গুরু–শিষ্য পরম্পরা এবং সাংস্কৃতিক ক্ষমতায়ন: আমার গুরুরা

প্রতীকী ছবি। এআই/প্রথম আলো

আজকে আমি ভাবছিলাম আমার ৪৭তম (১৯ জুন) জন্মদিন কীভাবে উপভোগ করব? আমি জন্মদিন পালন করা নিয়ে খুব একটা তালবেতাল বা হইহুল্লোড় করি না। বরং চুপচাপ থাকতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। কিন্তু আজকের পরিপ্রেক্ষিত সম্পূর্ণ ভিন্ন। জীবনের এই দীর্ঘ সময় যাঁরা আমাকে চড়াই–উতরাই পেরিয়ে এ পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন, তাঁদের কাছে আমার ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করাই এই লেখার উদ্দেশ্য। আমি শুরু করতে চাই, আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশের সেই প্রাচীন দর্শন গুরু–শিষ্য পরম্পরা দিয়ে, যার শিকড় ৫০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে এবং যেখানে গুরু একজন শিক্ষক এবং শিষ্য একজন ছাত্র, যে ধারণাটি এমন:

‘গুরু মৌখিকভাবে জ্ঞান শিক্ষার্থীর কাছে পৌঁছে দেন, এই ঐতিহ্যকে গুরু-শিষ্য পরম্পরা বলা হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গুরু ও শিষ্যের মধ্যে সম্পর্ক বিকশিত ও দৃঢ় হওয়ার পাশাপাশি গুরু থেকে শিষ্যের কাছে জ্ঞান প্রদান করা হয়, যতক্ষণ না শিষ্য তা আয়ত্ত করে। এই জ্ঞান শুধু প্রথাগত শিক্ষাই ছিল না, উপরন্তু আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক নৈতিকতার আদান-প্রদান ছিল, যেটা ক্ষমতায়নের জন্য জরুরি।’ ( খোসলা ও জোশি, ২০২১; চন্দ্রা, ২০১৫)

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা আধুনিক হলেও আমরা নৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে এখনো গুরু-শিষ্য পরম্পরা লালন করি কিছু অপ্রত্যাশিত রাজনৈতিক বিবাদ ছাড়া! আমরা যখন স্কুলে পড়েছি, তখন আমরা শিক্ষকদের গুরুর মতোই সম্মান করেছি এবং তারাও আমাদের প্রতি স্নেহশীল ছিলেন। কিন্তু আমাদের যেহেতু এই পরম্পরার কোনো আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ও ব্যবহারিক কাঠামো ছিল না, তাই স্কুল ছেড়ে আসার পর শিক্ষকদের সঙ্গে আর যোগাযোগ ছিল না। স্কুল ও কলেজ পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পর ভাবনার বদল হয়ে যায়, আমার অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় শিক্ষক অধ্যাপক দিলীপ কুমারের সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়ার পর, সম্ভবত ১৯৯৭ সালে আমাদের প্রথম বর্ষে।

বাংলাদেশে পরিবেশবিজ্ঞানের প্রথম বিভাগ খোলা হয় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং আমরা প্রথম ব্যাচ। ক্লাস শুরু হওয়ার অল্প কিছুদিনের মধ্যে আমরা বুঝে গেলাম, গবেষণাভিত্তিক পড়ালেখায় দিলীপ কুমার স্যারের ধারেকাছে আর কোনো শিক্ষক নেই। ক্লাস টেস্টের প্রশ্নের ধরন দেখলেই বোঝা যেত, এর সাধারণ উত্তর খোঁজা কঠিন। প্রথম বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষায় সাধারণ ছাত্রদের জন্য কিছু গঁৎবাধা প্রশ্ন থাকলেও অসাধারণ মেধাবীদের জন্য একটিমাত্র প্রশ্ন। আমার মাথায় কী আসল জানি না, আমি এই প্রশ্নের উত্তর বইপত্রের রেফারেন্স ছাড়া অনেক সময় নিয়ে নিজের মতো লিখলাম এবং অন্য প্রশ্নগুলো মধ্যম মানের। পরে জানলাম, আমিই একমাত্র শিক্ষার্থী, যে প্রশ্নটির সঠিক উত্তর লিখেছি। এরপর আমার মধ্যে একধরনের পরিবর্তন শুরু হলো। আমি ঠিক গঁৎবাধা বইপত্র ও লেখাপড়া বিসর্জন দিলাম। এটা ছিল খানিকটা জুয়াখেলার মতো, জিতলে ১০০ আর হারলে শূন্য! দিলিপ স্যার আমার মধ্যে এই সাহসের বীজ বপন করে দিলেন। পরবর্তীকালে তিনি যত ধরনের সঠিক/ভুল সব গবেষণার তারিফ করে গেলেন। এই মানুষকে আমি আমার পড়ালেখা নিয়ে এত যন্ত্রণা দিয়েছি, যা আমি মা-বাবাকেও দিইনি। কিন্ত স্যারের মুখটা কখনো উৎসাহ ছাড়া কাল দেখিনি। আমি কথাবার্তায় স্যারের অবদান সম্পর্কে স্যারের সামনে খুব একটা বলতাম না। কারণ, স্যার এটা পছন্দ করেন না। বরং অনেক সময় নিয়ে স্যারের নৈতিক মূল্যবোধ ও জ্ঞানচর্চাকে গুরু–শিষ্য পরম্পরায় নিয়ে এলাম, যাতে অন্যদের জন্য এটা উৎসাহের হয় এবং নিজের ঐতিহ্যের জন্য গর্ব ও অহংকার হয়। বলা বাহুল্য, যাঁরা আশা করেন যে তাঁদের ঐতিহ্য–সংক্রান্ত গবেষণা বিদেশিরা করে দেবেন, তাঁরা নিশ্চিত হতে পারেন, আপনাদের ও পরের প্রজন্ম ঐতিহ্যের সঠিক তথ্যপ্রমাণ জানতে পারবেন না।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট চুকিয়ে আমি মাস্টার্সের স্কলারশিপ নিয়ে চলে গেলাম এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব টোকনোলজিতে (এআইটি), যা থাইল্যান্ডে অবস্থিত। মাস্টার্স শেষ করার পর আমি বাংলাদেশে ফিরলাম, বিবাহ করলাম এবং ইউনাইটেড নেশনস এডুকেশনাল, সায়েন্টিফিক অ্যান্ড কালচারাল অর্গানাইজেশনে (ইউনেসকো) যোগ দিলাম। ইউনেসকোতে যোগ দেওয়ার কিছুদিন পর আমি গর্ভধারণ করলাম। আমি যে চুক্তিতে যোগ দিয়েছিলাম, সেটির আওতায় মাতৃত্বকালীন কোনো ছুটি ছিল না। কিন্তু আমাদের পরিচালক মালামা মেলেইসেয়া দয়া করে আমাকে চুক্তিতে না থাকা সত্ত্বেও ৩৫ দিনের মতো ছুটি দেন। আমার বাচ্চা হয়েছিল সি–সেকশনের মাধ্যমে এবং সুস্থ হওয়ার জন্য আমি যথেষ্ট বিশ্রাম পাইনি। কাজে ফেরা ছাড়া আমার অন্য কোনো উপায় ছিল না। কারণ, সংসার চালানোর অন্য কোনো অবলম্বন তখন ছিল না!

আমি কাজে যোগ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার বিভাগের সুপারভাইজার পদত্যাগ করলেন। তখন আমি যেন সাগরে পড়ে গেলাম। আমার অন্য সহকর্মীরা খুব জোরালো চেষ্টা করেছিলেন আমার চাকরিটা যেন চলে যায়। সে সময় এগিয়ে আসেন মালামা মেলেইসেয়া। তিনি আমাকে সুপারভিশনের দায়িত্ব নেন। আমি আমার বিভাগে একা ছিলাম। তাই আমাকে একা হাতে সব সামাল দিতে হতো। মালামা বুঝতে পারতেন, সদ্য সন্তানের জন্ম দেওয়া একজন মায়ের জন্য এটা কত কঠিন! আমার জন্য তিনি তাঁর দরজা খোলা রাখলেন এবং অনেক ছোট ছোট কাজ, যেগুলো একজন পরিচালকের করার কথা নয়, সেগুলোও তিনি করে দিতেন। আমি আস্তে আস্তে ঘুরে দাঁড়ালাম এবং খুব অল্প সময়ে হেড অফিস প্যারিস থেকে যে নিরীক্ষা হলো, সেই নিরীক্ষায় আমি প্রথম হলাম! নিশ্চিতভাবে আমার সহকর্মীদের অত্যাচার আরও বেড়ে গেল এবং আমি একেবারে কোণঠাসা হয়ে পড়লাম। মালামা এটা বুঝতে পেরেছিলেন এবং তিনি আমার ওপর ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন। শুধু তা–ই নয়, গাড়িতে বসে যখনই কোনো সভায় যেতাম, পথজুড়ে তিনি একটিই আলোচনা করতেন—কীভাবে বাংলাদেশের মেয়েরা নিজের পায়ে দাঁড়াবে? আমি কোনো রকম কান্না চেপে রাখতাম এবং অফিসে ফিরে নিজের ঘরে হাউমাউ করে কাঁদতাম আর ভাবতাম, বাংলাদেশের পুরুষেরা এমন হয় না কেন?

মালামা ছিলেন খুব গভীর জ্ঞানী, স্থির ও আন্তর্জাতিক কূটনীতিক, যিনি ইউনেসকোতে যোগ দেওয়ার আগে নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ছিলেন। লোকটি এত মাটির মানুষ ছিলেন যে কখনো তাঁর অসাধারণ প্রোফাইলটি কারও সঙ্গে আলোচনা করতেন না। বরং তিনি আমার মতো ছোট মানুষের লেখাজোখাও মনোযোগ দিয়ে পড়তেন এবং লেখার ওপর কলম চালানোর আগে বিনয়ের সঙ্গে অনুমতি নিতেন। বিষয়টা আমাকে অবাক করে দিত এবং জানার জন্য আমি একদিন গুগল স্কলার অনুসন্ধান করি। তখন দেখি, তাঁর গবেষণা ও প্রকাশনা ছিল বিস্ময়কর। শুধু তা–ই নয়, তিনি ছিলেন এশিয়া প্যাসিফিকের বড় পাবলিক ফিগার, অনেকটা আমাদের হুমায়ূন আহমেদের মতো। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মালামার মূল্যবোধ নিয়ে পড়ালেখা করছিলাম এবং জানতে পারলাম, তাঁর সাংস্কৃতিক ভিত্তিটি মিউচুয়াল রেসপেক্ট বা পারস্পরিক শ্রদ্ধার, যেটি আমাকে নতুন জীবনের সন্ধান দিয়েছিল।

আমার ঘর ও অফিসের লোকেরা যখন আমাকে পাগল বলে বলে প্রায় খাদের কিনারায় নিয়ে গিয়েছিল, তখন এই লোকটি তাঁর সম্মান ও মূল্যবোধ দিয়ে আমাকে মানুষ হিসেবে আগলে রেখেছিলেন। তাঁর যখন চলে যাওয়ার সময় এল, তখন তিনি কেঁদে ফেললেন। আমি কী করে সব সামাল দেব? চলে যাওয়ার সময় তিনি আমার মাথায় হাত রেখে আস্তে করে জানালেন, তিনি তাঁর দীর্ঘ কর্মজীবনে আমার মতো অসাধারণ মেধাবী ও ব্যতিক্রমী নারী দেখেননি। আমি যেন অস্ট্রেলিয়ায় পিএইচডি করার জন্য আবেদন করি, সেই পরামর্শ দিলেন। আমার হাজার না পাওয়ার মধ্যে তাঁর পরামর্শটি রহমত হয়ে দেখা দিল। তিনিই জানালেন, আমার পিএইচডির জন্য তিনি সব রকম সহযোগিতা করবেন। আমি লেগে রইলাম এবং অবশেষে আমার অস্ট্রেলিয়ায় পিএইচডি স্কলারশিপ হলো! আমাদের গ্রিফিথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডির জন্য দুটি রিকমন্ডেশন লেটার বা সুপারিশপত্র লাগত, তার একটি মালামা দিয়েছিলেন, অন্যটি দিলেন দিলীপ স্যার।

কোনো পুরুষ যখন গড়পড়তা ব্যক্তি থেকে সত্যিকারের মানবিক মানুষ হন, তখন তিনি যেন স্বর্গীয় দেবদূতের মতো আবির্ভূত হন! তিনি চাইলে একটা মেয়ে মোনালিসা হয়, কবিতা লেখে, পিএইচডি করে, জার্নালে আর্টিকেল বা নিবন্ধ লেখে, বই লেখে, সংবাদপত্রে লেখে, ভালো রান্না করে। পরিশেষে একজন মানুষ হয়ে ওঠেন।

আমরা যারা ভাত–কাপড়ের ভালোবাসা আর সম্মানে অভ্যস্ত, তাদের জন্য মিউচুয়াল রেসপেক্ট বা পারস্পরিক শ্রদ্ধা অনুধাবন করা খুব কঠিন। অনেকটা কাক থেকে ময়ূর হওয়ার মতো। এটা ভাবতে ভাবতে আমি পিএইচডির গবেষণা বাদ দিয়ে কবিতা লেখা শুরু করি, কিন্তু কখনো প্রকাশ করিনি। আমার মনে হয়েছে, আজকে এটা প্রকাশ করা যায়, যাতে কোনো মেয়ে পাগল থেকে লিওনার্দো দা ভিঞ্চির বিস্ময়কর মোনালিসা হওয়ার প্রেরণা পায়!

Heritage Enlighten

Will never say love you…!

It’s an exam for you…?

Conceptualization, clarification and authentication

Credibility and trust-worthy...

That will portray your reflexivity…

Mutual respect and spirituality

That is how you have to evaluate eternity

Only, it assures sustainability and humility.

Equality should be replaced with sense and sensibility

That is the natural law of universality... (Philosophy)...

*লেখক: শাহিদা খানম, বোর্ড মেম্বার, প্রকৃতি সংরক্ষণের জন্য আন্তর্জাতিক ইউনিয়ন, কানাডা