গাড়ি চালনার যত কেচ্ছা: শেষ পর্ব

উত্তরায় যেখানে ড্রাইভিং শেখার খোঁজ নিলাম, সেখানে খরচা সরকারি খরচের ঠিক দ্বিগুণ! এখন বুঝলাম কেন বিআরটিসিতে ড্রাইভিং শিখতে এত ভিড়। সচ্ছল পরিবারের কর্তা, গিন্নি থেকে শুরু করে পেশাদার চালক—সবাই ভর্তি হচ্ছেন।

বাইরে ড্রাইভিং ক্লাস করলে সেটাও অবশ্য শেষমেশ এখানকার কোনো হর্তাকর্তাদের ধরে লাইসেন্স কার্ড জোগাড় করতে হয়। তখন আবার উচ্চ হারের উৎকোচ দেওয়ার ব্যাপার থাকে। কাজেই বলা যায়, উভয় পিঠেই বেশ বড় অঙ্কের খরচ লুকিয়ে আছে! শুরুতে যখন ভর্তি হচ্ছেন, তখন দ্বিগুণ খরচ দেওয়ার পাশাপাশি অন্তে আবার কার্ডের জন্য পেছনের দরজায় টোকা লাগানো! এত ঝামেলায় না গিয়ে সবাই সোজা পথে হাঁটছেন। তখন দোটানায় পড়ে গেলাম। একদিকে প্রতিদিন প্রশিক্ষক মহাশয়ের তুচ্ছতাচ্ছিল্য হজম করা আর অন্যদিকে এত খরচের ধাক্কা!

মানসিক বিষণ্নতা নিয়ে নতুন কিছু শিখে ফেলার মতো মানুষ তো নই। ভাবলাম, ড্রাইভার পরিবর্তন করা যায় কি না, সে খোঁজ নিয়ে দেখি। ওরা কারণ জানতে চাইলে বললাম, ওই সময়ে আমার আর সম্ভব হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে আবার নতুন করে ভর্তিপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে। তা-ও পরের মাসে ক্লাস শুরু হবে। বলা হয়, যখন কোনো সমস্যার সৃষ্টি হয়, তখন সমাধানের পথও খুলে যায়। আপাতত এর কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। এদিকে আবার ঘুরেফিরে ক্লাসের সময় হয়ে গেল। ভাবছিলাম এর আগেই হয়তো একটা উপায় হয়ে যাবে। অগত্যা আবারও সেই দম বন্ধ করা জায়গায় গিয়ে হাজিরা দিতে হবে।

আরও পড়ুন

আজকের ক্লাসেও আমাকে দিয়েই শুরু হলো যাত্রা। এর আগের দিনের ভুলগুলো মোটামুটি কাটিয়ে উঠছি দেখে আজকে আরও কিছুটা গতি বাড়াতে বললেন গুরুজি। তখন আবার কিছুটা বেসামাল হয়ে পড়ছিলাম। গাড়ি চালাতে গতির প্রতিক্রিয়ায় নিয়ন্ত্রণ করা নিয়েই যদি সমস্যা থাকে, তাহলে বুঝতে হবে অবশ্যই শেখায় গলদ রয়েছে। ‘গোদের উপর বিষফোড়া’র মতো গাড়ির অন্যরা এর আগের দিনের মতো আমাকে বিভিন্নভাবে বলেকয়ে সাহায্য করার চেষ্টা করলেও ওই দিন গুরুমহাশয়ের নির্দেশ থাকায় ওরাও কিছু করতে পারল না। টুকটাক ভুল করলেও ওই দিন বেশি সময় না থাকায় আনিসুর ভাইকে ড্রাইভিং সিটে ডেকে পাঠালেন। হয়তো তিনি চালিয়ে দেখালে আমারও শেখা হয় তাই। তাঁর চালানো দেখে সবকিছুই বেশ সহজ ঠেকল। তিনি একেবারে পাকা ড্রাইভার হওয়ায় তাঁকে ট্রেইনার মহাশয়ের কিছুই বলতে হলো না। শুরু থেকে আমাকে যা করে দেখাতে বলা হয়েছিল, সবকিছুই নিখুঁতভাবে করে দেখালেন ভাইয়া। এরপর রানা আর নাজমুলকে নিয়ে চলল একটু অন্য ধরনের প্রশিক্ষণ। রিভার্স ড্রাইভিং করতে বললেন। কিছুটা সময়ের জন্য হলেও চলল। তারপর পার্কিংয়ের কিছু সাধারণ ধারণা দিলেন।

যেমন পরীক্ষার সময় কোথায় চিহ্নগুলো দেওয়া হবে। কোথায় স্পর্শ করলে পরীক্ষা বাতিল। কয় ধরনের পার্কিং করতে বলা হয়। তখন মনে মনে ভাবছি, এরা তো সবাই লম্বা রেসের ঘোড়া। কিন্তু আমার মতো যাঁরা টাট্টু ঘোড়া, তাদের কী হবে? এসব করতে করতেই ওই দিনের মতো ক্লাসের ইতি। আমরা যে যার মতো বাসায় ফেরার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। এমন সময় আমার কাছে অপরিচিত ফোন নম্বর থেকে কল এল।

-হ্যালো, আমি কমিউনিটি মেডিকেল থেকে বলছি। আপনি কি অতনু বলছেন?

-হ্যাঁ, বলছি।

-আপনি এখানে চাকরির আবেদন করেছেন। আমরা আপনার সাক্ষাৎকার নিতে ইচ্ছুক।

-আচ্ছা, ধন্যবাদ। কবে নাগাদ হবে?

-আগামীকাল সকাল ১০টার দিকে। আমাদের অফিসের দোতলায় এসে যোগাযোগ করবেন।

-হ্যাঁ, অবশ্যই। অনেক ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।

-আচ্ছা, আপনিও।

আরও পড়ুন

মনের মধ্যে অনেক কিছুই খেলে যেতে লাগল। কী করব? এখন তো গুরুমহাশয়ের কাছে গিয়ে এ ব্যাপারে কথা বলা নিরর্থক। এ জন্যই যে, আমার সাক্ষাৎকার বা চাকরি এটা নিজের মাথাব্যথা। ওই লোক যেখানে ড্রাইভিংয়ের ব্যাপারেই কোনো সাহায্য-সহযোগিতা করছেন না, সেখানে আমার চাকরি হলো বা না হলো তাতে তাঁর কিচ্ছু যায়-আসে না। সিদ্ধান্ত নিলাম, আগামীকাল সকালেই তাঁকে ফোনে জানিয়ে দেব ব্যাপারটা। আর এরপর তো কয়েক দিন ছুটি আছে। এর মধ্যে দেখতে হবে ইন্টারভিউয়ের ফলাফল কী আসে। বাকি ব্যবস্থা তখন নিতে হবে। তবে যেকোনো মূল্যেই ওই মহা ধুরন্ধর বিজ্ঞ ব্যক্তির কাছ থেকে শত যোজন দূরত্ব বজায় কীভাবে রাখা যায়, সেভাবে এগোতে হবে।

পরদিন সকালের জলখাবার খেয়ে ছাদে গিয়ে কল দিলাম ভদ্রলোককে। বাসায় বসে তাঁর সঙ্গে কথা বলাটা স্বস্তির কাজ বলে মনে হলো না।

-হ্যাঁ, ভাই, আমি অতনু বলছিলাম।

-হ্যাঁ, বলেন।

-আমার আজকে একটা ইন্টারভিউ আছে। সকাল ১০টায়। আজকে আর আসা হবে না।

-আচ্ছা, ঠিক আছে। আপনার ইন্টারভিউ কই?

-বড় মগবাজার এলাকায়।

-ঠিক আছে।

-আচ্ছা, রাখলাম।

তখনো জানতাম না যে এর পরের সপ্তাহেই জীবনের প্রাত্যহিক জীবনের ঘটনাপঞ্জিতে ব্যাপক পরিবর্তন আসতে চলেছে। করুণাময়ের আশীর্বাদে চাকরি হয়ে গেল। আমিও একপ্রকার হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। অনেক কিছুই মাথায় ঘুরছে। যদি চাকরি না হতো তখন হয়তো একদিকে এই ব্যক্তিকে নিষেধ করে দিলাম, কিন্তু যদি এরপরের ব্যাচেও ও-ই আবার আমার ট্রেইনার হন। বা অন্য কোথাও ট্রেনিং করে দেখা গেল যার কাছে পরীক্ষা দিতে বিআরটিসিতে গেলাম, সে-ই আমার পরম পূজনীয় গুরুমহাশয়! বা কার্ডের জন্য এ ব্যক্তিকেই যোগাযোগ করা হলো। এমন আরও অনেক আজগুবি চিন্তাভাবনা মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল।

তবে সব কথার শেষ কথা, ওই মহাজ্ঞানীর কাছে আর যাচ্ছি না। এমনিতেই ড্রাইভিং শেখার সব সাধ, আহ্লাদ মিটে গেছে ইতিমধ্যেই। এখন শুধু তাঁকে ফোন করে শেষবারের মতো আনুষ্ঠানিকতা সেরে ফেলা বাকি। ফোন করলাম সোমবার সকালেই ঠিক ক্লাসের ঘণ্টাখানেক আগে। মোটামুটি বেশ কিছুটা গুরুগম্ভীর কণ্ঠে তাঁকে চাকরি হওয়ার কথা জানিয়ে ক্লাসের ইস্তফা দিলাম। এত দিন পর্যন্ত কথায় কথায় বাজে ব্যবহার করলেও ওই দিন আমতা-আমতা করেই বললেন যে তিনি আমাকে অন্য কোনো ব্যাচে ভর্তি করতে পারেন। সটান না করে দিলাম। মনে মনে বলি, এই অসহ্য মানসিক বিষণ্নতা থেকে মুক্তি নিয়ে দরকার হলে বাসায় বসে মাছি তাড়াব, তা-ও ঢের ভালো! এরই সঙ্গে সাঙ্গ হলো বাংলাদেশের ড্রাইভিং শেখা।

পরে কানাডায় আসার পর যখন দ্বিতীয়বারের মতো ড্রাইভারের সিটে বসি, তখন পাকা আট বছরের ব্যবধানে সব কায়দা বেমালুম ভুলে গেছি! বাংলাদেশ আর কানাডার ট্রাফিক নিয়মের ব্যবধান এত যে এর তুলনা না করাই উত্তম! একদিকে যেখানে ঢাকা শহরের অসহ্য যানজটে চিড়েচ্যাপটা হয়ে নাভিশ্বাস উঠে নাগরিকদের জীবনে। চট্টগ্রামের অবস্থা এতটা খারাপ না হলেও বর্ষাকালে শহরতলি ছোটখাটো খালে পরিণত হয়। কাজেই যানবাহনের পাশাপাশি এখানে অবকাঠামোগত সমস্যাও ভয়াবহ। অন্যদিকে এখানে যানজটের কোনো অবস্থা আমি সিডনি শহরে দেখিনি (সত্যিই দেখিনি!) আর হ্যালিফ্যাক্সে আসার পর গত দুই বছরে যানজটের কবলে পড়েছি হাতে গুনে তিন থেকে চারবার। আমি এখানকার বাসে নিয়মিত যাতায়াত করি। বলতে গেলে সিডনি থেকে এখানে চলে আসার পর তো একপ্রকার বাসের ওপরই নির্ভরশীল। দুদেশে লব্ধ অভিজ্ঞতার আলোকে বলব যে ড্রাইভিং শেখার স্বপ্ন আজও ধাঁধার মতো। মনে হচ্ছে এখানকার সবকিছু এত নিয়ম মেনে চলে। তারপরও যেহেতু লক্ষ্য থেকে দূরে আছি। অর্থাৎ গলদ লুকিয়ে আছে আপন কর্মের মধ্যে! এখানে চাকরির ফাঁদে পড়ে গিয়ে হোক বা দেশে অতি পণ্ডিত প্রশিক্ষকের খপ্পরে পড়ে হোক, শেষ দম পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়ে যেতে পারলে সফলতা আসতে বাধ্য। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, সে ইচ্ছা-অনিচ্ছার নাগরদোলায় আমার আর চাপতে শখ হয় কি না! সমাপ্ত...