গণমাধ্যম কাঠামোর উদাহরণ হিসেবে উঠে এসেছে। এ প্রতিষ্ঠানগুলো আইন দ্বারা সুরক্ষিত, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত এবং সরাসরি জনগণের কাছে জবাবদিহিমূলক। ফলে সুইডেনের পাবলিক সার্ভিস মডেল বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যমের জন্য একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত।
বাংলাদেশের গণতন্ত্র এবং রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কারের কথা যখন চলছে, তখন সেটাকে টেকসই করার জন্য বাংলাদেশে সুইডেনের আদলে একটি পাবলিক সার্ভিস সংগঠন আইন করে গড়ে তোলার প্রয়োজন পড়েছে। সুইডেনের পাবলিক সার্ভিসের কাঠামো এবং আইনের ভিত্তি নিয়ে কিছু ধারণা দেওয়া হলো এখানে। চ্যাটজিপিটির সাহায্যে তথ্যগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে।
আইনি ভিত্তি ও গণতান্ত্রিক ম্যান্ডেট
সুইডিশ পাবলিক সার্ভিস মিডিয়া পরিচালিত হয় রেডিও ও টেলিভিশন আইন (Radio and Television Act, 2010:696) অনুযায়ী। এ ছাড়া রিকসদাগ (সুইডিশ সংসদ) প্রতি আট বছরে একবার করে পাবলিক সার্ভিস রেমিট (চুক্তি) প্রকাশ করে, যেখানে নির্ধারণ করা হয় প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্ব ও কর্তব্য। এই আইন অনুযায়ী, পাবলিক সার্ভিস মিডিয়াকে অবশ্যই নিরপেক্ষ, তথ্যভিত্তিক ও বহুমাত্রিক কনটেন্ট সরবরাহ করতে হবে এবং সব শ্রেণির নাগরিককে সমানভাবে সেবা দিতে হবে, তা তিনি যেকোনো মতাদর্শ, ভাষা বা অবস্থানের হোন না কেন।
আইন অনুযায়ী পরিষ্কার বলা আছে: ‘কোনো সরকারি কর্তৃপক্ষ কোনো সম্প্রচারের বিষয়বস্তুতে হস্তক্ষেপ বা প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না।’ এই ধারাই সুইডিশ পাবলিক সার্ভিসের রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করে।
রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত অর্থায়ন
২০১৯ সাল থেকে, সুইডেনে প্রচলিত টিভি লাইসেন্স ফি বাতিল করে কর-ভিত্তিক পাবলিক সার্ভিস ফি চালু করা হয়েছে। এই অর্থ একটি স্বাধীন ফাউন্ডেশন— Förvaltningsstiftelsen för SR, SVT och UR-এর মাধ্যমে পরিচালিত হয়, যা রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থেকে আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। এই মডেলটি সুইডিশ পাবলিক সার্ভিসকে বাণিজ্যিক চাপ এবং রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত রেখে, সাংবাদিকতার মান বজায় রাখতে সহায়তা করে।
জবাবদিহি আছে, কিন্তু রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ নেই
পাবলিক সার্ভিস মিডিয়া রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থেকে সুরক্ষিত হলেও তারা জনগণের কাছে সম্পূর্ণ জবাবদিহিমূলক। তারা যে নিরপেক্ষতা ও বৈচিত্র্য বজায় রাখছে, তা জনগণই নিশ্চিত করতে পারে।
‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
নাগরিকেরা কীভাবে হস্তক্ষেপ করতে পারেন
১. অভিযোগ দাখিল
কোনো সম্প্রচারে পক্ষপাত, তথ্যগত ভুল বা আইন লঙ্ঘন হলে, যে কেউ সুইডিশ প্রেস ও ব্রডকাস্টিং অথরিটি (Myndigheten för press, radio och tv) বরাবর অভিযোগ করতে পারেন।
২. সরাসরি মতামত প্রদান
SVT, SR ও UR-এর নিজস্ব ওয়েবসাইটে রয়েছে অভিযোগ বা প্রতিক্রিয়া জানানোর সুযোগ। অনেক সময় সেই প্রতিক্রিয়ার ভিত্তিতে পরিবর্তন আনা হয়।
৩. বার্ষিক প্রতিবেদন ও সংসদীয় পর্যালোচনা
তিনটি প্রতিষ্ঠানই প্রতিবছর বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যেখানে কর্মদক্ষতা, দর্শক পরিসংখ্যান এবং রেমিট পূরণের অগ্রগতি তুলে ধরা হয়। এই প্রতিবেদন সংসদে জমা দেওয়া হয় এবং সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকে।
৪. সংসদীয় শুনানি ও নাগরিক পরামর্শ
মাঝেমধ্যে সংসদে উন্মুক্ত শুনানির মাধ্যমে পাবলিক সার্ভিস পরিচালকদের প্রশ্ন করা হয়, যেখানে নাগরিকদের মতামতও গুরুত্ব পায়। তবে এসব প্রক্রিয়ায় কোনো রাজনৈতিক দল বা সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর কনটেন্টে হস্তক্ষেপ করতে পারে না।
সবার জন্য, শুধুই সংখ্যাগরিষ্ঠের জন্য নয়
সুইডিশ পাবলিক সার্ভিসের মূলনীতিই হলো সর্বজনীনতা। এটি জাতিগত সংখ্যালঘুদের ভাষায় যেমন সামি, ফিনিশ, রোমানি চিব, ইয়িদ্দিশ ও মিয়াঙ্কেলি, তেমনই শ্রবণ ও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য স্বয়ংক্রিয় সাবটাইটেল ও সাইন ল্যাঙ্গুয়েজের মাধ্যমে কনটেন্ট সরবরাহ করে। তারা শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান, তদন্তমূলক সাংবাদিকতা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং শিশু-কিশোরদের জন্য কনটেন্টে বিনিয়োগ করে, যা বাজারচালিত বাণিজ্যিক মিডিয়ায় প্রায় অনুপস্থিত।
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও দেশীয় চ্যালেঞ্জ
Reporters Without Borders এবং Reuters Institute-এর মতে, সুইডেন বিশ্বে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সাংবাদিকতার ওপর বিশ্বাসের ক্ষেত্রে শীর্ষে। SVT ও SR-এর প্রতি জনগণের আস্থা ইউরোপে সর্বোচ্চ। তবে সবকিছু নিখুঁত নয়। কিছু রাজনৈতিক দল পাবলিক সার্ভিসের পরিধি কমানো ও বাজেট কাটছাঁট করার দাবি তুলেছে। তবে শক্তিশালী আইন, স্বাধীন তহবিল ব্যবস্থা এবং জনগণের সমর্থনের কারণে এ প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো টিকে আছে এবং কাজ করে যাচ্ছে।
একটি রক্ষাযোগ্য গণমাধ্যম মডেল
যেখানে গণতন্ত্র দুর্বল, ভুল তথ্য ছড়ানো সহজ এবং বাণিজ্যিক চাপ বেশি, সেখানে সুইডিশ পাবলিক সার্ভিস দেখিয়ে দেয় কীভাবে একটি স্বাধীন, সবার জন্য উপযোগী এবং জবাবদিহিমূলক গণমাধ্যম ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়। তাদের সাফল্যের চাবিকাঠি শুধু আইন নয়, বরং নাগরিকদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও গণমাধ্যমকে গণতন্ত্রের অন্যতম স্তম্ভ হিসেবে দেখার দৃষ্টিভঙ্গিও।
জনগণের জন্য সংস্থান
SVT দর্শক পরিষেবা
SR যোগাযোগ
সুইডিশ প্রেস ও ব্রডকাস্টিং অথরিটি (MPRT)
লেখক: কামরুল ইসলাম, স্টকহোম, সুইডেন, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি নির্বাহী কর্মকর্তা; বর্তমানে শিক্ষকতা করছেন