ছেলে বন্ধু এবং প্রযুক্তি শিক্ষা: সমতা বিশ্বাসঘাতক ও ক্ষমতায়ন
আপনাদের আজ একটি নতুন ধারণার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব। ধারণাটি হলো, ‘ইকুয়ালিটি বিট্রেয়ার’ (Equality Betrayer), যেটাকে বাংলায় বলা যেতে পারে ‘সমতা বিশ্বাসঘাতক’! এই ধারণা নিয়ে আমি ২০ বছর ধরে বিভিন্ন ধরনের মডেল তৈরি করছি, কিন্তু কখনো প্রকাশ করিনি। আমি একটি সঠিক সময় ও সঠিক প্ল্যাটফর্মের অপেক্ষায় ছিলাম। প্রথম আলোকে ধন্যবাদ আমাকে লেখার সুযোগ দেওয়ার জন্য।
সময়টা হচ্ছে ১৯৯৭ সাল, তত দিনে ব্যবসায় প্রশাসন ছাড়া আমাদের প্রায় সব পড়ালেখা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিভিত্তিক হয়ে গেছে। তখন বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মতো খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় সুযোগ পাওয়া আর হাতে চাঁদ পাওয়া ছিল যেন এককথা। আমি পরিবেশবিজ্ঞানে ভর্তি হওয়ার পর জানতে পারলাম, সারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলে ও মেয়ের আনুপাতিক সংখ্যা ৬০০: ৩০। অথচ কী মজার ব্যাপার, আমাদের বিভাগে সবচেয়ে বেশি মেয়ে ভর্তি হলো, ছেলেদের সঙ্গে যার অনুপাত ছিল ২৪: ৬! সংখ্যার পার্থক্য অনেক বেশি হওয়ায় ছেলেদের কাছে মেয়েরা ডুমুরের ফুল হয়ে উঠল। প্রথম বর্ষের প্রথম সেমিস্টার পার হওয়ার আগে সবাই প্রেমে জড়িয়ে গেল, দু–একজন বাদে। চারপাশ থেকে শুনতে পাচ্ছিলাম, একটা ছেলে বন্ধু না থাকলে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে চার বছর পাড়ি দেওয়া কঠিন।
দেখা গেল, একেকটা মেয়ে প্রেমে পড়ছে আর কিছুদিনের মধ্যেই ক্লাসের অন্য সবার সঙ্গে আস্তে আস্তে সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেলছে, যাতে ভালোবাসার আড়ালে তার অ্যাসাইনমেন্টের ‘ধান্ধা’ কেউ ধরতে না পারে! সম্পর্ক আরেকটু সামনে গড়ালে তখন মেয়েটি প্রেমিককে তার বন্ধুদের থেকেও আলাদা করে ফেলে, যাতে ছেলেটি পুরো সময় তার পড়ালেখার যাবতীয় ফটোকপি, নোট সংগ্রহ, ক্যাফেতে খাবারের চেয়ার দখল, ডাক্তার–কবিরাজের কাছে দৌড়ানো পর্যন্ত সব কাজেই ছায়াসঙ্গী হয়ে ওঠে।
তুলনামূলক কৌশলী বা চালাক মেয়েরা অবশ্য বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতিকে প্রেম বলে জাহির করে। এ ধরনের মেয়েরা শিক্ষকের দরজা কিংবা ডিপার্টমেন্টের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে, আর তার অ্যাসাইনমেন্ট বা নোট নিয়ে প্রেমিক ছেলেটি দৌড়াতে দৌড়াতে আসে। আমাদের সময় কম্পিউটার ও ইন্টারনেট–সুবিধা ছিল সীমিত। আমাদের কাছাকাছি যে জায়গাটায় এই সুবিধা ছিল, সেটির নাম ময়লাপোঁতা, যেখান থেকে আসতে–যেতে এক থেকে দেড় ঘণ্টা লেগে যেত। যতই দিন যায়, ছেলেটি ততই নাওয়া–খাওয়া ভুলে মেয়েটিকে অ্যাসাইনমেন্ট ও নোট–সেবা দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। অন্যদিকে নিজে ক্লাসের তীব্র প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে। তার চেয়ে মেয়েটির ফলাফল ভালো হয়।
তৃতীয় বর্ষে আবার নতুন ঘটনার জন্ম। এ সময় অনেক মেয়ে স্কলারশিপ বা বৃত্তি নিয়ে বিদেশে যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা আছে, এমন ছেলেকে টার্গেট করে। তারা সময়–সুযোগ বুঝে চোখ উল্টিয়ে সামনে উড়াল দেয়, আর ক্লান্ত প্রেমিক পেছনে পড়ে থাকে। যাওবা দু–একটি প্রেম বিয়ে পর্যন্ত গড়ায়, সে ক্ষেত্রে ছেলেটি বৃত্তি পাওয়া ও উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে পারে না। এ রকম ছদ্মবেশী ভালোবাসাকে ঘিরেই আমার আজকের ‘ইকুয়ালিটি বিট্রেয়ার’ বা ‘সমতা বিশ্বাসঘাতক’ গল্পের শুরু, যার কেস স্টাডি শুনুন।
‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
আমাদের ক্লাস শুরু হওয়ার পরপরই একটি বন্ধু বেশ ভালো করছিল এবং আমরা সবাই তাকে উৎসাহ দিতাম। কিন্তু এই উৎসাহ আর থাকল না, যখন তাকে আমাদের ক্লাসেরই একটি মেয়ে প্রেমের বন্ধনে জড়িয়ে ফেলল। সেই মেয়েটি অন্য মেয়েদের সঙ্গে এই বন্ধুর কথা বলা ও যোগাযোগ বন্ধ করিয়ে দিল। তবে আমার সঙ্গে ছেলেটির মোটামুটি কথা হতো। অন্যদের মতো সে–ও মাঝেমধ্যে আমাদের বাসায় আসত। হঠাৎ আমি আবিষ্কার করলাম, ছেলেটি এবার আমাকেও এড়িয়ে চলছে। অন্যদিকে মেয়েটির হাবভাবে মনে হলো, এটাকে সে বাজিমাত ভাবছে। আমি চুপচাপ থাকলাম এবং পর্যবেক্ষণের সিদ্ধান্ত নিলাম। মেয়েটির ‘অমানবিক অত্যাচারে’ আর অহেতুক মাতবরির কারণে ছেলেটি আর প্রথম বর্ষের শেষ দিকে ভালো ফলাফল করতে পারল না। আমি তখন মেয়েটির বাজিমাতের বিভিন্ন ধরন দেখে, আর তার উদ্দেশ্য কী, তা বোঝার চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম। একদিন বিকেলে হঠাৎ ছেলেটি আমার বাসায় এল। আমি তখন টিভি দেখছিলাম। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ছেলেটি অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল। আমি নিরুপায় হয়ে সবাইকে ডাকাডাকি করে কোনো রকমে তাকে বিছানায় উঠিয়ে পানি ছিটা দিয়ে হুঁশ ফেরালাম। বলার অপেক্ষা রাখে না যে প্রেম ও পরীক্ষা—দুটোতে ব্যর্থতার কারণেই ছেলেটির এমন হাল হয়েছে…
যা–ই হোক, মেয়েটি যখন দেখল, তার প্রথম টার্গেট ব্যর্থ হয়েছে, তখন সে ফোকাস করল দ্বিতীয় টার্গেটে। এই ছেলেও পড়ালেখায় ওপরের দিকে ছিল। কিছুদিনের মধ্য সে–ও সবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। তার ভাবসাবে মনে হলো, এই মেয়েকে পেয়ে সে বিশ্ব জয় করে ফেলেছে! কিন্তু আমরা চতুর্থ বর্ষে ওঠার পর দেখা গেল, ছেলেটির জায়গা প্রথম সারি থেকে অনেক পেছনে। আমার ওই বান্ধবী এই ছেলেকেও আগেরটির মতো একই কায়দায় ছুড়ে ফেলেছে। এ ক্ষেত্রে মেয়েটির মায়ের কারসাজি বা হাত ছিল বলে তখন শোনা গিয়েছিল, যিনি কিনা পেশায় একজন কলেজশিক্ষক।
বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের সহপাঠী দুই বন্ধুর সঙ্গে ঘটে যাওয়া এ দুটি অমানবিক ঘটনায় আমি মানসিকভাবে খুব আঘাত পেয়েছি। আমার মধ্যে একধরনের ফোবিয়া দেখা দেয়। কোনো ছেলের সঙ্গে আমার একটু আলাপ জমে উঠলে যখন দেখি বিষয়টা অন্য দিকে মোড় নিচ্ছে, তখন আমি পালিয়ে আসি।
বাংলাদেশে দেখা এ ধরনের ঘটনা অস্ট্রেলিয়াতেও প্রত্যক্ষ করলাম। সে দেশের যে সুপারভাইজারের কাছে পিএইচডি শুরু করলাম, তিনি আর তাঁর পার্টনার পাশাপাশি রুমে অফিস করেন। কিছুদিন পর লক্ষ করলাম, আমি যখন সুপারভাইজারের রুমে প্রবেশ করি, সেটা ওই মেয়ে খুব খেয়াল করেন এবং কিছুক্ষণ পরে রুমে ঢুকে আমার সুপারভাইজারের সঙ্গে চেঁচামেচি শুরু করেন। মেয়েটি ঢের সুন্দরী হওয়ার পরও কেন আমার মতো সাদামাটা একটি মেয়েকে নিয়ে ও রকম ভাবতে শুরু করলেন, বুঝলাম না।
আমার নিরীহ শিক্ষকটি তাঁর পার্টনারের সব ধরনের ই–মেইল, প্রোজেক্ট, কনফারেন্স করে দেন। তারপরও যেন তাঁর রেহাই নেই। আগাগোড়া ফরসা মানুষটি পার্টনারের অত্যাচারে নীল হয়ে যেতেন। এতে খুব খারাপ লাগত। তাই গুরুকে বাঁচানোর দায় নিজের কাঁধে তুলে নিলাম। আমি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রথম বছরের কনফার্মেশন সেমিনারের তিন মাস আগে আমার এই মহান শিক্ষককে মুক্তি দিলাম। কিন্তু আমি নিজে মানসিক চাপে বাইপলারে আক্রান্ত হলাম। অন্যদিকে আমার কনফার্মেশনের পর অসদাচারণের অভিযোগে মেয়েটির চাকরি গেল।
আমি এতক্ষণ আপনাদের তিনটি কেস স্টাডি বলেছি ইকুয়েলিটি বিট্রেয়ার বা সমতা বিশ্বাসঘাতক ধারণাটি দেওয়ার জন্য। গবেষণায় নতুন তত্ত্বের ধারণা তৈরির জন্য কেস স্টাডি অ্যানালাইসিস দিয়ে শুরু করতে হয়।
নারীর ক্ষমতায়নবিষয়ক গবেষণায় বিভিন্ন ধরনের ধারণা আছে। যেমন জেন্ডার ইকুয়েলিটি বা লিঙ্গসমতা, ফেমিনিজম বা নারীবাদ, উইমেন রাইট বা নারীর অধিকার, সোশ্যাল ইনজাস্টিস বা সামাজিক অবিচার ইত্যাদি। কিন্তু ইকুয়েলিটি বিট্রেয়ার বা সমতা বিশ্বাসঘাতক সেই অর্থে এখনো গবেষণায় আসেনি। এখন আমি আপনাদেরকে দেখাব এর প্র্যাকটিক্যাল ইমপ্লিকেশন বা ব্যবহারিক প্রভাব।
হিলারি ও যুক্তরাষ্ট্রের ২০০৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন—
হিলারি ক্লিনটনের স্বামী বিল ক্লিনটন ক্ষমতায় থাকাকালে মনিকা লিউনস্কি নামের এক তরুণীর সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন। আমেরিকার মতো সুশিক্ষিত এবং সমতার দেশেও নারীটি (হিলারি) ঠিক তাঁর স্বামীর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করলেন না। বরং স্বামীর নামের শেষের পদবীই ব্যবহার করে নিজে কীভাবে আমেরিকার প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হবেন, সে জন্য উদ্গ্রীব হয়ে ওঠেন তিনি। সে জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালান তিনি। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার জন্য তিনি এমনকি মিটিং–মিছিলে মেয়ে ও তাঁর জামাইকে নিয়ে নির্বাচনী প্রচারে নামেন। কিন্তু কস্ট–বেনিফিট বা লাভ–ক্ষতির চুলচেরা বিশ্লেষণে দক্ষ আমেরিকান ছেলেরা হিলারির উদ্দেশ্য ধরতে পেরেছিলেন এবং তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেন। তাঁরা কালোমানিক বারাক ওবামাকে বেছে নেন।
আমাদের গরিব দেশের ভালোবাসার রঙিন চশমা পরা ছেলেরা সমতা জালিয়াতির গবেষণা এখনো করে উঠতে বা বিষয়টি ধরতে পারেননি। এ কারণে আমাদের সংস্কৃতির অনেক মেয়ে বিশ্বাসঘাতকতা করে সহজেই নিজেদের আখের গুছিয়ে নেওয়ার সুযোগ পান। তাদের মতো না হয়েও ব্যক্তিজীবনে নিজের চেষ্টায় সফলতা অর্জন করতে পেরেছি বলে নিজেকে নিয়ে খুব গর্ব হয়। তবে আফসোস হচ্ছে আমার দেখা প্রেমপিয়াসী বোকা ও সুবোধ ছেলেদের জন্য, যদিও তাদের জীবনের গল্পগুলো আমাকে গবেষণার পথে এগিয়ে নিয়েছে!
লেখক: শাহিদা খানম, বোর্ড মেম্বার, প্রকৃতি সংরক্ষণের জন্য আন্তর্জাতিক ইউনিয়ন, কানাডা।