মিসিসিপি থেকে গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন

ক্যানোপি স্ক্রিন

আমাদের ভ্রমণের ছকটি ছিল: কলম্বাস> ডালাস> লাস ভেগাস> ইউটা> অ্যারিজোনা। আমাদের ঘরের কাছে কলম্বাস বিমানবন্দর। পারিবারিক বন্ধু আলীম আমাদের দুজনকে পৌঁছে দিল। প্রায় এক ঘণ্টা দেরিতে ফ্লাইট ছাড়ল। এক ঘণ্টা চল্লিশ মিনিটের ফ্লাইট। পাইলটেরা অপেক্ষাকৃত ইয়াং। তাই হয়তো একটু বেশি ইনফরমেশন দিতে চায়। টেকঅফের পর বলছে আবহাওয়ার কারণে একটু টারবুলেন্ট হতে পারে। অবশ্য তেমন কিছু হয়নি, সুতরাং বেভারেজ সার্ভ শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে ঘোষণা, আবার টারবুলেন্ট শুরু হতে পারে, সুতরাং অ্যাটেন্ডেন্ট দুজনকে সিটে বসতে হলো।

আমার প্লেনফোবিয়া থাকার কারণে এসব অ্যানাউন্সমেন্ট চিন্তাটা বাড়িয়ে দেয়। আবার তেমন একটা ঝাঁকুনি হয়নি। এয়ার হোস্ট ও হোস্টেস দুজনেই আবার বেভারেজ সার্ভ করা শুরু করলেন। আর আধা ঘণ্টা পরেই ল্যান্ডিং করার কথা।

হঠাৎ একটা কিন্তু হয়ে গেল। আবার অ্যানাউন্সমেন্ট। ডালাস ডিএফডব্লিউ এয়ারপোর্টের ল্যান্ডিংয়ের ক্লিয়ারেন্স এখনো নেই। মনে হচ্ছে এয়ারপোর্টে ট্র্যাফিক জ্যাম। পাইলট বলে যাচ্ছে আমাদের বেশ কিছুটা সময় ঘুরে বেড়াতে হবে। যদিও ফুয়েলের সমস্যা নেই।

প্লেনের সব যাত্রীই খুব আয়েশে আছে। আমার চিন্তার শেষ নেই। ফুয়েল আছে, যদি শেষ হয়ে যায়? আবার কতক্ষণ ঘুরবে?

‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

শেষ পর্যন্ত প্রায় এক ঘণ্টা পর আমরা ল্যান্ড করলাম নিরাপদে। আমাদের ছোট মেয়েটা প্রায় এক ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করছে বিমানবন্দরের বাইরে।

এই টেক্সাসে বড় মেয়ের বাসস্থান হওয়ার পর অনেকবার এসেছি। প্রতিবারই মনে হয়েছে টেক্সাস এমন একটা অঙ্গরাজ্য, সবকিছুতেই যেন একটা বিশালত্ব রয়েছে এখানে, বিশেষত ফ্রিসকো ও প্লেনোর দিকটায়, যা টেক্সাস উত্তরে।

প্রতিটি স্টেটেই বড় বড় স্টোর যা আছে, টেক্সাসে সেগুলো মেগাস্টোর। এমনিতেই টেক্সাস একটি দ্বিতীয় বৃহত্তম স্টেট, আলাস্কার পরেই।

এর অর্থনীতি শক্তিশালী, সংস্কৃতি সমৃদ্ধ এবং সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য রয়েছে। আপনি এখানে এলেই বুঝতে পারবেন, টেক্সাস কেন আমেরিকার সেরা রাজ্য।

টেক্সাসের অর্থনীতি দেশের অন্যতম শক্তিশালী। টেসলা, ডেল ও এক্সনমোবিলসহ অনেক বড় কোম্পানির এখানে সদর দপ্তর রয়েছে। অন্যান্য অনেক রাজ্যের মতো, টেক্সাসে কোনো আয়কর দিতে হয় না। এখানে মরুভূমি, পাহাড়, বন ও সৈকত রয়েছে। আর টেক্সাসবাসী বন্ধুত্বপূর্ণ ও স্বাগত জানানোর জন্য পরিচিত।

এবার আমাদের বড় মেয়ের বাসায় নতুন অভিজ্ঞতাও হয়েছে। তার ব্যাকইয়ার্ড গার্ডেনে নানা জাতের ক্যাকটাস রয়েছে। এক ক্যাকটাসে ফল হয়েছে। এবং সেই ফলের জুস পান করলাম। দুই হাত সাইজের কৃষ্ণচূড়াগাছে ফুল ফুটেছে।

স্প্রিংডেল, ইউটা

চার দিন পর আমাদের অত্যন্ত প্রিয় কুকুর পিনাট ও মমদের ছেড়ে ডিএফডব্লিউ এয়ারপোর্টের দিকে রওনা হলাম।

প্রথম ডেসটিনেশন লাস ভেগাস। এই শহরে মানুষ আসে শুধু আনন্দ করার জন্য। মনে হয় জীবনে এদের কোনো দুঃখবোধ নেই। হোটেল ভর্তি শহর, আর হোটেলগুলোই দর্শনীয়। একেক হোটেল একেক থিমের ওপর তৈরি, যেমন আমরা ছিলাম নিউইয়র্ক হোটেলে। আর ক্যাসিনো ছাড়া বড় বড় হোটেল ভাবাই যায় না। সারা বিশ্বে কী ঘটছে, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রে অন্য কোথায় কী ঘটছে, কোনো তাপ–উত্তাপ নেই। বেড়াতে আসা আবাল বৃদ্ধ মানুষ শুধুই যেন আনন্দ ফুর্তি করার জন্য এই লাস ভেগাস শহরটিতে আসে। আমার কাছে মনে হয়েছে মানুষ যেন সার্বক্ষণিক খাচ্ছে, ড্রিংক করছে, আর ক্যাসিনোতে টাকা গচ্ছা দিচ্ছে অথবা বিভিন্ন শো দেখছে।

ভেগাসের ডাউনটাউন হলো পুরোনো দিনের আদলে তৈরি, যেখানে রয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম এলইডি ক্যানোপি স্ক্রিন। ফ্রিমন্ট রাস্তাটির ওপরই সেই স্ক্রিন (ছবি-১)। বিনে পয়সায় দেখা যায় বিভিন্ন থিমভিত্তিক ডিজিটাল শো, সেই সঙ্গে মিউজিক সেলিব্রেটি গায়ক–গায়িকাদের গান।

এই একটি শহর, যে শহর রাতে ঘুমায় না। এই শহরে প্রতিনিয়ত প্রোগ্রাম বা শো করে সেলিব্রেটিরা মিলিয়নেয়ার–বিলিয়নেয়ার হয়েছেন এবং হচ্ছেন।

এন্টিলোপ ক্যানিয়ন

অনেক কাল পরে লাস ভেগাসে সার্কাস, ‘Cirque du Soleil’ দেখলাম। এই সার্কাস রূপান্তরিত হয়ে এখন চোখজুড়ানো আর্ট ফর্মে পরিণত হয়েছে। নতুন টেকনিক ও টেকনোলজি সংযোজিত হয়েছে।

ভেগাস পর্ব শেষ করে আমরা গাড়ি করে রওনা হলাম ক্যানিয়ন স্টেট, ইউটার স্প্রিংডেল শহরের দিকে। স্প্রিংডেল পাহাড়ঘেরা ছবির মতো একটি দারুণ সুন্দর শহর (ছবি-২)। হোটেল, জাইয়ন লজে উঠলাম। এখানকার সবকিছুতে জাইয়ন কথাটা জড়িত। ‘জাইয়ন’ নামটি মূলত আইজ্যাক বেহুনিনের নাম থেকে এসেছে, যিনি একজন মরমন পথিকৃৎ ছিলেন। আইজ্যাক বেহুনিন ১৮৬৩ সালে জাইয়নে বসতি স্থাপন করেন।

একটু রিফ্রেশ হয়ে বাইরে বের হলাম। আহ্‌ কী সুন্দর! কী সুন্দর!! আমার স্ত্রী বলে উঠল, এখানে বছর দুয়েক থাকা যায়।

এরপর আমরা জাইয়ন ন্যাশানাল পার্কে বেড়ানোর উদ্দেশ্যে ফ্রি শাটেলে চেপে বসলাম। রাস্তার উভয় দিকে নানা রংয়ের (একমাত্র সবুজ ছাড়া, গাছ–গাছড়াবিহীন) উঁচু–নিচু পাহাড়—প্রকৃতির এক বিস্ময়কর সংযোজন। সেই সঙ্গে স্রোতস্বিনী পাহাড়ী নদী, জঙ্গল, আঁকাবাঁকা পথ—এক অত্যাশ্চর্য প্রকৃতি।

গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন

জাইয়ন পর্ব শেষ করে আমরা যাত্রা করি অ্যারিজোনার পেজ শহরের দিকে। আমাদের কলম্বাসের মতোই ছোট্ট শহর। ক্যানিয়ন স্টেট হিসেবে ইউটা ও অ্যারিজোনার মধ্যে খুব একটা ফারাক নেই। বলা চলে গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন পড়েছে অ্যারিজোনায়।

এই পেজ শহর থেকে আমরা ভয়ঙ্কর সুন্দর, অ্যান্টিলোপ ক্যানিয়ন দেখতে গেলাম (ছবি-৩)। এটা ছিল গাইডেট ট্যুর। ১০ জনের একটা পিকআপ ভ্যানে আমাদের গাইড ও ড্রাইভার ছিল নেভাজো ট্রাইবস নারী। স্মার্ট, ভালো ইংলিশ বলে।

কথিত আছে প্রায় ১৯ কোটি বছর আগে নেভাজো ল্যান্ডে আকস্মিক বন্যা ও ক্ষয়ের মাধ্যমে অ্যান্টিলোপ ক্যানিয়ন তৈরি হয়েছিল। বৃষ্টির জল, বিশেষ করে বর্ষাকালে স্লট ক্যানিয়ন অংশের ওপর বিস্তৃত অববাহিকায় প্রবাহিত হয়, তখন এটি ঘষে তুলে ফেলতে সক্ষম বালু ও ধ্বংসাবশেষ বহন করে, যা প্রাকৃতিক বালুর কাগজের মতো কাজ করে। ধীরে ধীরে আমরা আজ মসৃণ প্রবাহিত আকারগুলো দেখতে পাই। এরপর আমরা আবার গাড়ি চালিয়ে গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন দেখার জন্য অ্যারিজোনার টুসেইন শহরে হলিডে ইনে উঠলাম। তখন বিকেল গড়িয়ে গেছে। হোটেল থেকে ফ্রেশ হয়ে ড্রাইভ করে গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন দেখতে যাই। বলা হয়, কলোরাডো নদীই এই গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন তৈরি করেছে (ছবি-৪)।

ঘোড়ার পায়ের আকৃতিসম ক্যানিয়ন

অবশ্য ওই স্পট থেকে ভালোভাবে সূর্যাস্তটা দেখা হয়নি। তাতে কী! আইম্যাক্স সিনেমা হলে গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের ওপর ডকুমেন্টারি দেখলাম। তবে গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন থেকে সূর্যোদয় দেখাটা বেশ ভালোভাবেই হয়েছে। তা ছাড়া হর্স সু ক্যানিয়ন যেন ডিজাইনার প্রকৃতির নিদর্শন (ছবি -৬)।

অ্যারিজোনার রাজধানী ফিনিক্স শহরের দিকে রওনা হই। পেজ থেকে ফ্ল্যাগস্টাপ, সেডোনা হয়ে ফিনিক্সে পৌঁছি। অবশ্য পথিমধ্যে অনেক স্থানে থেমে থেমে ঐতিহাসিক এবং দারুণ সুন্দর সুন্দর জায়গা দেখে নিয়েছি।

প্রথমেই আমরা দেখতে গিয়েছি মন্টিজুমা ক্যাসেল, যেখানে প্রায় ১২০০ বছর আগে টুজিগুট ট্রাইবেল গোষ্ঠী তাদের বাসস্থান বানিয়েছিল পাহাড়ের মাঝখানে। তারপর বিভিন্ন ভিউ পয়েন্টে থেমে রকি পাহাড়, লেক ও ভ্যালিতে বাড়িঘর দেখলাম। এমনই একটি ভিউ পয়েন্টে একটি মজার ঘটনা ঘটে। আমাদের মেয়ে ও তার মা তখন বাংলায় কথা বলছিল। হঠাৎ একজন আমেরিকান ভদ্রলোক তাদের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, আর ইউ স্পিকিং বেঙ্গলি? এই বলে তার ফোনটা চোখের সামনে ধরল। ভিডিও কলে ইতালি থেকে এক বাঙালি কথা বলছে। আমিও তখন এগিয়ে যাই। বাঙালি ভদ্রলোকের নাম রুবেল, আর আমাদের সামনে দাঁড়ানো ভদ্রলোকের নাম রে। ক’বছর আগে রে ইতালিতে বেড়াতে গিয়ে রুবেলের সঙ্গে পরিচয় এবং তারা বন্ধু হয়ে যায়। অনেকক্ষণ আমাদের কথা হলো এবং বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠল।

আরও পড়ুন

সেখান থেকে আমরা  ‘The Chai Spot’–এ এলাম। এই এরিয়াটা এক কথায় অপূর্ব। এই চা স্টলটি একটি জীবনকাহিনি ও মানবিক দৃষ্টান্তের উদাহরণ।

ক্যানিয়ন স্টেট অ্যারিজোনাতে এমন একটি উপভোগ্য, রিলাক্সিং জায়গা আছে, যা না দেখলে বিশ্বাস হবে না। ফ্ল্যাগস্টাপ থেকে ফিনিক্স যাওয়ার পথে একটি ছোট্ট মনোরম মনোমুগ্ধকর শহর ‘সেডোনা’। সেই সেডোনাতেই রয়েছে এক মানবিক জীবনকাহিনি।

বেলুচিস্তানের খালিদা ব্রোহি ও কালিফোর্নিয়ার ডেভিড যুগলের এই চা স্টলটি নিতান্তই দর্শনীয় স্থান। নানা ধরনের চা যেমন বাটার চা, বেলুচিস্তানের চা, নারকেল চা, এ ছাড়া স্ন্যাকস রয়েছে। পাকিস্তান, ভারতীয় স্যুভেনির, জামাকাপড় ইত্যাদিও রয়েছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এই চা স্টলের আয়ের অর্ধেক ধাতব্য কাজে ব্যয় করা হয়।

সেডোনার পর সরাসরি ফিনিক্স এয়াপোর্টের কাছে ম্যারিয়ট হোটেলে উঠি। পরদিন ভোরে আবার আমেরিকান এয়ারলাইনসে চড়ে মিসিসিপির কলম্বাসে ফিরে আসি।

* লেখক: জীবেন রায়, প্রফেসর ইমেরিটাস, মিসিসিপি বিশ্ববিদ্যালয় ফর উইম্যান, কলম্বাস, মিসিসিপি, আমেরিকা

আরও পড়ুন