ঔপন্যাসিক হওয়ার বাসনা—দ্বিতীয় পর্ব
বইমেলাতে আমার রম্যগল্পের বই প্রকাশিত হয়েছে। আমি বেশ একটা ভাব নিয়ে বই মেলাতে গেলাম। ভাবখানা সৈয়দ ওয়ালীউল্লারর ‘লালসালু’–এর মতো এক বই লিখেই বিখ্যাত। আশেপাশে তাকালাম, উদ্দেশ্য, কেউ আমাকে চিনতে পারছে কি না তা দেখা। তেমন কিছুই ঘটল না। আমি যে আড্ডায় যোগ দিব, সেখানে পৌঁছালাম। দেখলাম পরিচিতি বেশ কয়েজন কবি–সাহিত্যিক বসে আছেন। তাঁরা মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত লেখক। আমি তো হালে লেখালেখি শুরু করেছি। তাই বেশি কথা না বলে চুপ করে থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম। সবাই তাঁদের অটোগ্রাফসহ আমাকে তাঁদের প্রকাশিত বই ধরিয়ে দিলেন, আমি অনেক চেষ্টা করেও আমার একটি বই কাউকে দিতে পারলাম না। শুধুই তাঁদের বই কিনলাম। এক কবিকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কি শুধু কবিতা লেখেন? গল্প-উপন্যাস লিখেছেন? আমার কথা শুনে এমনভাবে আমার দিকে তাকালেন, যেন কাক আমার মাথায় বিষ্ঠা ত্যাগ করেছে। বললেন, আরে ভাই, কবিতা লেখা খুব কঠিন, গল্প-উপন্যাসের মতো সস্তা জিনিস আমি লিখি না। তাঁর কথার উত্তরে বললাম, আচ্ছা আমাকে কী উপন্যাস লেখার সহজ উপায় বলে দিতে পারেন। এবার তাঁর দৃষ্টিতে পরিষ্কার হলো যে তিনি একজন মূর্খের সঙ্গে কথা বলছেন। আমি তাঁকে আমার একটি বই উপহার দেওয়ার জন্য লেখার প্রস্তুতি নিতেই তিনি তা বুঝতে পারলেন, বললেন, ‘ইয়ে মানে আমাকে আজ অনেক জায়গায় যেতে হবে, আপনার বই আমি অন্য একদিন নেব।’ তারপর চলে গেলেন।
একটু দূরে লক্ষ করলাম, একজন লোক তাঁর পরনে লালের ওপর বিভিন্ন ছাপ দেওয়া ছবি সম্বলিত কোর্তা, একই রঙের পায়জামা, মাথায় নেপালি টুপি। ঠিক একজন ঝাল মুড়ি-চানাচুর বিক্রেতার মতো। শুধু তাঁর হাতে কোনো চোঙা নেই, তা না হলে ফুৎকার দিয়ে হয়তো বলতেন, এই ঝাল-মুড়ি-চানাচুর। তিনি আমাদের দিকেই আসছেন। আমি শঙ্কিত হলাম। পাগল না কি? না ! বইমেলায় অনেক লোকের সমাগম, তাই পাগলরা এখানে আসে না। লোকটি আমাদের কাছে আসতেই অন্যরা তাকে সালাম দিয়ে বললেন, কেমন আছেন? তিনি উত্তরে বললেন, কেমন আছি এই প্রশ্নটি আপেক্ষিক। একেকজনের কাছে ভালো থাকার সংজ্ঞা একেক রকম, তাই এ অবান্তর প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ায় ভালো। আমি এমন কবির থেকে দূরত্ব বজায় রাখার সিদ্ধান্ত নিলাম। কিন্তু লোকটির বেশভূষা একজন অপ্রকৃতস্থের মতো হলেও তিনি তালে ঠিক আছেন। কথা গুছিয়ে বলেন। আমি কিছু বলছি না বলে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি লেখক না কবি? এ প্রশ্নে কিছুটা বিব্রত হলেও সেখানে উপস্থিত একজন আমার সম্পর্কে বললেন। তখন তিনি বললেন, এ দেশের তো সবাই কবি–সাহিত্যিক, আপনি ভালো পথে এগোচ্ছেন, আমাদের দেশে রম্যলেখক তেমন একটা চোখে পড়ে না। আমি শঙ্কিত হলাম, তাহলে কি রম্য লেখক সাহিত্যিকের আওতায় পড়ে না? তবে আমি যে সাহিত্যিক না, সে ব্যাপারে নিশ্চিন্ত। তা এবার আপনার বইমেলায় কোন বই বের হয়েছে? আমি বিনয়ের সঙ্গে তাঁকে আমার একটি বই উপহার দিলাম। সে বইয়ের নাম পড়েই তিনি উচ্চ হাসি দিলেন। বললেন, মনে হয় মজার হবে। আমি বললাম, একটি বইয়ের মলাট কিন্তু সে বইয়ের ভালো–মন্দের গুণ বিচার করে না। আমি আমার ফোন নম্বর দিলাম, বললাম, পড়ে জানাবেন কেমন লাগল। তিনি প্রায় জোর করেই দাম দিয়ে দিলেন, বললেন, বিনা পয়সায় কাউকে বই দেবেন না, পয়সা দিয়ে বই কিনলে যত্ন করে পড়বে, আর মাগনা দিলে সেটা ফেলে রাখবে। তাঁকে আমার খুব ভালো লেগে গেলো, আমি বললাম, আমি আপনাকে একটি কথা জিজ্ঞেস করবো? তিনি বললেন, বলুন কী কথা। আমি বললাম, সম্প্রতি আমার উপন্যাস লেখার শখ হয়েছে, আপনি কি আমাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করবেন? মানে আপনার যদি উপন্যাস লেখার কোনো সহজ উপায় থাকে, আমাকে বলবেন। তিনি মৃদু হেসে বললেন, উপন্যাস লেখাসংক্রান্ত প্রখ্যাত লেখক হুমায়ূন আহমেদের একটি উক্তি পড়েছিলাম। তা হচ্ছে, একজন বাবার কাছে সন্তান সবচেয়ে প্রিয়। গল্প, উপন্যাস লেখার যদি সহজ কোনো উপায় থাকত, তাহলে সে তাঁর সন্তানকেই আগে শেখাত। তাঁর কথা পড়ে নিরাশ হলাম। তাহলে তো কেউ আমাকে সহজ পদ্ধতি শিক্ষা দেবে না।
আমি তাঁকে বললাম, আরেকটি কথা জিজ্ঞাসার আছে, যদি কিছু মনে না করেন। তিনি বললেন, বুঝেছি, আমার এই পোশাকের কথা বলবেন তো? আমি মাথা নাড়তেই তিনি বললেন, কোনো এক বিশেষ কারণে এই পোশাক পরেছেন, সে কারণটা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। তবে একটি ব্যাপার আমার কাছে ভালো লাগছে বইমেলার লোকজন যাঁরা আমাকে চেনেন না, তাঁরা হয়তো পাগল ভাবছেন, আর যারা আমাকে চেনেন, তাঁরা এ ব্যাপারে কিছুই বলবেন না বলেই আমার বিশ্বাস। আমার জন্য তার উত্তরটি যথার্থ ছিল, আমি তো তাঁকে চিনতাম না।
একদিন সময় বের করে আমি আর মানু নির্দিষ্ট একটি দিনে বন্ধু আশিকের কাছে গেলাম। সদ্য ক্লাস শেষ করে তাঁর রুমে বসেছে। আমাদের দেখে তাঁর চিরচারিত মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল, কি রে তোর খবর কী? অনেক কথার পর আমার আসার উদ্দেশ্য তাঁকে বললাম। বন্ধু আমার কথা শুনে বলল, তোর রম্যরচনা নিয়েই থাকিস না কেন? তুই তো ভালোই লিখিস। বিশেষ করে লালমিয়ার চরিত্র খুবই মজার। রম্যগল্প লেখার লোক খুব কম। গল্প–উপন্যাস তো অনেক লেখকই লেখেন। তাঁর এই উপদেশ আমার মোটেও পছন্দ হলো না। আমি আমার গিন্নির সব কথা তাঁকে জানালাম, তারপর বললাম, গৃহ শান্তি বড় শান্তি, তাই আমাকে অন্তত একটি উপন্যাস লিখতেই হবে। সে অনেক চিন্তা করে বলল, তুই কিন্তু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের আত্মজীবনীমূলক উপন্যাসগুলো পড়তে পারিস। বিশেষ করে ‘অর্ধেক জীবন’ অথবা প্রথম উপন্যাস ‘আত্মপ্রকাশ’। সেখান থেকে ধারণা পেয়ে যাবি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মূলত লেখার জীবন শুরু করেছিলেন কবিতা দিয়ে। তিনি কবিতা লিখতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। দেশ পত্রিকার পীড়াপীড়িতে আত্মজীবনী দিয়ে শুরু করেছিলেন প্রথম লেখা। তারপর যখন ‘অরণ্যের দিন রাত্রি’ লিখলেন, সেটা প্রখ্যাত পরিচালক সত্যজিৎ রায় চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রস্তাব দিলেন। তার পর থেকে তাঁকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয় নাই। একের পর এক গল্প-উপন্যাস রচনা করেছেন। পাশাপাশি কবিতাও লিখেছেন অনেক। আমি বললাম, আমি নকল করতে পারব না। সে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকাতেই আমি বললাম, তোকে নকল করার বিড়ম্বনার কথা বলতে পারি। ইতিহাস পরীক্ষায় বাদশাহ আকবর সম্পর্কে প্রশ্ন এলে একজনের কাছে এ প্রশ্ন জানা ছিল না তাই সে তাঁর পাশের সহপাঠীর খাতা দেখে লেখা শুরু করলো, ‘বাদশা আকবর খুব ধৈর্যশীল, সাহসী ছিলেন। তিনি শত বিপদেও কখনো “জাঙ্গিয়া” পরিতেন না।’ আসল কথা ছিল তিনি শত বিপদেও কখনো ভাঙ্গিয়া (ভেঙে) পরিতেন না। নকল করিলে ‘ভাঙ্গিয়া’ হয়ে যেতে পারে ‘জাঙ্গিয়া’। আমার কথা শুনে বন্ধু বললো, এ তো নিছক গল্প। আমি বললাম, গল্প হলেও এমন ঘটনা জীবনে বাস্তবে ঘটেছিল। স্কুল জীবনে এক সহপাঠী ছিল, তার মতে এ পৃথিবীতে দুইটি অপ্রয়োজনীয় জিনিস আছে এক হচ্ছে পরীক্ষা, আর দুই কাঁচা মরিচ। এগুলো এ পৃথিবীতে না থাকলেই ভালো হতো। সে সব সময়ই পরীক্ষার প্রস্তুতির ব্যাপারে উদাসীন ছিল। তার উদ্দেশ্য, সে যা পারে, লিখবে বাকিটা বন্ধুদের খাতা দেখে চালিয়ে দেবে, কোনো মতে পাস করলেই তো হয়। সেবার বিজ্ঞান পরীক্ষায় তাঁর একটি প্রশ্ন লিখতে পারলেই তার পাস নিশ্চিত। সে কারণে আমাকে একটি প্রশ্নোত্তর দেখানোর জন্য বারবার অনুরোধ করছিলো। অতঃপর আমি কিছুটা বাধ্য হয়ে আমার খাতা খুলে রাখলাম, সে তা সন্তর্পণে লিখে ফেলল। বিজ্ঞানশিক্ষক পরীক্ষার খাতা দেখতেন আমাদের সঙ্গে নিয়ে। উদ্দেশ্য সে কি বুঝে লিখেছে না কি, না বুঝেই মুখস্ত লিখেছে। সেই বন্ধুটি এক জায়গায় সে লিখেছে, প্রতিটি পদার্থের গঠন ভিন্ন, যেমন ‘আমার’ অণু এবং ‘লোহার’ অণুর গঠন এক রকম না। এটুকু পড়ে শিক্ষক তাকে বললেন, তুমি আমার অণু বলতে কি বোঝাতে চেয়েছো? সে আমতা আমতা করে বললো, ইয়ে, মানে স্যার আমার শরীরে অণু। শিক্ষক বললেন, মানুষের শরীরে কোষ থাকে, অণু না। সে ছেলেও নাছোড়বান্দা, সে আমাকে দেখিয়ে বলল, স্যার সেও তো তাই লিখেছে। স্যার বিস্মিত হয়ে বললেন, তুমি কি ওর খাতা দেখে লিখেছো? সে নিরুত্তর। স্যার আমার খাতা বের করে বললেন, ও তো লিখেছে ‘তামার’ অণু ‘লোহার’ অনুর চেয়ে ভিন্ন। তুমি ‘তামার’ জায়গায় ‘আমার’ বসিয়ে দিলে? সে বার তাঁকে প্রশ্নোত্তর দেখানোর কারণে শাস্তি হিসেবে আমাকেও ওই প্রশ্নোত্তরের কোনো নম্বর দেওয়া হলো না। চলবে..
*লেখক: বায়াজিদ গালিব, ক্যালগেরি, কানাডা
দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস [email protected]