বন্ধন নাকি অলসতা: কোনটি পরিবার ভাঙার জন্য দায়ী?

‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

প্রতীকী ছবিএআই

আজকের লেখাটি আমি লিখছি একটি বিশেষ কারণে, যেটি পারিবারিক ক্ষমতায়নের সঙ্গে সম্পর্কিত। আজকাল খবর অথবা ইউটিউব খুললেই দেখা যাচ্ছে, পরিবার ভেঙে যাচ্ছে এবং মা–বাবারা বৃদ্ধাশ্রমে কান্নাকাটি করছেন। অধিকাংশ খবরে মা–বাবার সাক্ষাৎকার নিলেও ছেলে–মেয়ের কথা তেমন কেউ শুনছেন না! এ নিয়ে অনেক ধরনের অনুসন্ধান ও গবেষণা আছে। যেমন নগরায়ণ, দারিদ্র্য, পশ্চিমীকরণ, নারীর ক্ষমতায়ন এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ভূমিকা।

উল্লিখিত কারণগুলোর বাইরে আমি আরেক ধরনের সমস্যা নিয়ে পড়ালেখা করছিলাম, যেটা হচ্ছে অলসতা। আমি মোটাদাগের একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণা (Madsen, 2018) থেকে অলসতার একটি ধারণা উল্লেখ করছি, যাতে আমাদের বিষয়টি বুঝতে সহজ হয়।

“Laziness as a negative term referring to people who do not show an effort corresponding to their abilities and/or prerequisites, and/or the difficulty of the task in question (অলসতা একটি নেতিবাচক শব্দ, যা এমন লোকদের বোঝায়, যারা তাঁদের ক্ষমতা এবং/ অথবা পূর্বশর্তগুলোর সঙ্গে সংগতিপূর্ণ প্রচেষ্টা দেখান না, এবং/ অথবা প্রশ্নে থাকা কাজের অসুবিধাও দেখান না।)

প্রসঙ্গত, সংবাদপত্রে লেখার জন্য জার্নাল নিবন্ধের (Journal Article) মতো রেফারেন্স দিতে হয় না, তারপরও আমি উল্লেখ করলাম, যাতে সাধারণ মানুষ গবেষণার ধরনের সঙ্গে নিজেদের চিন্তার সমন্বয় করতে পারেন। বিশেষ করে Cultural Heritage (সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য) সম্পর্কিত এজেন্ডা।

আমি ছোটবেলা থেকে শুনে এসেছি, বাংলাদেশিরা অলস জাতি এবং আমাদের এই নিয়ে একধরনের আনন্দ আছে! গল্প, আড্ডায় আমরা এটা নিয়ে আলোচনা–সমালচনা করে সময় পার করতে পছন্দ করি। শুধু তা–ই নয়, আমরা একটি কৌতুক দাঁড় করেছি যে এক বাংলাদেশি বেহেস্তে গেলে আরেকজন টেনে নামায়। এই কৌতুকটা বলতে কারও লজ্জা হয় না, বরং হাতে তালি পড়ে! আমি যেহেতু Heritage (ঐতিহ্য) নিয়া গবেষণা করি, তাই শুরুটা করতে চাই পরিবার নিয়ে।

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় পড়ালেখা শেষ করে চাকরিতে যোগদান করতে বয়স ৩০ হয়ে যায় এবং কোনোমতে বয়স ৪০–এর ওপরে গেলে আমাদের বিবিধ ধরনের অজুহাত শুরু হয়ে যায়; এই যেমন শরীর চলে না, মনে রাখতে পারি না এবং আরও অনেক। বয়স আরেকটু বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চোখ পড়ে বড় ছেলেটার ওপর, ও কখন দায়দায়িত্ব নেবে? ওই ছেলেটি শুধু মা-বাবাকে দেখবে তা–ই নয়, তার যে আরও ভাই বোন আছে, তাদেরও দেখাশোনা করবে। সময়ের পরিক্রমায় বাবা অবসরে যান আর ছেলেটি বিয়ে করে সংসার মাথা পেতে গ্রহণ করেন।

বর্তমানে আমাদের প্রবীণেরা প্রায় ৭০–এর কাছাকাছি চলে–ফিরে থাকেন। কিন্ত অবসরে যাওয়ার পর এ মানুষগুলো সংসারের আর কোনো কাজ করতে চান না। প্রায়ই দেখা যায়, তাঁরা একটা দোলনা চেয়ারে বসে সংবাদপত্র পড়ছেন আর চা–কফির জন্য হুকুম করছেন। সময় যখন আরও গড়ায়, তখন তাঁদের অলসতা এবং নিরাপত্তাহীনতা আরও বেড়ে যায়। বাবা লোকটি তখন ছেলে আর ছেলের চাকরিজীবী বউয়ের টাকার হিসাব করতে থাকেন। তাঁদের সামান্য আনন্দ–উপভোগের মধ্যে ভাগ বসান, যদি তাঁর অন্য ছেলেমেয়েদের ভাগে কম পড়ে। মা মহিলাটি রান্না কিংবা ছেলের সন্তান দেখাশোনা করার জন্য কোনো সাহায্য করতে চান না।

বরং উনি তরকারিতে তেল–ঝোল নিয়ে দেনদরবার করতে পছন্দ করেন। আমাদের বাংলাদেশে, বিশেষ করে ঢাকায় এখন কাজের লোক পাওয়া দুষ্কর ও ব্যয়বহুল। স্বামী-স্ত্রীর আয় দিয়ে সংসার চালানোও কঠিন। এই চাকরিজীবী মেয়েরা পরিবারের অমানবিক চাপ নিতে নিতে একসময় আত্মসমর্পণ করেন। তাঁরা বাঁচার জন্য চুপিসারে নিজের পরিবারের পাশে বাসা ভাড়া নেন। ছেলেটি একসময় মেয়েটিকে অনুসরণ করেন আর যদি না পারেন, তাহলে বিদেশে চলে যান!! আমি আমার দীর্ঘ কর্ম ও প্রবাসজীবনে অনেক ছেলে–মেয়েকে দেখেছি, যাঁরা শুধু পারিবারিক অত্যাচারে দেশ ছেড়েছেন এবং দেশে যেতে একধরনের আতঙ্ক বোধ করেন। বলা বাহুল্য, আমাদের লেখাপড়ায় মেধা পাচারের অনেক ধরনের তত্ত্ব আছে, কিন্ত এই নির্মম সত্য খুঁজে পাওয়া কঠিন?

হুমায়ূন আহমেদের বই পড়ে এবং নাটক দেখে বড় হয়েছি। যেখানে দেখানো হতো মধ্যবিত্ত পরিবারের বড় ছেলেটার কোনো আনন্দ নেই। দিন–রাত গাধার মতো খেটে সংসার টানছেন আর মা-বাবা একধরনের তৃপ্তি বোধ করছেন। এই বড় ছেলের বউ–বাচ্চার কোনো ভবিষ্যৎ নেই, বরং সেই ‘এই সব দিনরাত্রি’ নাটকের মতো এদের বাচ্চারা বিনা চিকিৎসায় ক্যানসারে মারা যায়। হুমায়ূন আহমেদ নিজেও এই দলের মানুষ, যিনি অতি অল্প বয়সে বিধবা মায়ের ছয় সন্তানের হাল ধরেন। আমি দেখেছি, অল্প কিছু বই ছাড়া এই লোকটা কোনো টেলিভিশন, সোশ্যাল মিডিয়া অথবা সংবাদপত্রে তাঁর পারিবারিক কষ্ট নিয়ে খুব একটা সাক্ষাৎকার দিতেন না। সিনেমা ও নাটকে আমরা এই কষ্ট দেখে বুক ভাসাচ্ছি কিন্তু কোনো সমাধানের পথ খুঁজছি না। বরং একটা চক্রে আটকে আছি, সেটা হচ্ছে অলসতা ও অত্যাচার।

উন্নত বিশ্বে বয়সভিত্তিক অনেক অর্থনৈতিক, স্বেচ্ছাসেবী কাজ এবং বিনোদনের ব্যবস্থা আছে, যেখানে একজন মানুষ ১৫ থেকে ৮০–৮৫ বছর পর্যন্ত কর্মক্ষম ও সুস্থ জীবন জাপন করতে পারেন। আমি আশা করছি, আমাদের পরিবারের নেতারা তাঁদের সাংস্কৃতিক ও সমষ্টিগত ক্ষমতায়নের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করে দেখবেন, যাতে পরিবারের সবাই সমান ও পারস্পরিক ক্ষমতায়নের ব্যাপারে কার্যকর হন এবং পরিবার ভাঙার হাত থেকে রক্ষা পান। পরিবারভিত্তিক ক্ষমতায়নের ওপর নির্ভর করছে আমাদের বর্ধিত সমাজব্যবস্থা ও সাংস্কৃতিক ক্ষমতায়ন। উপরন্তু এই ক্ষমতায়নের জন্য জরুরি বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা ও প্রচার, যাতে বয়সভিত্তিক দক্ষতাকে টেকসই উন্নয়নের অন্তর্ভুক্ত করা যায়।

আমি আশা করছি, আমাদের জুলাই বিপ্লবের তরুণেরা বিশ্বসেরা গবেষণা ও নেতৃত্ব দিয়ে এই দেশ পাল্টে দেবেন। তাঁদের হাতে আছে আলাদিনের প্রদীপ নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ইউনূস, আবু সাঈদ, হুমায়ূন আহমেদ, জামিলুর রেজা চৌধুরী, স্যার ফজলে হাসান আবেদ, মুগ্ধ এবং আরও অনেকে। আমাকে সবাই পাগল বললেও আমি আশা ছেড়ে দিইনি। আমাদের দেশের মতো সোনার দেশকে সবাই অলস বলে গালি দেবে কেন?

আমি ঠিক করেছি, এই অপমান আমি কখনো গায়ে মাখব না এবং এই পরিবর্তনের পাল তোলা মাঝিদের আমি জীবন বাজি রেখে নেতৃত্ব দেব, যদি সুযোগ হয়..ইনশা আল্লাহ!

*লেখক: শাহিদা খানম, পিএইচডি, বোর্ড মেম্বার, প্রকৃতি সংরক্ষণের জন্য আন্তর্জাতিক ইউনিয়ন, কানাডা