ঔপন্যাসিক হওয়ার বাসনা—তৃতীয় পর্ব

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

বন্ধু আশিককে বললাম, এখন বোঝ, নকল করলে এমন বিড়ম্বনায় পড়তে হতে পারে। আমি নকল না করেও নকল করার সুযোগ দেওয়ার অভিযোগে শাস্তি পেয়েছিলাম। আমাকে আমার মতো করেই লিখতে হবে। তারপর বন্ধু আমাকে উপন্যাস সম্পর্কে কিছু জ্ঞান দিলো। ‘উপন্যাস’ শব্দের উৎপত্তি হচ্ছে উপনয় বা উপন্যাস্ত শব্দ থেকে, যা ইংরেজি শব্দ Novel–এর পরিভাষারূপে গ্রহণ করা হয়েছে। সুতরাং আভিধানিক অর্থ বিশ্লেষণের মাধ্যমে বলা যায় যে একজন মানব-মানবীর যাপিত জীবনের বাস্তবতার নিরিখে রচিত কাল্পনিক উপ্যাখ্যান, যা পাঠকের কাছে আকর্ষণীয় করার জন্য বিশেষ বিন্যাসসহ সুন্দরভাবে গদ্যে গুছিয়ে লেখা হয়, মূলত সেটাই উপন্যাস। আর যেহেতু একটি উপন্যাসের প্রধান উপজীব্য মানুষের জীবন সে কারণেই উপন্যাসের কাহিনি হয় বিশ্লেষণাত্মক, দীর্ঘ ও সমগ্রতাসন্ধানী।’ আমি ভাবলাম বাব্বাহ! কী জটিল। এটা বুঝতেই তো সারা জীবন চলে যাবে! তাহলে লিখব কখন? বললাম, তোদের মতো শিক্ষকদের এই এক সমস্যা। কাউকে পেলেই স্থানকালপাত্র বিবেচনা না করে নিজের ছাত্র মনে করে লেকচার দিয়ে ফেলিস। এটা ঠিক না। সে তাঁর মৃদু হাসির মাধ্যমেই যেন আমাকে উত্তর দিল।

মৃদু হাসি খুবই শক্তিশালী। আজকাল শোনা যায় মৃদু হাসির না কি একটি দিবস আছে। ‘মৃদু হাসি দিবস’, (এখানে ইংরেজি শব্দ smile কে আমি মৃদু হাসি বলছি)। তাহলে শুধু বছরের একটি দিন মানুষ মৃদু হাসি দিবে? আর বাকি ৩৬৪ দিন মুখ বেজার করে রাখবে! না কি মৃদু হাসির পরিবর্তে অট্টহাসি দেবে! ভাবলাম ‘মৃদু হাসি’ দিবস যখন এসে গেছে, তাহলে অচিরেই ‘মৃদু কাশি’ দিবসও চলে আসবে। তবে মৃদু কাশির অন্য একটি আবেদন আছে। যখন কেউ গপ্প মারতে গিয়ে তার গপ্পের সীমা অতিক্রম করে, তখন মৃদু কাশি দিয়ে তাকে সতর্ক করে দেওয়া হয়। এখানে বাঘের লেজের গপ্প উল্লেখ্য। আমার মাঝেমধ্যে মনে হয় যে ভাবে বিভিন্ন বিষয়ের উপর দিবস পালন হচ্ছে, তাহলে বছরের ৩৬৫ দিন, দিবস দ্বারা পূর্ণ হলে কি বিশেষ দিবস বন্ধ হয়ে যাবে? না কি একই দিনে একাধিক দিবস পালিত হবে? এমন হতে পারে রবীন্দ্রনাথের গান ‘দিবস রজনী আমি যেন কার আশায় আশায় থাকি’–এর শ্রোতা বেড়ে যেতে পারে। দিবস সম্পর্কে খামাখা অনেক কথা বলে ফেললাম। আসলে কোনো বিষয় পেলে লেখার জন্য আমার হাত নিশপিশ করে। আর আমার স্ত্রীর মুখ করে ফিসফিস। তাঁর মুখ বেশি চলে আর আমার মুখের চেয়ে হাত বেশি চলে। ভুল বুঝবেন না, এ হাত কিন্তু শুধু এলেবেলে লেখার হাত, আপনারা আবার অন্য কিছু ভাববেন না।

আরও পড়ুন

বন্ধু আশিকের কথা মনে রেখে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে আবার নতুন করে আবিষ্কার করার সিদ্ধান্ত নিলাম। সুনীলের অনেক উপন্যাস পড়েছি। কিন্তু ‘আত্মপ্রকাশ’ কিংবা ‘অর্ধেক জীবন’ পড়া হয় নি। আমি বিভিন্ন সময়ে ইউটিউবে বিখ্যাত লেখকদের আলোচোনা শুনি। সেদিন উপন্যাস লেখার কৌশল শিখলাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের এক সাক্ষাতকারে। কবি বেলাল চৌধুরী সে অনুষ্ঠানের উপস্থাপক ছিলেন। আলোচনার একপর্যায়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বললেন, আমি তো কোনোদিন চিন্তা করি নাই যে আমি গদ্য লিখব। সুনীল তারুণ্যে একবার স্কলারশিপ পেয়ে আমেরিকায় যান। কিন্তু সেখানে তাঁর মন টিকে না। দেশমাতৃকার টানে এক বছর পর দেশে ফিরে আসেন। একদিন কফি হাউজে আড্ডা দিতে গেলে তাঁকে দেখে তাঁর বন্ধুবান্ধব অবাক হয়ে যান। তিনি তাঁদের বলেন, কফি হাউজের এমন সুন্দর আড্ডা ছেড়ে ওই বিদেশ বিভুঁইয়ে তার মন টেকে নি। এখন তাঁর মনোবাসনা, এখানে কোনো এক মফসস্‌ল শহরের কলেজে অধ্যাপনা করবেন আর মাঝেমধ্যে চটি বইয়ের আকারে দু একটি কবিতার বই ছাপা হলেই তিনি খুশি। সে মনবাসনা নিয়ে যাঁর জীবন ভাবনা শুরু হয়েছিলো তিনি শত শত গল্প উপন্যাস লিখে ফেলেছেন। উপন্যাস লেখার পদ্ধতি সম্পর্কে তাঁকে আমেরিকার লেখক জ্যাক কেরুয়াক বলেছিলেন, উপন্যাস লেখার সহজ উপায় হচ্ছে নিজের জীবনী দিয়ে শুরু করা। নিজের জীবনের যেকোনো একটি ঘটনা দিয়ে শুরু করা তারপর সে ঘটনা নিজের মনে যেদিক খুশি যায়। তাঁর কথা শুনে আমার মনে উপন্যাস লেখার তাগিদ বেড়ে গেল। তার আগে আমাকে খুঁজে বের করতে হবে তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘আত্মপ্রকাশ’ আরেকটি হচ্ছে ‘অর্ধেক জীবন’ কিন্তু বিদেশ বিভুঁইয়ে তাঁর ছাপার অক্ষরের বই কোথায় পাব! তাই অনলাইনে পিডিএফ খুঁজতে খুঁজতে প্রথমে ‘অর্ধেক জীবন’ পরে ‘আত্মপ্রকাশ’ খুঁজে পেলাম।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

শুরু করলাম তাঁর অর্ধেক জীবন দিয়ে। বেশ বড় উপন্যাস, প্রায় পঞ্চাশ পরিচ্ছদের। সেখানে তাঁর জীবনের অনেক কথা তিনি লিখেছেন। তবে ‘তাঁর উপন্যাস আত্মপ্রকাশ তাকে বেশ বিপদেই ফেলে দিয়েছিল। সেই গল্পের নায়কের নাম সুনীল। সেই সুনীলকে নিয়ে একটু বেশি বাড়াবাড়ি করতে গিয়ে তাঁর চরিত্র হনন করেছিলেন নিষিদ্ধ পল্লিতে নিয়ে গিয়ে। তারপর স্বাতীর সঙ্গে যখন তাঁর প্রণয় হয়, তারপর বিয়ের প্রস্তাব পাঠালে বাড়ির সবাই সাহিত্যিক হবার কারণে এ বিয়ে মেনে নিয়েছিলেন। যেহেতু নায়কের নাম সুনীল, তাই তাঁর উপন্যাস আত্মপ্রকাশের সমস্ত ঘটনাগুলিই অনেকে হুবহু সত্যি বলে ধরে নিয়েছে। স্বাতীদের আত্মীয় স্বজনের মধ্যে যাঁরা কখনো আধুনিক বাংলা সাহিত্যের তেমন কিছু পড়েন না, তারাও ‘দেশ’ শারদীয় সংখ্যায় সুনীলের লেখাটি পড়ে নিয়ে বুঝে গেল, সে সাঙ্ঘাতিক চরিত্রের ছেলে, জুয়া খেলা, মারামারি, নিষিদ্ধ পল্লিতে গমন, কিছুই বাদ নেই! তারপর টেলিফোনে তাকে জানিয়ে দেয়া হলো, এ বিয়ে হতেই পারে না। ওর বাবা এমন দুঃখ পাবেন যে হয়তো মরেই যাবেন। কিন্তু বিয়েটা শেষ পর্যন্ত হয়েছিল। তাই আত্মজীবনীতে বাড়াবাড়ি করাটাও বিপজ্জনক, আমাকে সে বিষয়টি লক্ষ্য রাখতে হবে। যাঁরা উত্তম তাঁরা নিশ্চিন্তে সমাজের বিভিন্ন স্তরে মেলামেশা করতে পারেন। তাই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর গল্পে সাবলীলভাবেই সব কথা লিখেছিলেন। আমি অধম, খুব বেশি হলে মধ্যমের কাছাকাছি খোলামেলা লেখার প্রথম সমস্যা হবে নিজের ঘর সামলানো। কারণ, কাল্পনিক সব কথা স্ত্রী বিশ্বাস করে তুলকালাম কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলবেন এ ব্যাপারে আমি অন্তত নিশ্চিত। তাই আমি মেনে চলি, ‘উত্তম নিশ্চিন্তে চলে অধমের সঙ্গে তিনিই মধ্যম যিনি চলেন তফাতে।’

আমি ভাবছিলাম আমেরিকার লেখক জ্যাক কেরুয়াকের কথা। জীবনের ঘটনা দিয়ে শুরু করলে নাকি সে লেখাটা যেদিক খুশি যায়। সর্বনাশ তাহলে কি জীবনকে তো মাঝিবিহীন পাল তোলা নৌকায় তুলে দিতে হবে! সেই পালে হাওয়া লাগিয়ে নৌকা স্বাধীনভাবে চলাফেরা করবে। তবুও একটু বৈচিত্র্য আনার জন্য ভাবছি, নিজেকে নৌকায় তুলে নদীতে নামব না কি ট্রেনে তুলে দিয়ে ট্রেনের দুলুনি খেতে খেতে আমার জীবনের গল্প বর্ণনা করব। কিন্তু নৌকাও বা কম কিসে। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন বলেছিলেন, নৌকার দোল না খেলে নৌকা আঁকবে কি করে? তা ছাড়া নদীমাতৃক বাংলাদেশে রেল ভ্রমণ ঠিক হবে না। যদিও আমি ভালো সাঁতার জানি তারপরও পানিতে আমার অনেক ভয়। সাহসে ভর করে উঠিয়ে দিলাম নিজেকে পাল তোলা নৌকায়। বাহ! কি সুন্দর নির্মল হাওয়া! আমার উপন্যাস মাঝিবিহীন পাল তোলা নৌকায় দুলতে দুলতে এগিয়ে চললো।

আরও পড়ুন

লিখে ফেললাম, উপন্যাসের প্রথম পর্ব। ভাবলাম উপন্যাস সম্পন্ন করার আগে প্রথম পর্বটির জন্য মতামত দরকার। যদি পত্রিকার সম্পাদক সাহেব পছন্দ করেন, এবং সবুজ সংকেত দেন তাহলে উপন্যাস লেখা সম্পন্ন করব। আমার উপন্যাসের প্রথম পর্বটি পাঠালাম বিখ্যাত পত্রিকার সম্পাদকের কাছে। বিদেশ থেকে পাণ্ডুলিপি পাঠানোর সহজ উপায় হচ্ছে ইমেইল। তারপর অপেক্ষার পালা। কেটে গেলো কয়েকটি বিনিদ্র রজনী। অগত্যা একদিন ইমেইল পেলাম সেই সম্পাদক সাহেবের কাছ থেকে। তিনি লিখেছেন, আপনার লেখাটি খুব মনোযোগ দিয়ে কয়েকবার পড়লাম। উপন্যাসের চেয়ে আমার কাছে নৌকা ভ্রমণ রচনা হিসেবে খুব ভালো লেগেছে। দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি যে, পত্রিকার পাতায় এই নৌকা ভ্রমণ রচনার স্থান হবে না। তবে আমি নিশ্চিত পরীক্ষার খাতায় এ রচনা মুক্তার মতো জ্বলজ্বল করবে এবং সেখানেই এর উপযুক্ত স্থান। এ রকম লিখলে নৌভ্রমণ রচনা হিসেবে পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়া যাবে সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।

সম্পাদক সাহেবের আবেগঘন ইমেইল পড়ে নিজের অজান্তেই আমার কণ্ঠে বেজে উঠল একটি গান, ‘মন মাঝি তোর বৈঠা নে রে, আমি আর বাইতে পারলাম না।’ সমাপ্ত

*লেখক: বায়াজিদ গালিব, ক্যালগেরি, কানাডা