ঔপন্যাসিক হওয়ার বাসনা-প্রথম পর্ব

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

বেশ কিছু রম্যগল্প লেখার পরও স্ত্রী আমার ওপর নাখোশ। আমি তাকে বললাম, আমি কি ভুল কিছু করছি? সে উষ্মা প্রকাশ করে বলল, অবশ্যই! শেষ পর্যন্ত গোপাল ভাঁড় নাম নিয়ে যেতে হবে যদি সারাক্ষণ রম্যগল্প নিয়ে থাক। এই ভাঁড়ের ভার আমার আর সহ্য হচ্ছে না। হয় লেখা ছাড়, নয় উপন্যাস লেখো। সুড়সুড়ি দিয়ে লোক হাসানোর কোনো মানে হয় না। বাদ দাও এসব। তোমার আশপাশে কত লোক সুন্দর গল্প লেখে, উপন্যাস লেখে, তুমি ছোট্ট গণ্ডির বাইরে বের হতে পারছ না। আসলে তোমার পড়াশোনার জ্ঞান সীমিত। আর এই সীমিত জ্ঞান নিয়ে কি আর বড় কিছু লেখা যায়?

স্ত্রী একটি সত্য প্রকাশ করেছে, তার শেষ উক্তির সঙ্গে আমি একমত। আমার মনে হয়, এ বিশ্বে সবচেয়ে কম পড়াশোনা করে যাঁরা লেখালেখি করেন, তাঁদের মধ্যে আমিই সেরা। যাহোক, স্ত্রীর কথার ওপর কথা নেই। চাঁদ যেমন সূর্যের আলোয় আলোকিত হয়, আমিও স্ত্রীর রাগে রাগান্বিত হয়ে প্রতিজ্ঞা করলাম, না, আর ভাঁড় হওয়া চলবে না। উপন্যাস লিখে পাতলা আমাকে হতেই হবে। যদিও আমার বাস্তব ওজন কয়েক ছটাকের বেশি নয়। স্ত্রীর ব্যাপারে আমি খুবই উদার ও সব সময় নীরবতা পালনই উত্তম মনে করি। এতে গৃহে শান্তি বজায় থাকে। এরপর আমার মনে তীব্র বাসনা ঔপন্যাসিক হওয়ার। বউ যখন নাচনেওয়ালাকে ঢোলের বাড়ি দিয়েছে, তখন কি না নেচে উপায় আছে! আমি কল্পনার রাজ্যে ঢুকে গেলাম। দিবাস্বপ্ন। আমি উপন্যাস লিখে বিখ্যাত হয়ে গেছি। আমার অনেক ভক্ত-অনুরক্ত। সবাই আমাকে ঘিরে রেখেছে। আমি অটোগ্রাফ দিচ্ছি। দুই হাতে ভিড় ঠেলে সামনে এগোতেই কাচ ভাঙার শব্দে মোহ ভঙ্গ হলো। বাস্তবে দেখলাম, আমার হাতের ধাক্কায় স্ত্রীর প্রিয় ফুলদানি মেঝেতে পড়ে শত টুকরা। ঔপন্যাসিক হওয়ার বাসনার প্রথম খেসারত। এর পরের ঘটনা আরেক বিরাট ইতিহাস। ফুলদানি ভাঙলে ভাঙুক, উপন্যাস আমাকে লিখতেই হবে। তবে উপন্যাস পড়া আর উপন্যাস লেখা এক নয়। কীভাবে শুরু করব, তা নিয়ে ভাবতে থাকলাম। অনলাইনে গুগল সার্চ করে হতাশ হলাম। সেখানে লেখা ‘হাউ টু রাইট আ বুক’। একটি ফরম পূরণ করে সাবমিট করার কিছুক্ষণের মধ্যেই ফোন এল সুলোলিত কণ্ঠের, ‘আমি অমুক পাবলিশার থেকে বলছি। আমরা তোমার বই ছাপাতে সাহায্য করতে পারি।’ আহা! কী মিষ্টি কণ্ঠ! আমি গলিত ও বিগলিত হয়ে বললাম, আমি তো জানতে চেয়েছিলাম কীভাবে বই লেখে। আর তুমি পাবলিশিং কোম্পানি থেকে বলছ, কীভাবে বই ছাপাতে হয়? মেয়েটি একটু নীরবতা পালন করে বলল, ও আচ্ছা, ঠিক আছে। বই লেখার পর আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করবে। অনলাইনের হাল ছেড়ে দিলাম।

সেই সময় একুশে ফেব্রুয়ারি ও বইমেলা সামনে রেখে বাংলাদেশে গিয়েছিলাম। যতই বিদেশে থাকি না কেন, সব সময় দেশ আমাকে টানে। রাজপথে লাখো লোকের ভিড়, বাসের হর্ন, যানজট, রিকশায় চলাচল—এসব থেকে বঞ্চিত রয়েছি অনেক দিন। বাংলাদেশে যাওয়ায় আমার সুবিধা ছিল, সেখানে পরিচিত কিছু লেখক ও বন্ধুবান্ধব আছে, যাদের কাছ থেকে উপন্যাস লেখার কলাকৌশল জেনে নেওয়া যাবে। এ বিশ্বে সবকিছুই কিনতে হয় মূল্য দিয়ে, শুধু একটি জিনিস ছাড়া, তা হলো উপদেশ! যা চাহিবামাত্র বাহককে দিতে বাধ্য থাকিবে, সঙ্গে ফাউ হিসেবে আরও কিছু। একদম বাংলাদেশ ব্যাংকের কড়কড়া নোটের মতো। দ্বারস্থ হলাম হালে লেখা কিছু পরিচিত লেখকের কাছে। তাঁদের মধ্যে আমার সঙ্গে যিনি সহজ, তাঁর কাছেই প্রথম গেলাম। অনেক কথার পর আমার উপন্যাস লেখার ইচ্ছা বলতে দ্বিধা হচ্ছিল। তিনি যেন আমার মনের কথা অনুমান করে ফেললেন। বললেন, আমার মনে হয় আপনি কিছু বলতে চাচ্ছেন? আমি বিনয়ের সঙ্গে তাঁকে আমার মনের কথা বললাম। তিনি আমার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকালেন, বললেন, ‘এমন পাগলামি কবে থেকে মাথায় ঢুকেছে?’ আমি নিরুত্তর। তিনি বললেন, ‘সবে লেখালেখি শুরু করেছেন, সেই লেখার মান অনেক নিচু পর্যায়ে। আগে সেই মান ঘষেমেজে ঠিক করুন। তা ছাড়া উপন্যাস লিখতে হলে প্রচুর পড়াশোনা করতে হয়, আমার ধারণা, সেটা আপনি করেননি।’ একপ্রকার বিরক্ত হয়েই বিদায় করলেন। আমিও নাছোড়বান্দা। উপন্যাস লেখার সহজ উপায় বের করতেই হবে। আরবি শেখার সহজ উপায়, ইংরেজি শেখার সহজ পদ্ধতি কিংবা এক মাসে জাপানি ভাষাশিক্ষা বাজারে পাওয়া গেলে, উপন্যাস লেখার সহজ পদ্ধতিও নিশ্চয় পাওয়া যাবে।

এসব বই সাধারণত গুলিস্তান ফুটপাতে দেখা যায়। ছুটলাম গুলিস্তানের দিকে। অনেক দিন পর এদিকটায় আসা হলো। অনেক পরিবর্তন। সিনেমা হল ভেঙে শপিং মল করা হয়েছে। তারপরও ঢাকার প্রথম শীতাতপ প্রেক্ষাগৃহ গুলিস্তানের কথা এখনো মনে পড়ে। এ গুলিস্তানের নিচে ছিল পূর্ণিমা রেস্তোরাঁ। এখানকার জিলাপি বিখ্যাত। কিছুক্ষণ গুলিস্তানের ফুটপাতে ঘোরাঘুরি করলাম, সেখানে অনেক চটি বই দেখলাম, মোটাকাটা হওয়ার সহজ উপায়, বিসিএস পরীক্ষায় পাস করার সহজ পদ্ধতি, আমেরিকার কোনো প্রেসিডেন্ট বাদাম বিক্রয় করতেন, কোন প্রেসিডেন্ট কাঠুরিয়া ছিলেন ইত্যাদি ইত্যাদি। উপন্যাস লেখার কোনো সহজ উপায় খুঁজে পেলাম না। সেই সঙ্গে খুঁজে পেলাম না আমার মানি ব্যাগ। মানি ব্যাগ অবশ্য প্রায়ই খালি থাকে, আজ তেমনই অবস্থা। বেচারা পকেটমারের জন্য দুঃখ হলো। যত মুশকিল তত আসান। আমি সাধারণত টাকা রাখি কয়েক ভাগে। তাই বেশি চিন্তিত ছিলাম না। হঠাৎ মনে পড়ল আশিকের কথা। আশিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সতীর্থ ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বাংলা সাহিত্যের মেধাবী ছাত্র। সে তো এখন সেখানে অধ্যাপনা করছে, তাহলে তার কাছ থেকে কিছু পরামর্শ হয়তো পাওয়া যাবে।

অনেক দিন মানুর ওখানে যাওয়া হয় না। ওর ওখানে বিকেলটা কাটিয়ে এলে মন্দ হয় না। আমার সব কথা শুনে মানু স্তব্ধ হয়ে গেল। ‘বলিস কী! তোর বউ তোকে লেখালেখিতে বাধা না দিয়ে উপন্যাস লিখতে বলেছে? তুই সত্যি ভাগ্যবান।’ আমি প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালাম। সে বলল, ‘আমার একবার লেখালেখির শখ হলো। একটি কবিতা লিখব বলে সকাল থেকে কাগজ কলম নিয়ে ঘষাঘষি করছিলাম। বউ অনেকক্ষণ ধরে আমাকে লক্ষ করছিল। এগিয়ে এসে বলল, “আজকাল কেউ আবার চিঠি লেখে নাকি!” আমি একটু লাজুক মুখে নিচের দিকে তাকালাম। সন্দিহান বউ অন্য কিছু ভাবল। কাছে এসে দেখে আমি কবিতা লিখছি। বলল, “ও হঠাৎ কবি হবার শখ হলো কেন, কারও প্রেমে পড়লা নাকি!” বললাম, বলো কী? প্রেমে পড়লেই কি শুধু কবিতা লেখে! সে বলল, “দরকার নেই। তার চেয়ে বাজার করে নিয়ে আসো কাজে লাগবে। খামাখা সময় নষ্ট কোরো না। কবিতা লেখার অনেক লোক আছে।” আমি অগত্যা অভিমানে আমার অসম্পূর্ণ কবিতাকে ছিঁড়ে কুটিকুটি করে ফেললাম। প্রতিজ্ঞা, জীবনেও কিছু লিখব না, এমনকি বাজারের লিস্টও না।’ তারপর মানু বলল, ‘তাদের সুখী করতে হলে শুধু শপিং মলে নিয়ে ঘুরবি, তাহলেই সব ঠিক।’ আমি বললাম, ‘এটা ঠিক নয়, আমার স্ত্রী তো তেমন নয়। (এ কথা বললাম স্ত্রীকে খুশি করার জন্য, যদিও সে আমার লেখা পড়ে না; কিন্তু হঠাৎ পড়ে ফেললে কাজে দেবে)।’ মানু বলল, ‘তবে শোন, আমার কিছুদিন হয় হৃদ্‌যন্ত্রে সমস্যা হচ্ছে। চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়মিত হাঁটাহাঁটি করতে। কিন্তু এই শ্রাবণ মাসে যতবার পার্কে হাঁটতে গিয়েছি, ততবারই বৃষ্টির কারণে বাসায় ফিরতে হয়েছে। গিন্নিকে বললাম সমস্যার কথা। সব শুনে তার চোখে-মুখে যে উজ্জ্বলতা দেখেছি, আমার বিবাহিত জীবনে তা দেখিনি। সে আমাকে বলল, “এতে চিন্তার কি আছে? বৃষ্টির দিনে শপিং মল হচ্ছে হাঁটার জন্য সবচেয়ে উপযোগী। চলো, আজ থেকে আমরা প্রতিদিন সেখানে হাঁটতে যাব।” আমিও খুশি। এমন কথা আমার মাথায় এল না কেন বুঝতেই পারলাম না। সেদিনই মলে হাঁটতে গিয়ে আমার হাঁটা হলো ঠিকই, সেই সঙ্গে আমার গিন্নির বড় ধরনের শপিং হয়ে গেল। এবার বুঝলাম, কেন সে এত খুশি হয়েছিল। সাত দিন হাঁটার পর বুঝলাম, আমার ব্যায়ামের চেয়ে পকেটের ব্যায়াম বেশি হয়ে যাচ্ছে।’ তারপর মানু বলল, ‘ঘণ্টার পর ঘণ্টা শপিং মলে ঘুরে পা ব্যথা হয়ে যায়।’

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

এ ব্যাপারে একটি মজার জোকস শুনেছিলাম, ‘এক স্বামী স্ত্রীর সঙ্গে চার ঘণ্টা মলে ঘুরে, ২০ থেকে ২৫ দোকান ঘুরে, শতাধিক শাড়ির মধ্যে যখন একটি শাড়ি পছন্দ করে কিনল, তখন স্বামী নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে করল।’ আমি বললাম, ‘কেন?’ সে বলল, ‘কারণ, যে স্ত্রী এত যাচাই-বাছাই করে শত শাড়ির মধ্যে একটি শাড়ি বেছে নিল, তার মানে হাজারো ছেলের মধ্যে যে আমাকে স্বামী হিসেবে পছন্দ করেছে, সে কারণেই আমি ভাগ্যবান।’ আমি না হেসে পারলাম না। আমি বললাম, ‘কেনাকাটা মেয়েদের একধরনের শখ। এ ব্যাপারে আমাদের কিছুই করার নেই।’ বন্ধুর কথা শুনতে বেশ ভালোই লাগছিল। সে বলল, ‘চল, উপন্যাসের ব্যাপারে আমরা আশিকের সঙ্গে কথা বলি।’ আমি বললাম, ‘তুই তো আমার মন পড়ে ফেলেছিস। আমি তো সে জন্যই তোর কাছে এসেছি। সত্যি বলতে কি আমার কোনো বাহন নেই, তাই তোর ঘাড়ে চড়ে যেতে চাই।’ সে বলল, ‘কোনো সমস্যা নেই।’ চলবে...

*লেখক: বায়াজিদ গালিব, ক্যালগেরি, কানাডা

**দূর পরবাস–এ ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস [email protected]