গাড়ি চালনার যত কেচ্ছা: বাংলাদেশ পর্ব-৩
তার এমন অদ্ভুতুড়ে আবদারে বেশ ভ্যাবাচেকা খেলাম। নিরুপায় হয়ে গাড়িতে ইগনিশন দিলাম। আগেই জানতাম গিয়ারিং করতে গিয়ে ভালোই তালগোল পাকিয়ে যাবে। হলোও তা–ই! গাড়ি ঠিকঠাক চালানোর সময় যে গতির প্রয়োজন হয়, তার চেয়ে অনেক কম গতিতে চলতে লাগল। প্রথমে গাড়ি চালিয়ে কিছুটা গিয়ে বাঁয়ে মোড় নেওয়ার পর তিনি গিয়ার পরিবর্তন করতে বললেন। পরিবর্তন করতে সমস্যা হতো যদি এর আগের রাতে সুমন ভাইয়ার এঁকে দেওয়া ছবিটা মাথায় না থাকত। তবে দ্বিতীয় গিয়ারে দেওয়ার পর গতি বাড়লেও আমি কিছুটা বেসামাল হয়ে পড়লে ট্রেইনার মাস্টার আবার আগের জায়গায় এসে চালাতে বললেন আর মুখে নিজে নিজে ফিসফিস করে কী সব অখাদ্য বকে যাচ্ছেন, সেদিকে মন দিতে পারিনি। ওই জায়গায় সকালের দিকে তেমন কোনো ভিড়ভাট্টা হয় না বললেই চলে। প্রশ্ন হচ্ছে, যখন রাস্তায় ট্রাফিক ভর্তি অবস্থায় চালানোর পালা আসবে তখন কী হাল হবে?
বারবার পাশ থেকে তাগাদা দিচ্ছেন আমাদের গুরুজি—
‘স্পিড বাড়ান, হ্যাঁ, আরেকটু...বাড়ান।’
‘আরে? এই স্পিড দিয়ে তো কিছুই করতে পারবেন না আপনি। রাস্তায় এভাবে গাড়ি চালাইলে কোনো দিকে না কোনো দিকে ঠিকই লাগাই দেবেন!’
‘কালকে যে কী শিখাইলাম কী জানি?’
অনেকক্ষণ কথা হজম করার পর বলতেই হলো—‘ভাই, আমি তো এর আগে কখনো চালাই নাই। কয়েক দিন চালাতে দেন, সব ঠিক হয়ে যাবে।’
‘হ ভাই, ঠিক হইলেই হয়! না হইলে তো আপনারে আবার অন্য ব্যাচে ভর্তি করন লাগব!’
তখন মনে মনে ভাবছি, ট্রেইনার পরিবর্তন করা যায় কি না? কারণ, এ ব্যক্তিকে নিয়ে দূর দূর পর্যন্ত আশার কোনো রকম আলো দেখতে পাচ্ছি না! ও এটাই চায় এখানে সবাই সবকিছু শিখে আসবে। আর উনি এখানে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী কোনো নেতার মতো নিজের প্রশংসাসূচক বাক্যবাণী প্রচার করবেন। চা-নাশতা খাওয়ার পাশাপাশি বাকি সময়টা স্রেফ খোশগল্পে কাটাবেন। গত তিন দিনে এসবই দেখলাম। আমি বাদে অন্য যে-ই ড্রাইভিং সিটে বসছে চালানোর জন্য আগের অভিজ্ঞতার সুবাদে কারও শেখার ব্যাপারে তেমন কোনো আগ্রহ না থাকায় গালগপ্প বেশ জমে উঠছে। আমাকে নিয়েই গুরুজির যত জ্বালা! না করতে পারছি গিয়ার নিয়ন্ত্রণ, না আছে স্পিডে কোনো বাড়ন্তি। বেশ উসখুস করতে করতেই কীভাবে যেন মিনিট ১৫ চালানোর পরে ট্রেইনার মহাশয়ের হুঁশ হলো বাকিদেরও চালাতে দিতে হবে। হোক সেটা নিছক লোকদেখানোর জন্য হলেও! ঝটপট করে আমার জায়গায় আসতে বললেন নাজমুলকে। ওই চালু ছেলে আমার জায়গায় এসে ড্রাইভিং সিটে বসেই হনহনিয়ে চালাতে লাগল পুরোনো মডেলের টয়োটা গাড়ি। মনে হচ্ছে এতক্ষণ লড়খড়িয়ে চলতে থাকা গাড়িটায় হঠাৎই প্রাণের সঞ্চার হয়েছে! শুরুটা হতো বিআরটিসির পেছনের দিকে ট্রেনিংয়ের জন্য রাখা গাড়ির জায়গা থেকে। এরপর মূল ভবনের সামনে দিয়ে ঘুরে পেছনের দিকে একটা গলি বেয়ে গিয়ে আবার শুরুর জায়গায় ফেরত আসা। ব্যস! এতটুকু দূরত্ব পার হতে আমার নাকের আর চোখের পানি এক হয়ে গিয়েছিল।
পরেরজন রানা। আমাদের সম্মানিত গুরু মহাশয় বুঝে গিয়েছিলেন আনিসুর ভাইয়ের গাড়ি না চালালেও চলে। তাই ওনার জন্য বরাদ্দ সময়ের হিসাব সবচেয়ে কম রেখে বাকিদের চালাতে দিয়েছেন। এটা অবশ্য তার বিচক্ষণতার পরিচয় দেয়। এত দিনের লব্ধ অভিজ্ঞতায়কে কত দূর এগোবে সেটা বেশ তাড়াতাড়িই বুঝতে পারে সে। রানার কিছুটা জড়তা গাড়ি চালানোর শুরুতে সব সময়ই থাকে। পরে কেটে যেতেও বেশিক্ষণ সময় লাগে না। রানার ছোটবেলা থেকেই ও গাড়ি চালিয়েছে বিভিন্ন সময়। ওদের গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গেলে ওখানে চালিয়ে বেশ মজা পেত। ভরদুপুরে গাড়ি চালানোর ফাঁকে অন্য বাড়িতে আম চুরির গল্পও বলে গেল! সত্যিই, বেশ মজার এসব স্মৃতি। আনিসুর ভাইয়ের সময় লাগল সবচেয়ে কম। উনি বসেই গাড়ির এক চক্কর দিতেই ট্রেনারজি ‘ওকে’ করে দিয়ে ওই দিনের পাট ওখানেই চুকিয়ে ফেললেন।
গাড়ি চালানো শেষ করে আনিসুর ভাইয়ের সঙ্গে কিছুটা আলাপ হলো। ওনার ব্যক্তিগত গাড়ি না থাকায় বেশ অসুবিধে হচ্ছে। অবশেষে তিনিও ব্যক্তিগত গাড়ির দিকে ঝুঁকলেন। ঢাকা শহরের অসহ্য যানজটের অন্যতম কারণ এই ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা হু হু করে বাড়তে থাকা। কর্তৃপক্ষের অবহেলায় তরতর বেগে বেড়ে চলেছে গাড়ির সংখ্যা।
রানা আর নাজমুলের সঙ্গেও কিছুক্ষণ কথা হলো এর পরদিন। ওরা আমাকে বেশ কিছু টিপস দিয়ে সাহায্য করল। যদিও আমার যত অভিযোগ ছিল গুরু মহাশয়ের বিরুদ্ধে। ওদের ওদিকে খুব একটা ভ্রুক্ষেপ নেই। আমার জন্য যখন গুরুজি মহাবিরক্তের কারণ তখন ওদের কাছে নানা গল্পের কথা শুনিয়ে আসর জমিয়ে ফেলা কোনো বন্ধু! কত গল্প। কোনো দিন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের গল্প, তো কোনো দিন মন্ত্রী মশাইকে আনতে গিয়ে ঝামেলা পোহানোর গল্প। তবে প্রায় প্রতি গল্পের উপসংহারেই দেখা যায় নায়ক আমাদের মহান ট্রেইনার। রীতিমতো শুনে মনে হয় কেন ওনাকে দেশের ‘বিশিষ্ট ড্রাইভার’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়নি সেটাই বিবেচনা করে দেখা উচিত কর্তৃপক্ষের।
এরপরের সপ্তাহেও আমার কোনো রকম উন্নতি তো দূরের কথা, বিরক্তি আরও চরম সীমায় পৌঁছাল। এর আগে কোন জায়গায় ভুল করলে মহাশয় ধরিয়ে দিতেন। এখন তিনি স্রেফ চুপ করে পাশে বসে থেকে মজা দেখেন। আর ওদিকে পেছন থেকে রানা, নাজমুল বা কোনো কোনো সময় আনিসুর ভাই ভুল শুধরে দিতে থাকেন! খুব খারাপ লাগত। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম আর যা-ই হোক এখানে আর সময় নষ্ট করে কাজ নেই। অন্য কোথাও ব্যবস্থা করতে হবে। কোনো প্রাইভেট কোম্পানি বা পরিচিত কাউকে যদি পাওয়া যায়! ‘দুর্জন বিদ্বান হলেও ত্যাজ্য’ মাথায় রেখে আমার বাসা উত্তরার সেক্টরের আশপাশের জায়গায় টুকটাক খোঁজ নিলাম। চলবে...