জানা-অজানার একটি ভ্রমণকাহিনি

দ্য লাস্ট বুকস্টোরে বই দিয়ে একটি ভাস্কর্যছবি: লেখকের পাঠানো

অনেক দিন পর সস্ত্রীক ও ছোট মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে কোথাও বেড়াতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমাদের গন্তব্য হাওয়াইয়ের হনুলুলু, যেখানে ৪০ বছর আগে আমি হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্ট-ডক্টরাল ফেলোশিপ করেছিলাম। আমার এক বন্ধু এখনো সেখানে থাকে। ছোট মেয়ে পুরো পরিকল্পনাটি তৈরি করেছিল। বলা চলে মিসিসিপিসহ ৮টি অঙ্গরাজ্যে পা রেখেছি। বেশির ভাগটাই গাড়ি করে। আমরা মিসিসিপি, আলাবামা হয়ে টেনেসিতে ব্রেক নিয়েছি। পিরামিড আকৃতির বিশাল শপিং সেন্টার, নাম ‘বাস প্রো শপ’। সেখানে খাওয়াদাওয়া সেরে দোকানটা ঘুরে রওনা হই আরকানসাসের হট স্প্রিং শহরের দিকে।

শহরের কাছাকাছি আমরা বনের মধ্যে একটি ইগলুসদৃশ বাড়িতে দুই রাত ছিলাম। আমাদের তিনজনের জন্য একটি উষ্ণ ইগলু বাড়িতে (দোতলা) থাকা এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা ছিল, যেখানে রাতের বেলায় পোকা-ক্রিকেট, পাখি-প্যাঁচা, কুকুর, শেয়াল আর সেই সঙ্গে বাতাসে গাছপালা-পাতার মর্মর ধ্বনি।

পরদিন সকালে আমরা হট স্প্রিং শহরটা ঘুরতে বের হলাম। শহরজুড়ে রয়েছে হট স্প্রিং—রাস্তা ফুঁড়ে গরম জলীয় বাষ্প অনবরত বেরোচ্ছে। বিভিন্ন স্থানে ফুটন্ত পানির আধার। পুরো শহরটাই যেন ফুটন্ত লেকের ওপর ভাসমান। অনেক সেলিব্রিটিরা এই শহরে এসেছে। আমরা বিখ্যাত একটি প্যানকেকের রেস্টুরেন্টে ব্রাঞ্চ করেছিলাম। পরে আমরা আমাদের বড় মেয়ের বাড়ি ডালাসে গাড়ি চালিয়ে যাই।

তিন দিন পর প্লেনে উঠলাম। লং ফ্লাইট। আমরা ডালাস ফোর্ট ওয়ার্থ বিমানবন্দর থেকে সাড়ে আট ঘণ্টার সরাসরি আমেরিকান এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটে যাই। তারপর আমার বন্ধুর বাড়িতে উবারে যাই। প্রকৃতপক্ষে ৪০ বছর পর আমাদের একটি দুর্দান্ত পুনর্মিলন হয়েছিল।

হনুলুলুতে সাত দিনের অবস্থানের মধ্যে, আমরা প্রতিটি পর্যটন স্থানে চষে বেরিয়েছি। আমরা মূলত বাস ব্যবহার করেছি। হনুলুলুতে বাস পরিবহন খুবই ভালো। তুলনামূলক সস্তা। তবে মাঝেমধ্যে আমরা উবারও ব্যবহার করেছি। আমরা কুয়ালোয়া শুটিং এলাকাসহ অনেক জায়গা ঘুরেছি, যেখানে শতাধিক সিনেমার দৃশ্য ধারণ করা হয়েছিল। জুরাসিক পার্কসহ অনেক ব্লকব্লাস্টার মুভির শুটিং হয়েছে। পাহাড়ি অঞ্চল, মাঝেমধ্যে সমতল।

আমরা দ্বীপটার চারপাশ বাসে ঘুরেছি। এদের মধ্যে এক নম্বর উল্লেখযোগ্য প্লেস হলো পলিনেশিয়ান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। পুরো ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা কাটানোর মতো জায়গা। নানা ধরনের কালচারাল শো, খাবারদাবার, শপিং, বোট রাইড—সময় কাটানোর সব ব্যবস্থাই এখানে আছে।

চক্রাকার হনুলুলুর অন্যান্য জায়গায় রয়েছে ডোল কোম্পানির আনারস খেত, তা ছাড়া পর্যটকদের জন্য রয়েছে বিশ্বের সর্বোচ্চ সমুদ্রসৈকত ওয়াইকিকিসহ বিভিন্ন সি বিচ।

১২ মাসের আবহাওয়া অন্যান্য স্থানের মতো তেমন একটা পার্থক্য নেই। ফুল-ফলারি বাংলাদেশের মতোই। সবকিছু পাওয়া যায়। মাছের ভেতর টুনা ও স্যামন প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়।

আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এখানকার মানুষ অনেকটাই সৎ, তুলনামূলক ক্রাইম কম।

৪০ বছর পর পুরোনো বন্ধুর বাসায় ৭টা দিন কেমন করে চলে গেল, টেরই পাইনি। হনুলুলু থেকে ফিরে আসার সময়, আমরা লস অ্যাঞ্জেলেসে দুই দিনের জন্য যাত্রাবিরতি করেছিলাম। আমরা প্রথমেই হলিউডের আইকনিক সাইনবোর্ডের কাছাকাছি গেলাম। অনেকটাই হাইকিং করে উঠলাম। তারপর গেলাম সিগনেচার এরিয়ায়, যেখানে সব ধরনের সেলিব্রেটির স্বাক্ষর এবং হাত-পায়ের ছাপ রয়েছে।

তারপর একটা দারুণ জায়গায় গেলাম। লস অ্যাঞ্জেলেসের একটি বইয়ের দোকান, যার নাম ‘দ্য লাস্ট বুকস্টোর’। এটি একটি বিশাল বড় লাইব্রেরি। ক্যালিফোর্নিয়ায় নতুন এবং পুরোনো উভয় বইয়ের বৃহত্তম বইয়ের দোকান। ২২ হাজার বর্গফুট আয়তনের দ্বিতল ভবনটিতে ২৫০ হাজার বই আছে। এ ছাড়া, সব ধরনের রেকর্ডের সংগ্রহ রয়েছে।

শুধু বই নয়, রয়েছে সিডি, অন্যান্য রেকর্ড, ক্যাসেটের সম্ভার। সব শিল্প, নকশা, এমনকি ভাস্কর্য তৈরি করা হয়েছে বই ব্যবহার করে। একটি ছবি দেখুন।

তারপর আমরা বড়দিনে ডালাসে উড়ে গেলাম। আমাদের বড় মেয়ে আগেভাগেই একটি ইন্ডোর বন্দুক চালনা প্র্যাকটিসের জন্য টিকিট কেটে রেখেছিল। আমি বললাম, আমি বন্দুক নিয়ন্ত্রণের ওপর কয়েক ডজন নিবন্ধ লিখেছি, আর আমি বন্দুক চালাব। অবশেষে, আমি গেলাম এবং জীবনে প্রথমবারের মতো বন্দুক হাতে নিলাম। বিভিন্ন বয়সের মানুষ বিভিন্ন ধরনের বন্দুক নিয়ে অনুশীলন করছে, কিন্তু অবাক হলাম পাশাপাশি টিনএজাররাও প্র্যাকটিস করছে। যুক্তরাষ্ট্র এ জন্যই একটি ‘গান কান্ট্রি’।

*লেখক

‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]